রমজানে অভ্যস্ত হোন বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাসে—সুস্থ থাকুন সারা বছর

‘রমজানে খাবারের কোনো হিসাব দিতে হবে না’—ভ্রান্ত এই ধারণাটি আমাদের মাঝে কীভাবে এলো, তার হদিস পাওয়া যায় নি বটে, কিন্তু এর সূত্র ধরেই রমজান পরিণত হয়েছে খাদ্য উৎসবের মাসে। রমজান এলেই রাস্তা-ঘাটে, পত্র-পত্রিকায়, সোশাল মিডিয়ায় দেখা যায় খাবারের বাহারি বিজ্ঞাপন।

এসময় শাহী ইফতার, ইফতারে অভিজাত, ইফতার মেলা, এমনকি ভোররাতে সেহরি পার্টির নামে চলে বেনিয়াদের জমজমাট ব্যবসা। এটা শুধু আমাদের দেশেই নয়, রমজান জুড়ে ইসলাম ধর্মাবলম্বী সব দেশের মোটামুটি একই চিত্র।

অথচ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে রমজান হলো খাদ্য সংযমের মাস, পরিমিতিবোধের মাস, সর্বোপরি আত্মিক উপলব্ধির মাস। এ মাসে সঠিক জীবনাচার অনুসরণ করে আমরা হয়ে উঠতে পারি শারীরিক ও মানসিকভাবে আরো সুস্থ ও উদ্যমী, যার কল্যাণকর প্রভাব বহমান থাকবে সারাবছর।

ইফতারে স্রেফ খেজুর পানি ॥ পাবেন তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি

ইফতার করুন শুধু খেজুর পানি দিয়ে। সারাদিন কিছু খাওয়া হয় নি ভেবে এসময় খাবারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বেন না। খেজুর ও পানির মিশ্রণে সুক্রোজ তৈরি হয়, যা শরীরে তাৎক্ষণিক প্রাণশক্তি এনে দেয়।

হযরত আনাস (রা) বলেন, ‘রসুলুল্লাহ (স) কয়েকটি তাজা খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন। তাজা খেজুর না পেলে শুকনো খেজুর খেতেন। তাজা বা শুকনো খেজুরের কোনোটাই না থাকলে কয়েক ঢোক পানি পান করতেন।’ (আবু দাউদ)

প্রয়োজন নেই বাড়তি চিনি বা শরবতের

জার্মানির ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরি অব মিউনিখ ২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭-তে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, প্রতি বছর রমজান মাসে মুসলিম দেশগুলোতে চিনির চাহিদা অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যায়। সেইসাথে বৃদ্ধি পায় চিনির মূল্যও। যার অন্যতম কারণ হলো, রমজানে চিনি দেয়া শরবত এবং মিষ্টি জাতীয় খাদ্যের চাহিদা।

বৈজ্ঞানিক গবেষণা বলছে, চিনি দেয়া শরবত, অতিরিক্ত মিষ্টি দেয়া খাবার শরীরের জন্যে ক্ষতিকর। প্যাকেটজাত জুসও পরিহার করুন। কারণ এতে থাকে নানাবিধ ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান। এসবের চেয়ে দেশীয় মৌসুমি ফল খাওয়াই শ্রেয়।

রমজানে ওজন বৃদ্ধি বা পেটের পীড়া ॥ ভুল খাদ্যাভ্যাসই অন্যতম কারণ

বিস্ময়কর হলেও সত্য, রমজানে পুরো মাস রোজা রাখার পরও অনেকের ওজন বেড়ে যায়। এ নিয়ে সিএনএন একটি প্রতিবেদন (২৩ নভেম্বর, ২০০৩) প্রকাশ করে। এতে উদাহরণ হিসেবে তিউনিসিয়ার নাগরিকদের নিয়ে দেশটির সরকার কর্তৃক পরিচালিত একটি স্বাস্থ্য-জরিপ দেখানো হয়। জরিপের মূল বিষয় ছিল রমজানের খাদ্যাভ্যাস এবং নাগরিকদের ওজন-বিষয়ক পর্যালোচনা।

জরিপে পাওয়া যায়, রমজান শেষে ওজন বৃদ্ধির হার মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫৯ শতাংশ এবং পুরুষদের ৩৫ শতাংশ। কারণ হিসেবে স্বাস্থ্য গবেষকরা বলেন, অন্যান্য মাসের তুলনায় এ মাসে দেশটিতে গড় খাদ্য গ্রহণের পরিমাণ ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।

শুধু যে ওজন বৃদ্ধি তা নয়, অতিভোজনের ফলে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এমন খবরও পাওয়া যায় প্রতিবছর। ২০১৩ সালে কাতারে রমজানে প্রতিদিন গড়ে ১৫ জন করে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এর কারণ ইফতারে ও সেহরিতে অতিভোজন এবং হজমে গণ্ডগোল।

পরবর্তীতে একই সমস্যায় দুবাই নগরীতেও অনেকে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাই ২০১৭-তে সেখানকার চিকিৎসকরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে অতিভোজন এবং রোজা রেখে অস্বাস্থ্যকর খাবার না খাওয়ার পরামর্শ দেন।

রাতের খাবার ও সেহরি হোক স্বাস্থ্যসম্মত

মাগরিবের নামাজ শেষ করে খেয়ে নিন রাতের খাবার-ভাত, শাকসবজি, মাছ/ মাংস/ ডিম, ডালসহ অন্যান্য সুষম খাবার। ভাজা-পোড়া, তেল-মশলা দেয়া গুরুপাক খাবার পুরোপুরি বর্জন করুন।

