ওজন কমানোর নিরাপদ ও কার্যকরী উপায়

বাড়তি ওজন ও মেদের সাথে যোগসূত্র রয়েছে বহু রোগের। টাইপ-টু ডায়বেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও লিভার ডিজিজ, অস্টিওআথ্রাইটিস এবং খাদ্যনালি, কোলন, লিভার ও লিস্ফ নোডের ক্যানসার আর এ-থেকে মৃত্যুঝুঁকি স্থূলকায়দেরই বেশি। কাজেই মেদ ও বাড়তি ওজন কমানো খুবই জরুরি।

আশার কথা হলো, ওজন কমানোর ব্যাপারে মানুষের মধ্যে সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। তবে এ-কাজে যে প্রক্রিয়া তারা অনুসরণ করছে তার সবগুলোই কিন্তু নিরাপদ নয়!

রাতারাতি ওজন কমাবার চেষ্টা অনুচিত

কিটোসহ লো-কার্ব ডায়েটগুলোর দিকে মানুষের গণহারে ঝুঁকে পড়ার নেপথ্যে রয়েছে রাতারাতি ওজন কমানোর চিন্তা। এগুলো অনুসরণে দ্রুত ওজন কমতে দেখা যায় ঠিকই, তবে তা আপনার জন্যে যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হতে পারে। এমনকি এর খেসারত দিতে হতে পারে সুস্বাস্থ্যকে চিরতরে বিকিয়ে দেয়ার মাধ্যমে।

বারডেমের পুষ্টিবিদ শাহিদা করিম বলেন- হঠাৎ করে ওয়েট কমিয়ে ফেলা, হঠাৎ করে ওয়েট বাড়িয়ে দেয়া- এটা শরীরের জন্যে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ওজন কমাতে হবে ধীরে ধীরে, প্রসেসের মধ্য দিয়ে। কারণ ওয়েট কিন্তু একদিনে বাড়ে নি! তাই কমবেও একদিনে- এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।

কর্মসূচি গ্রহণ করুন সার্বিক দিক বিবেচনায়

ওজন কমানোর প্রথাগত প্রোগ্রামগুলোতে কেবল খাবার নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়া হয়। খাবার কিন্তু ওজন বাড়ার একমাত্র কারণ নয়! ভ্রান্ত জীবনাচারের কারণে কম খেয়েও ওজন বাড়তে পারে।

এ-ছাড়াও বেশি বেশি ফাস্টফুড খাওয়া, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, বংশগতি, থাইরয়েড গ্রন্থিতে সমস্যা, ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া, স্ট্রেস বিষন্নতা বা দুশ্চিন্তা, বিশেষ কোনো রোগ- এমন বহু কারণ থাকতে পারে ওজন বাড়ার নেপথ্যে। তাই ওজন কমানোর কর্মসূচি গ্রহণের পূর্বে ওজন বাড়ার প্রকৃত কারণটি শনাক্ত করা জরুরি।

ওজন কমানোর প্রোগ্রাম হতে হবে হোলিস্টিক, মানে সার্বিক দিক বিবেচনায়। লাইফস্টাইল পর্যালোচনা করে ঠিক করতে হবে কর্মপরিকল্পনা, যার মধ্যে থাকবে স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যাভ্যাস, সুস্থ জীবনাচার ও কায়িক পরিশ্রমনির্ভর জীবনযাপন।

যা খাবেন, যা খাবেন না

তৈলাক্ত-চর্বিদার খাবার, ফাস্টফুড-জাঙ্কফুড, ভাঁজা-পোড়া মশলাদার খাবার পরিহার করুন; কম খান ব্যাডকার্ব।

আসলে আমাদের শারীরিক বৈশিষ্টই এমন যে, আমরা মাংস খেতে পারবো কম, শাকসব্জি ফলমূল এবং হোল গ্রেইন খেতে পারবো ম্যাক্সিমাম। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, অনুপাত হওয়া উচিত- কার্বহাইড্রেট ৬০-৭০%, প্রোটিন ২০-৩০% এবং ফ্যাট ১০-২০%।

অবশ্য সব কার্বহাইড্রেটই যে ভাল, তা নয়। সাদা চাল, সাদা আটা, চিনি ইত্যাদি হলো ব্যাডকার্ব। এগুলো বর্জন করুন। ফল, সালাদ, সবজি, লাল চাল, লাল আটা হলো গুডকার্ব। এগুলো ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করে।

অন্যদিকে, প্রাণীজ আমিষ ও চর্বির চেয়ে ভালো হলো উদ্ভিজ্জ আমিষ ও চর্বি, যা আসতে পারে আলু মসুর ডাল মটরশুঁটি বাদাম স্পিরুলিনা মাশরুম শিম ব্রকলি থেকে। মাছ-মাংস কমিয়ে দৈনিক চাহিদার বেশিরভাগ পূরণ করুন এগুলো দিয়েই।

এ-বিষয়ে আরো পড়ুন :

কখন খাচ্ছেন, কতটা খাচ্ছেন- বিবেচ্য বিষয় এটাও!

খাওয়ার ভুল রুটিনের কারণে একই খাবার খেয়ে কারো ওজন কমতে পারে, আবার কারো বাড়তে পারে।

অনেকেই সকালে কোনোমতে নাস্তা করে অফিসের দিকে ছোটে। দুপুরে মোটামুটি খায়, কিন্তু পেটভরে খায় রাতে। অথচ হওয়া উচিত এর উল্টো!

ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে- Eat breakfast like a king, lunch like a prince, and dinner like a pauper! এর মর্মার্থ হলো- সকালে সবচেয়ে পুষ্টিকর খাবার, দুপুরে মোটামুটি এবং রাতে একেবারেই কম খেতে হবে।

আসলে খাবার গ্রহণের সাথে সাথেই সেটি হজম হয় না, বেশ কয়েক ঘন্টা সময় লাগে। তাই সকালের খাবারের ক্যালরি আপনার সারাদিনের শ্রমে ব্যয় হবে। কিন্তু রাতে যদি খেয়েই ঘুমাতে যান তাহলে সেই ক্যালরি বার্ন হওয়ার বদলে শরীরে জমে মেদে পরিণত হবে।

বদলাতে হবে লাইফস্টাইল

অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন থেকে বেরিয়ে আসুন; গড়ে তুলুন কিছু সুন্দর অভ্যাস। যেমন- ঘুমাতে যাওয়ার ২ ঘন্টার মধ্যে কিছু না খাওয়া, চেয়ারের পরিবর্তে দাঁড়িয়ে কাজ করা, বেশি রাত না জাগা, পর্যাপ্ত পানি পান, পর্যাপ্ত ঘুম, দুশ্চিন্তামুক্ত জীবনযাপন। দিনে ঘুমানোর অভ্যাস থাকলে তা বাদ দিন।

আর যথেষ্ট শারীরিক পরিশ্রম যেন হয় সেদিকে মনোযোগ দিন। প্রতিদিন অন্তত এক-দেড় ঘন্টা পরিশ্রম করুন। তবে ঢিমেতালে নয়, ঘাম ঝরিয়ে!

জোরে হাঁটতে পারেন, সাথে ১০/১৫ মিনিট জগিং। সেই সাথে প্রতিদিন আধঘন্টা ইয়োগা। বিশেষত বঙ্গাসন, হস্তপদাসন, জানুশিরাসন, উষ্ট্রাসন, উত্থিতপদাসন, পশ্চিমোত্তানাসন, অর্ধকূর্মাসন, হলাসন, রাত্রে ঘুমানোর আগে ১০/১৫ মিনিট বজ্রাসন - এই আসনগুলো করলে মেদ ও বাড়তি ওজন দুই-ই কমবে।

এ-বিষয়ে আরো পড়ুন :

মাঝেমধ্যে রোজা বা উপবাস করুন

ওজন কমানোর কার্যকরী একটি উপায় হলো ফাস্টিং বা উপবাস। ২০২০ সালে নিউ সায়েন্টিস্ট জার্নালে প্রকাশিত একটি রিভিউ আর্টিকেলে বলা হয়েছে, আমাদের শরীরের সৃষ্টি রহস্য এটাই নির্দেশ করছে যে, আমরা শুধু খেয়ে সুস্থ থাকতে পারবো না, মাঝেমধ্যে না খেয়ে সুস্থ থাকার চেষ্টাও করতে হবে।

আপনি যদি সেহরি ও ইফতারে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করেন এবং স্বাভাবিক কর্মব্যস্ততা বজায় রাখেন তাহলে রোজায় বাড়তি ওজন ও মেদ ঝরবে। পাশাপাশি দেহ হবে টক্সিনমুক্ত, ঝরঝরে।

এ-বিষয়ে আরো পড়ুন :

মনছবি ও অটোসাজেশনকে কাজে লাগান

সম্প্রতি সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এ প্রকাশিত একটি আর্টিকেলে বলা হয়েছে, বেশিরভাগ ডায়েট দীর্ঘমেয়াদে (২ বছরের বেশি) কাজ করে না। ফলে ওজনহ্রাসও টেকসই হয় না।

কারণ, আপনি যখন কঠোর ডায়েট শুরু করেন তখন আপনার ব্রেন ধরে নেয় এখন দুর্ভিক্ষ চলছে, খাবার নেই! ওজন কমার পর যখন আপনি পছন্দের খাবার একটু একটু খেতে শুরু করবেন তখন ভুল প্রোগ্রামের কারণে আপনার ব্রেন সেই খাবারকে ফ্যাট বানিয়ে ফেলবে, যাতে ভবিষ্যতে আবারো দুর্ভিক্ষ হলে সেটাকে কাজে লাগানো যায়। ফলশ্রুতিতে হারানো ওজন ফিরে আসবে দ্রুততার সাথে।

ওজন কমানোকে টেকসই করতে তাই ব্রেনকে মেসেজ দিতে হবে যে, ‘দুর্ভিক্ষের জন্যে না, আমি খাওয়া কমাচ্ছি সুস্বাস্থ্য ও সুন্দর ফিগারের জন্যে’। কাজটি আপনি সবচেয়ে কার্যকরভাবে করতে পারবেন ধ্যানের স্তরে অটোসাজেশন এবং মনছবির মাধ্যমে।

অটোসাজেশন হতে পারে- ‘যত লোভনীয় খাবারই সামনে আসুক, প্রয়োজন ছাড়া খাব না। যখন খুশি তখন খাব না’। পাশাপাশি করতে পারেন কাঙ্ক্ষিত ওজন ও ফিগারের মনছবি। ব্রেন একবার প্রোগ্রামড হয়ে গেলে আপনার শরীর অপ্রয়োজনীয় খাবারকে এমনিতেই বর্জন করবে। ওজন হ্রাসও হবে টেকসই।