published : ১১ জুন ২০১৬
ইসলামের যে নির্দেশনাগুলো শত শত বছর ধরে প্রতিপালিত হতে হতে একসময় সংস্কৃতিরও অংশ হয়ে গেছে, রোজা তার একটি। তবে সংস্কৃতিকরণের এই প্রক্রিয়ায় মাঝে মাঝে ঢুকে গেছে নানারকম অবিদ্যা বা ভুল ধারণা ও দৃষ্টিভঙ্গি। ধর্মের মূল নির্যাস থেকে যেমন তা সরে গেছে, তেমনি আচারসর্বস্ব এই চর্চার ফলে মানুষ বঞ্চিত হচ্ছে রোজার শারীরিক মানসিক, আত্মিক উপকার থেকে। তেমনি কিছু ভুল ধারণা নিয়েই এ সংকলন-
সাধারণ একটি ধারণা হলো রোজা শরীরকে দুর্বল করে দেয়। দীর্ঘসময় না খেয়ে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন, এই ভয়ে কেউ কেউ রোজা রাখেন না, বিশেষ করে যারা নিজেদেরকে মনে করেন- শারীরিকভাবে দুর্বল। অনেকে হয়তো রমজানের প্রথম কয়েকদিন রাখেন। পরের দিকে আর রাখেন না। বিরতি দিয়ে দিয়ে রোজা রাখার প্রবণতাও আছে কারো কারো।
অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে, রোজা এনার্জি লেভেলকে বাড়িয়ে দেয়। বরং এই যে সবসময় খাওয়া-দাওয়ার মধ্যে থাকা- বিজ্ঞানীরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে নিজের অজান্তেই আপনি আপনার দেহকে ঠেলে দিচ্ছেন ভয়ঙ্কর কিছু শারীরিক ঝুঁকির দিকে! ব্যাপারটা একটু বুঝিয়ে বলা যাক।
আমাদের দেহে আইজিএফ-১ হরমোন নামে এক ধরনের গ্রোথ হরমোন আছে যার কাজ হচ্ছে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কোষ তৈরি করে দেহকে বাড়ন্ত রাখা। এসময় পুরনো কোষের মেরামত বা ক্ষয়পূরণের চেয়ে নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়াই বেশি সক্রিয় থাকে।
আপনি যত বেশি খাবেন, বিশেষত প্রোটিন জাতীয় খাবার, তত বেশি আপনার দেহ আইজিএফ-১ তৈরি করবে। সবসময় যখন এমন একটা অবস্থা থাকে, অর্থাৎ কোনো বিরতি বা বিশ্রাম ছাড়া প্রতিনিয়ত নতুন কোষ তৈরির প্রক্রিয়া- এই সুযোগেই দেহে বাসা বাঁধে ডায়াবেটিস বা ক্যান্সারের মতো মারণব্যাধিগুলো। কয়েক ধরনের ক্যান্সার, যেমন, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং কোলন ক্যান্সারের সাথে বিজ্ঞানীরা উচ্চমাত্রার আইজিএফ-১ এর যোগসূত্র খুঁজে পেয়েছেন।
বিজ্ঞানীরা বলেন, এই অবস্থাকে পাল্টে দিতেই তাই মাঝে মাঝে খাবার থেকে দেহকে অব্যাহতি দেয়া দরকার। একটা পরীক্ষায় দেখা গেছে, ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রায় দেহে আইজিএফ-১ হরমোন আছে, এমন একজন মানুষ মাত্র তিন দিন উপবাস করে তা নামিয়ে ফেলেছেন অর্ধেকে! ডাক্তাররা তাকে সতর্ক করে বলেছিলেন, প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা তার প্রবল। কিন্তু আইজিএফ-এর মাত্রা কমে যাওয়ায়, এখন কমে গেল সে ঝুঁকিও।
আর রোজা রাখলে যে প্রাণশক্তি বাড়ে তা আরো পরিষ্কার হয়েছে ২০১৬ সালে চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইয়োশিনারি ওশুমির নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তির পর। কারণ জাপানি এই বিজ্ঞানী 'অটোফেজি' নামক দেহের এক প্রাকৃতিক সুস্থতা প্রক্রিয়া নিয়ে গবেষণা করেন যা উদ্দীপ্ত হয় দেহের পানাহার বর্জিত অবস্থায়। অটোফেজি তখন কোষের ভাঙাচোরা অংশ, আবর্জনা ইত্যাদিকে রিসাইক্লিং করে দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি জোগায়। কাজেই রোজা দেহকে দুর্বল তো করেই না, বরং আরো প্রাণবন্ত করে।
