চিনি : সাদা বিষ

published : ৩ আগস্ট ২০১৯

চিনি। আমাদের অনেকেরই পছন্দের খাবার। নিজেরা তো খাচ্ছিই, অম্লান বদনে তুলে দিচ্ছি বাড়ির ছোট্ট শিশুটির মুখে। কিন্তু চিনি খেয়ে শরীরের কী সর্বনাশ ঘটাচ্ছেন আপনি, তা যদি জানতেন, তাহলে খাবার না, বিষ বলে ছুঁড়ে ফেলে দিতেন ‘হোয়াইট পয়জন’ নামের এই চিনিকে।

বুড়িয়ে যাওয়া

চিনি খেলে আপনার ত্বকে ভাঁজ পড়ে এবং চেহারা বুড়িয়ে যায়। নেদারল্যান্ডের লাইডেন ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক ৫০ থেকে ৬০ বছর বয়সী ছয়শ’ মানুষের ব্লাড সুগার মাপার পর এদের ছবি দেখতে দেন ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে। স্বেচ্ছাসেবীরা এমন প্রতিটি মানুষকে বেশি বুড়োটে দেখাচ্ছে বলে মন্তব্য করে, যাদের রক্তে চিনি বেশি পেয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। বলা হয়, রক্তে প্রতি ১ মিলিলিটার বেশি চিনি থাকা মানে আপনি আপনার বয়সের চেয়ে ৫ মাস বেশি বুড়ো হয়েছেন!

ব্রণ

মুখের ব্রণের সাথে চিনির খুবই ভালো যোগ। চিনিযুক্ত খাবার যত খাবেন, তত চেহারা ও শরীরে ব্রণ-একনের সমস্যা বাড়বে। বিশ্বাস না হলে পরীক্ষা করে দেখতে পারেন!

ডায়াবেটিস

চিনির ক্ষতি হিসেবে সম্ভবত এ রোগটাই সবচেয়ে পরিচিত। নয় লক্ষ এক হাজার দুইশ’ উনপঞ্চাশ জন মহিলার ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে- যে মহিলারা প্রতিদিন এক গ্লাস করে মিষ্টিজাতীয় পানীয় খান, তাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি, যারা মাসে মাত্র একবার খান, তাদের চেয়ে ৮৩ ভাগ বেশি।

ক্যান্সার

চিনিজাতীয় খাবার নিয়মিত খেলে ক্যান্সার হবার ঝুঁকি বাড়ে। বিশেষ করে, ব্রেস্ট ও কোলন ক্যান্সার। আর এটা এজন্যে হয় যে, চিনি শরীরে ইনসুলিনের উৎপাদন বাড়ায়। এদিকে কোষ বিভাজনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হলো ইনসুলিন। আর আমরা জানি, কোষ বিভাজনের এক অস্বাভাবিক সহজাতই হলো ক্যান্সার।

ফ্যাটি লিভার

লিভারের একটি কাজ হলো-চিনিকে ফ্যাটে পরিণত করে জমিয়ে রাখা। বেশি চিনি খাওয়া মানে বেশি চর্বি জমা। এ অবস্থাকেই বলে ফ্যাটি লিভার। আর বুঝতেই পারছেন, তখন লিভার আপনার শরীরের যেসব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করে, সেগুলো ব্যহত হয়।

দাঁতের ক্ষয়

চিনি খেলে দাঁত নষ্ট হয়। আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকেল নিউট্রিশনের এক গবেষণায় দেখা যায় যে, বেশি বেশি চিনি খেলে মুখের উপকারি ব্যাকটেরিয়াগুলো মরে যায়। ফলে দাঁতের ক্ষয় হয় এবং কমে যায় দাঁতের ঔজ্জ্বল্য।

নেই কোনো পুষ্টি

চিনি এমন একটি খাবার যার কোনো পুষ্টিগুণ নেই। না মিনারেল, না প্রোটিন, না ফাইবার- কিছুই নেই চিনিতে। ফলে চিনিজাতীয় খাবার খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখবেন, আপনার খিদে পেয়েছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এ নিয়ে এক গবেষণা করেছিল। তারা দেখেছে, চিনিজাতীয় খাবার যারা বেশি খায়, তাদের খিদে বেশি এবং খাওয়ার পরিমাণও বেশি।

কমে কর্মোদ্যম

চিনি শরীরের লেপটিন নামের একটি হরমোনকে বাধাগ্রস্ত করে। লেপটিন হচ্ছে সেই হরমোন যা খাওয়ার সময় আমাদের জানান দেয় যে, “পেট ভরে গেছে। আর খাওয়ার দরকার নেই।” সেইসাথে বলে যে, “এবার এই শক্তিকে খরচ কর, কাজে নেমে পড়”। কিন্তু বেশি বেশি চিনি খেলে এই হরমোনটি কমে যায়। ফলে আপনার কর্মোদ্যম কমে, আর শরীরে জমে চর্বি।

পেটের চর্বি

পেটের চর্বি বাড়ে চিনিতে। আর ডাক্তারদের মতে, এই চর্বিটিই হলো দেহের সবচেয়ে ক্ষতিকর চর্বি। কারণ এ থেকেই বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি হৃদরোগ থেকে শুরু করে বড় বড় রোগগুলো হয়। শুধু কি শরীরেই শেষ?

