ডায়াবেটিসকে এখন বলা হচ্ছে একবিংশ শতাব্দীর প্লেগ। এতে এখন ভুগছে দেশের প্রতি ১০ জনে একজন, মৃত্যুর ৭ম প্রধান কারক এটি।
ডায়াবেটিসের প্রধান কারণ ভুল জীবনধারা ও ভ্রান্ত জীবনদৃষ্টি; কাজেই সুস্থ ও পরিকল্পিত জীবনাচার গড়ে তুলতে পারলে ডায়াবেটিস প্রতিরোধই শুধু না, নিরাময়ও সম্ভব- লাইফস্টাইল এক্সপার্টরা এখন বলছেন এটা-ই।
এটি মূলত 'রক্তে অনিয়ন্ত্রিত সুগার লেভেল' হিসেবে চিহ্নিত একটি রোগ।
আমাদের শরীরের মূল জ্বালানি হচ্ছে গ্লুকোজ, যার উৎস শর্করা। শর্করা জাতীয় খাবার গ্রহণের পর হজম শেষে গ্লুকোজ ক্ষুদ্রান্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করে, যা আবার ইনসুলিনের সাহায্যে রক্ত থেকে কোষে যায় এবং বিপাকক্রিয়ায় অংশ নিয়ে শক্তি উৎপন্ন করে।
কিন্তু কোনো কারণে (যেমন- কোষে চর্বি জমলে) গ্লুকোজ রক্ত থেকে কোষের ভেতরে প্রবেশ করতে না পারলে তা রক্তে জমা হতে থাকে। ফলে রক্তের গ্লুকোজ লেভেল বেড়ে যায়। একপর্যায়ে এই বাড়তি গ্লুকোজ কিডনি প্রস্রাবের সাথে বের করে দেয়।
রক্তে অতিরিক্ত গ্লুকোজ, কিন্তু কোষের মধ্যে গ্লুকোজ স্বল্পতা, আর প্রস্রাবে গ্লুকোজের উপস্থিতি—এই অবস্থার নামই ডায়াবেটিস।
টাইপ-১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে প্যানক্রিয়াস বা অগ্ন্যাশয় থেকে কোনো ইনসুলিন তৈরি হয় না। টাইপ-২'র ক্ষেত্রে ইনসুলিন তৈরি হলেও শরীরে ইনসুলিন প্রতিরোধিতা (রেজিস্ট্যান্স) সৃষ্টির ফলে শরীর যথাযথভাবে ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না।
আমাদের রক্তে যে পরিমাণ সুগার বা চিনি থাকে তার পরিমাণ মাত্র এক চা চামচ। কিন্তু আমরা প্রতিদিন এর বহুগুণ চিনি গ্রহণ করি চা কফি কোমল পানীয় বা মিষ্টান্নের সাথে। টাইপ-২ ডায়াবেটিসের মূল কারণ এই চিনি।
উল্লেখ্য, আমাদের দেশে ৯৫ শতাংশ রোগী-ই টাইপ-২ ধরনের।
অতিরিক্ত তৈলাক্ত-চর্বিযুক্ত-কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার, রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট (চিনি, সাদা চাল ও সাদা আটা) ইত্যাদি বেশি খেলে টাইপ-২ ডায়াবেটিস হতে পারে।
শারীরিক পরিশ্রম কম করলে এবং ক্রমাগত মানসিক চাপ বা স্ট্রেসে ভুগলেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়।
আপনার জিনস প্যান্ট-ই বলবে আপনি ডায়াবেটিসের কতটা ঝুঁকিতে আছেন!