রোজা রাখলে মূলত তৃষ্ণাটাই বেশি পায়। সেহরিতে বেশি খেলে বা প্রোটিন জাতীয় খাবার বেশি খেলে তৃষ্ণা আরো বেড়ে যায়। কারণ প্রোটিন জাতীয় খাদ্য হজমের জন্যে দেহে পানির প্রয়োজন বেশি হয়।

অন্যদিকে ভাত-সবজি সহজে হজম হয়, শরীরে পানির ঘাটতিও কম দেখা দেয়। ঝরঝরে অনুভূতি নিয়ে দিনের কাজে ও ইবাদতে মনোযোগ দেয়া সহজ হয়। কখনো ভাত-সবজির বদলে কলা-খেজুর বা দই-চিড়া খাওয়া যেতে পারে। এগুলোও সেহরিতে সমান উপাদেয়।

একমাসের সংযম ॥ সারা বছরের সুস্থতা

সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানের অধ্যাপক ভল্টার ল্যাংগো ২০ বছরেরও বেশি সময় মানুষসহ নানা প্রাণীর আয়ুষ্কাল এবং উপবাস থাকার ফলে শারীরিক প্রভাব নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি বলেন, সুস্থতার জন্যে আমাদের উপবাস থাকার চর্চা করা উচিত, যা বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে।

সম্প্রতি তার গবেষণায় উঠে এসেছে, রোজা বা উপবাস মানবদেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করছে। কয়েকজন ক্যান্সার রোগীর ওপর গবেষণা চালিয়ে তিনি দেখেন, তিন থেকে পাঁচ দিন উপবাস-চর্চায় তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ছে। কেমোথেরাপির পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রেও এ চর্চার ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে।

অনাহারে থাকার ফলে দেহে সাময়িক শক্তি-সংকট দেখা দেয়, যা মস্তিষ্কের কোষগুলোতে উপকারী প্রোটিন- নিউরোট্রফিক ফ্যাক্টর উৎপাদনে উৎসাহ যোগায়। ফলে মস্তিষ্ক আগের চেয়ে কর্মক্ষম হয়ে ওঠে। এ-ছাড়াও আমাদের দেহ-কোষের অভ্যন্তরে অপ্রয়োজনীয় অনেক গ্লুকোজ এবং ফ্যাট-কণা জমে থাকে, যা পরবর্তীতে টক্সিন বা বিষাণুতে রূপ নেয়। অনাহারের ফলে এসব টক্সিনের বিনাশ ঘটে। ফলে মস্তিষ্কসহ দেহের কোষগুলো উজ্জীবিত হয়, যার অনুরণন বিদ্যমান থাকে সারা বছর।

সারাদিন ইফতার তৈরিতে নয়, ইবাদতে মনোযোগী হোন

আমাদের দেশে অনেক পরিবারে দেখা যায়, রমজানে গৃহিণীরা প্রতিদিনই ব্যস্ত হয়ে পড়েন ইফতারের জন্যে মুখরোচক নানা খাবার তৈরিতে। কখনো কখনো এ ব্যস্ততা চলে মাগরিবের আজান অবধি। অথচ হরেক রকম খাবারে টেবিল সাজানোর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবারের সবাই একসাথে বসে ইফতার করা। আনুষঙ্গিক ইবাদত এবং নিজের ও অন্যের কল্যাণে দোয়া করার জন্যে ইফতারের আগের সময়টুকুর মহিমা অনেক।

ফেসবুকে প্রদর্শনী নয়, খাবার খান শুকরিয়ার সাথে

ইফতার পার্টি বা সেহরি পার্টি নামক নতুন হুজুগ আর খাবারের সাথে সেলফি বা খাবারের ছবি তুলে ফেসবুকে দেয়া এখন সাধারণ ঘটনা। দেখে মনে হয় যেন খাবারের প্রতিযোগিতা চলছে। এতে ধর্মীয় অনুষঙ্গগুলোর মর্যাদা যেমন ক্ষুণ্ণ হচ্ছে, তেমনি রমজানকে কেন্দ্র করে মুনাফালোভীরা ব্যবসা করে চলেছে জমজমাট। প্রদর্শনীর এ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। আয়োজন যেমনই হোক, খাবার গ্রহণ করুন শুকরিয়ার সাথে।

বৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হোন ॥ অর্জিত হোক রমজানের মূল লক্ষ্য

সংযমের মাস রমজান আমাদের জন্যে যেমন সুস্থতা ও কর্মোদ্যমের সুযোগ নিয়ে আসে, তেমনি খাবার যে স্রষ্টার কত বড় নেয়ামত এ সম্পর্কেও দৃষ্টিভঙ্গি পরিষ্কার হয়। উপলব্ধি করা যায় অনাহারে-অর্ধাহারে থাকা মানুষের যন্ত্রণা। তাই খাদ্যাভ্যাস-সহ রমজানের জীবনাচার যেন আমাদের মধ্যে মানবিকতার বিকাশ ঘটায়।

বিজ্ঞাপন ও হাল-ফ্যাশনে প্রভাবিত হয়ে নয়, বরং ধর্মের মূল শিক্ষা ও বিজ্ঞানের আলোকে পালন করুন এবারের রমজান। নিশ্চিত করুন আপনার এবং আপনার পরিবারের শারীরিক, মানসিক ও আত্মিক সুস্থতা।

তথ্যসূত্র : দ্য গার্ডিয়ান, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৭; দ্য টেলিগ্রাফ, ৫ জুন ২০১৪; হাফিংটন পোস্ট, ৭ নভেম্বর ২০১৩