অবসাদ-বিষণ্নতা

আপনার মনের ওপরও কিন্তু চিনির প্রভাব কম নয়! রক্তের কোষে ব্লাড সুগার জমতে থাকলে ব্রেনে ডোপামিন ও ওপিএম এর পরিমাণ কমে যায়, ফলে অবসাদ ও বিষণ্নতা এসে ভর করে।

আসক্তি

কিন্তু এতকিছু জানার পরও চিনি খাওয়া আপনি কমাতে পারেন না কেন জানেন? কারণ চিনি আসক্তি সৃষ্টি করে এবং তা মাদকের মতোই! বিজ্ঞানীরা চিনির ফলে একই ধরনের ডোপামিন নিঃসরণ হতে দেখেছেন ব্রেনে, যা ঘটে কোকেন গ্রহণের সময়ও! নিওরোপ্লাস্টিসিটি গবেষণার এটা সাম্প্রতিক আবিষ্কার যে, মাদকাসক্তদের আচরণের সাথে চিনি-আসক্তদের আচরণের অনেক মিল! আপনি দেখবেন, যারা বেশি চিনি খায়, সময় যাওয়ার সাথে সাথে তাদের খাওয়ার পরিমাণও বাড়তে থাকে।

প্রতিকার-

তাহলে মুক্তি কীভাবে? প্রথমেই ভেবে দেখুন, র’ সুগার বা কাঁচা চিনি আপনি কতটা খান? কখন খান? কোন কোন খাবারের সাথে খান?

সেটা কি চা-য়ে? যদি চা হয়, তাহলে ঠিক করুন, এখন থেকে আর চায়ে কোনো চিনি খাবেন না। এজন্যে ‘গ্রিন টি’ খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। চায়ের মধ্যে সবচেয়ে উপকারি চা হওয়া ছাড়াও গ্রিন টি খাওয়া যায় চিনি ছাড়াই।

এরপর দেখুন বাইরে গেলে কী কী খাবার আপনি খান যাতে চিনি থাকে। রেস্তোরাঁ বা ফাস্ট ফুড শপে আমরা অনেকেই কফি, আইস টি খেতে যাই। আপনি কি জানেন, একমগ ফ্লেভারড কফি ড্রিংকে ৮ চামচ পর্যন্ত চিনি থাকতে পারে! বা নিরীহ দেখতে আইস টি! থাকতে পারে ৫ চামচ চিনি!

আবার লো-ফ্যাট বা সুগার ফ্রির নামে বাজারে যেসব তথাকথিত ‘স্বাস্থ্যকর’ খাবার পাওয়া যায়, তা আসলেই কতটা স্বাস্থ্যকর তা বুঝে নিতে হবে আপনাকেই। আপনি কি জানেন, লো ফ্যাট ইয়োগার্ট নামে বাজারে যে দই পাওয়া যায় তার আড়াই শ মিলিলিটারের একটা কাপেই থাকতে পারে ১০ চামচ চিনি! অতএব বর্জন করুন এসব খাবার।

তাজা ফল খেতে পারেন। ফলে যে চিনি থাকে, তা দেহের জন্যে ক্ষতিকর তো নয়ই, বরং উপকারি। তবে ফলের নামে বোতলজাত ‘ফ্রুট জুস’ খেতে যাবেন না। ওটা একইরকম ক্ষতিকর।

মিষ্টি, রসগোল্লা ইত্যাদি পুরোপুরি বর্জন করুন। বিয়ে, উৎসব বা অন্যান্য উপলক্ষে মিষ্টির পরিবর্তে খেজুর খাওয়ার প্রচলন করুন।

চিনি বর্জনের এই উদ্যোগ প্রথম আপনি নিজে নিন। কাঁচা চিনি থেকে শুরু করে চিনি মেশানো সবরকম খাবার-পানীয় থেকে ধীরে ধীরে সরে আসুন। এরপর পর্যায়ক্রমে বলুন পরিজন, পরিচিত, বন্ধুদের। দেখবেন একসময় সমাজের বেশিরভাগ মানুষ চিনি খাওয়ার চেয়ে না খাওয়াতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে। বর্জন করছে সবাই শরীরের জন্যে অতি ক্ষতিকর এই সাদা বিষ!