দ্য গার্ডিয়ানের লাইফস্টাইলে প্রকাশিত সেই গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি ২১ বছর বয়সে যে জিনস প্যান্টটি পরতেন, সেটি যদি এখনো পরতে পারেন তাহলে তার টাইপ-২ ডায়াবেটিস হওয়ার আশঙ্কা কম। উল্টোভাবে বললে, এই আশঙ্কা বেড়ে যাবে যদি তিনি সেটাতে ফিট না হন।
রহস্যটা হলো, তারুণ্যে পরা প্যান্টটি কেউ এখন পরতে পারছেন না, কারণ তিনি স্থূলকায় হয়ে গেছেন, তার ওজন এখন আগের চেয়ে বেশি। আর এই মেদস্থূলতা ও বাড়তি ওজন টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম প্রধান কারণ।
এই লক্ষণগুলো থাকলে দেরি না করে ডায়াবেটিস পরীক্ষা করুন। অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে ঘটনাচক্রে, অন্য কোনো রোগের চিকিৎসায় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকালে।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি ড. এ কে আজাদ খানের মতে, টাইপ-২ ধরনের ক্ষেত্রে আগাম সতর্কতা অবলম্বন করলে ৭০ ভাগ ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ঠেকিয়ে রাখা বা বিলম্বিত করা সম্ভব। এ-জন্যে তার পরামর্শ হলো খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা।
যাদের বাবা-মা বা পরিবারের অন্য সদস্যদের ডায়াবেটিস আছে তাদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকলেও আগে থেকেই নিয়মিত হাঁটাচলা ও শারীরিক পরিশ্রম করলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেন।
এজন্যে প্রতিদিন নিয়ম করে অন্তত একঘণ্টা হাঁটুন। পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম, বিশেষত ইয়োগা। দৈনন্দিন জীবনেও লিফট, এসকেলেটর, যানবাহনের ব্যবহার কমিয়ে কায়িক পরিশ্রমকে অগ্রাধিকার দিন।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহণ করুন, নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমান ও ঘুম থেকে উঠুন; মিষ্টিজাতীয় খাবার, ফাস্টফুড, কোমল পানীয়, রিচফুড যথাসম্ভব বর্জন করুন। ধূমপান ও মদ্যপানকে বিষপানের মতো এড়িয়ে চলুন।
যথাযথ সতর্কতা পালনে আপনি সহজেই ডায়াবেটিসকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন।
বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মহাসচিব মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বলেন, কারো ডায়াবেটিস হলে তার জীবনযাপনে অবশ্যই পরিবর্তন আনতে হবে। যারা যত বেশি শারীরিক পরিশ্রম করেন, প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার কদম হাঁটেন, তাহলে ডায়াবেটিস হলেও সেটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে।
লাইফস্টাইল বদলে ডায়াবেটিস নিরাময় করা যায়—এই বিষয়ে প্রথম গবেষণা করেন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির মেডিসিন বিভাগের এসোসিয়েট প্রফেসর ডা. নিল বার্নার্ড ও তার টিম। রোগীর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনাচারে পরিবর্তন এনে তারা ডায়াবেটিস নিরাময় করতে সক্ষম হন।
এ-ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ হলো- কমপক্ষে ১ বছর বর্জন করতে হবে মাছ মাংস ডিম দুধ তেল ঘি মাখন ডালডা, তৈলাক্ত ও চর্বিযুক্ত খাবার, প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার।
প্রতিদিন খেতে হবে অল্প পরিমাণে পূর্ণ শস্যদানা (হোল গ্রেইন) যেমন- লাল চালের ভাত বা লাল আটার রুটি, এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে শাকসবজি, সালাদ ও সবুজ পাতা। আর দৈনিক অন্তত ৪ ধরনের টক ও কম মিষ্টি ফল।
প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় আরো থাকবে- সকালে ১ গ্লাস করে কাঁচা করলার জুস, মেথি ভেজানো পানি ও ঢেঁড়স ভিজানো পানি এবং রাতে ৩ চা চামচ অ্যাপল সাইডার ভিনেগার। আর সারাদিনে ১ কাপ হার্বাল চা ও ৩-৪ কাপ গ্রিন টি।
সেই সাথে দৈনিক একঘণ্টা ব্যায়াম, দুই বেলা মেডিটেশন, ৩/৫ দফা প্রাণায়াম এবং সপ্তাহে দুই থেকে তিন দিন রোজা/উপবাস/ফাস্টিং।
আরো পড়ুন:-