রমজান মাস এলেই পুরান ঢাকার ইফতার বাজারে শোনা যায় বিক্রেতাদের এই হাঁকডাক। সুতি কাবাব, শামি কাবাব, জালি কাবাব, হালিম, চপ, টিক্কা, জিলাপির জন্যে ভোজনরসিকেরা অপেক্ষায় থাকেন বছরজুড়ে। আর ইফতার পার্টির আদলে সেহরি পার্টিও জোরেশোরে চলছে গেল কয় বছর ধরে।
তবে স্ট্যাটাস সিম্বল আর ফুড ভ্লগিংয়ের খোরাক জোগাতে ইফতার ও সেহরিতে খাওয়া ‘মুখরোচক’ এই খাবারগুলো যে শারীরিক ফিটনেসের বারোটা বাজায় তা কি আপনি জানেন?
যে এনজাইমগুলো খাবার হজমে সহায়তা করে উপবাসকালে সেগুলোর উৎপাদন বন্ধ থাকে। পাকস্থলীর ভিতরের মিউকাস আবরণও এসময় সংকুচিত থাকে। ফলে সারাদিনের উপবাস শেষে পেঁয়াজু, বেগুনি, চপ, কাবাব, হালিম, বিরিয়ানির মতো ভাজাপোড়া, তৈলাক্ত ও গুরুপাক খাবার খেলে হতে পারে পেট ও বুক জ্বালাপোড়া, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা, আলসারের মতো অসুস্থতা।
এ-ছাড়াও তেলেভাজা খাবারে থাকে ট্রান্সফ্যাট নামক ক্ষতিকর চর্বি। জানলে অবাক হবেন, মাত্র ২ শতাংশ ট্রান্সফ্যাট হার্টের ২৩ শতাংশ ক্ষতি করতে সক্ষম!
যা শরীরে ফ্রি রেডিকেলের পরিমাণ বাড়ায়। বিভিন্ন প্রদাহ, এমনকি ক্যানসারেরও কারণ হতে পারে এই ফ্রি রেডিকেল।
শুধু তাই নয়, পোড়া তেল শরীরে খারাপ কোলেস্টেরলের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের ধমনীতে ব্লক সৃষ্টি করে। এতে দেখা দিতে পারে অ্যাসিডিটি, হার্টের অসুখ, লিভারের সমস্যা, আলঝেইমার, পার্কিনসন্সসহ নানা দীর্ঘমেয়াদী রোগ।
বারবার পোড়ালে তেলে জমে এইচএনই নামক বিষাক্ত উপাদান। এটি এতটাই মারাত্মক যে তা কোষের ডিএনএ, আরএনএ-র গঠন পর্যন্ত বদলে দিতে পারে!
শরবত, ফ্রুট জুস, লাচ্ছি, জিলাপি, বুন্দিয়া ছাড়া ইফতার যেন জমেই না! এই চিনিযুক্ত খাবারগুলোর হাত ধরে রক্তে প্রবেশ করে উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ। এই গ্লুকোজ স্পাইক, মানে হঠাৎ উচ্চমাত্রার গ্লুকোজ বৃদ্ধি ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা হ্রাস করে বাড়ায় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
রিফাইনড চিনিতে ফ্রুকটোজের পরিমাণ বেশি থাকে। লিভারে গিয়ে এই ফ্রুকটোজ চর্বিতে পরিণত হয়। তাই বেশি চিনি খেলে লিভারের কর্মক্ষমতা কমে যায়।
শরীরে ক্ষুধার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে লেপটিন নামক একটি হরমোন। অতিরিক্ত চিনি খেলে শরীরে লেপটিন রেজিস্টেন্স তৈরি হয়। ফলে পেট পুরে খাওয়ার পরও চোখের ক্ষুধা রয়েই যায়। তৈরি হয় স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি খাওয়ার প্রবণতা।
একারণেই রমজানে ওজন বাড়ে অধিকাংশেরই, যদিও হওয়া উচিৎ ছিল উল্টো।
গ্রীষ্মকালীন রমজানে ইফতারে ঠান্ডা কোমল পানীয় অনেকেরই তৃষ্ণা মেটানোর প্রথম পছন্দ। তথাকথিত এই কোমল পানীয় দাঁত, হাড়, পেশি, লিভারের নানা জটিল রোগের কারণ।
কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত হয় টারট্রাজিন, সানসেট ইয়োলোসহ বিভিন্ন কৃত্রিম রঙ। টারট্রাজিন পুরুষের প্রজনন ক্ষমতা নষ্ট করে, বাড়ায় শিশুদের হাইপারএক্টিভিটি। আর সানসেট ইয়োলো ঘটায় এলার্জির উদ্রেক।
ঠান্ডায় জমে যাওয়া এড়াতে কোমল পানীয়তে ব্যবহৃত হয় ইথিলিন গ্লাইকল। আর্সেনিকের মতই বিষাক্ত এই পদার্থ মানবদেহে নীরব বিষক্রিয়া ঘটায়। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্র, হৃৎপিন্ড, লিভার, কিডনির জটিলতা এমনকি দীর্ঘমেয়াদে কিডনি বৈকল্য পর্যন্ত ঘটাতে পারে এই উপাদান।
ইফতারে নানা বাহারি ও মুখরোচক পদ থাকলে খাওয়ার পরিমাণ বেড়ে যাবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সারাদিন খাদ্যঘাটতিতে থাকার পর হুট করে প্রচুর পরিমাণ খাবার শরীরে প্রবেশ করলে তা ঘটাতে পারে মারাত্মক পরিণতি।
হঠাৎ বেশি খেলে পাকস্থলীর ওপর অনেক চাপ পড়ে। হজমকে ত্বরান্বিত করতে শরীরের বিভিন্ন অর্গান থেকে রক্ত পাকস্থলীতে চলে আসায় হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়। এতে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি বেড়ে যায় চারগুণ!
ইফতারে তিন/চারটি খেজুর ও পানিই যথেষ্ট শরীরের এনার্জি লেভেল বাড়াতে। আর সেহরিতে অল্প সবজি, সামান্য ভাত বা রুটি এবং একটু ফল দিনভর শরীরকে রাখবে ঝরঝরে।
রাতে খেতে পারেন একটু বেশি। এসময় খান ফল, খেজুর, ডাবের পানি, টক দই, লেবুপানি, শাকসবজি, দুধ, সয়াদুধ, মুরগির মাংস, সামুদ্রিক মাছ।
রোজার তিরিশটি দিন এভাবে খাদ্যাভ্যাস গড়েই দেখুন কতটা সতেজ আর প্রাণবন্ত থাকেন আপনি!