আমরা কেউ কেউ মনে করি, এত বড় একটা দিন রোজা রাখতে হবে! যত বেশি খেয়ে নেয়া যায়, তত ভালো! ফলে সেহরিতে রাখি ভূরিভোজের ব্যবস্থা – গরুর গোশত, মাছ, মুরগি, ভাত-সবজি, দুধ, ফল, চা-কফি, ডেজার্ট ইত্যাদি দিয়ে এলাহি কাণ্ড। অথচ সুস্থ রোজার চর্চায় এর চেয়ে ভ্রান্তির আর কিছু নেই।
প্রথমত, রোজা রেখে আপনি পানি খেতে পারছেন না। আর প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রক্রিয়াজাত করতে দেহে লাগে প্রচুর পানি। ফলে সেহরিতে এসব খাবার যত বেশি খাবেন, আপনার তৃষ্ণা পাবে বেশি, অস্বস্তিবোধ হবে বেশি।
দ্বিতীয়ত, সুস্থ থাকার সাথে আসলে বেশি খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। ১০৫ বছর বয়সী ফৌজা সিং। সবচেয়ে বেশি বয়সী ম্যারাথন দৌড়বিদ হিসেবে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী। ২০১৩ সালে অবসর নেয়ার আগে হংকংয়ের যে ম্যারাথন প্রতিযোগিতায় শেষবারের মতো ফৌজা সিং অংশ নেন, সেখানে ১০ কিমি দৌড়েছেন তিনি মাত্র ১ ঘণ্টা ৩২ মিনিটে, ১০২ বছর বয়সে! আজ পর্যন্ত তার দেহে কোনো অপারেশন হয় নি, হৃদরোগ নেই তার, কখনো তিনি কোনো ওষুধ খান নি।
এই সুস্থ দীর্ঘজীবনের রহস্য কী? কোনো বিশেষ খাবার-দাবার? না, বরং পাঞ্জাবের এক সাধারণ কৃষক পরিবার থেকে আসা ফৌজা সিংয়ের খাবার খুবই সাধারণ – কাঁচা ফল, সবজি, নিরামিষ। কিন্তু তার রহস্যটা হলো খাবারের পরিমাণ! একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষ দিনে যে পরিমাণ খায়, ফৌজা সিং খান তার অর্ধেক। অর্থাৎ একটি শিশু যে পরিমাণ খায়, অনেকটা সে পরিমাণ!
ডায়াবেটিস রোগীদের যেহেতু নিয়ম করে খেতে হয়, তাই ডায়াবেটিস থাকলে রোজা রাখা যাবে কি না- এ নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। কিন্তু গবেষণা বলছে ভিন্ন কথা।
তার আগে আমাদের একটু বুঝতে হবে, ডায়াবেটিস মানে কী? খুব সহজ ভাষায় বললে, আপনার ডায়াবেটিস হওয়া মানে হলো, আপনার জন্যে প্রয়োজনীয় ইনসুলিন আর আপনার দেহ তৈরি করতে পারছে না। আর এটা তখন হয়, যখন প্রচুর খাওয়া-দাওয়ার কারণে অতিরিক্ত ইনসুলিন তৈরি হতে থাকে এবং নিয়মিত তা পেতে পেতে অলস এবং তৃপ্ত কোষগুলো একসময় ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যায়।
কিন্তু আমেরিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব এজিংয়ের নিউরো সায়েন্স ল্যাবরেটরির প্রধান ড. মার্ক ম্যাটসন তার এক গবেষণায় দেখেন উপবাস বা খাবার না খাওয়া এক্ষেত্রে চমকপ্রদ কিছু ফল দেখাচ্ছে। তার এ গবেষণায় তিনি ইঁদুর ব্যবহার করেছিলেন। ইঁদুরগুলোকে তিনি দুভাগ করেন। একভাগকে মাঝে মাঝে না খাইয়ে রাখতে লাগলেন। আর একভাগকে নিয়মিতভাবে উচ্চ চর্বিযুক্ত খাবার এবং চিনি মেশানো পানি দিয়ে গেলেন।
দেখা গেল মাঝে মাঝে না খেয়ে থাকার ফলে সংশ্লিষ্ট ইঁদুরগুলোর দেহে ইনসুলিনের সরবরাহ সীমিত হয়ে পড়ছে। আর এতে করে তাদের কোষগুলো সংবেদনশীল হয়ে উঠেছে এবং বেড়েছে মেটাবলিজম। আর যে-দেহে এ অবস্থা বিরাজ করে, সে-দেহে ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও কমে যায়।
আলসার রোগীদের একটা ধারণা আছে যে, তারা রোজা রাখতে পারবেন না। কারণ রোজাতে দীর্ঘ না খাওয়া, তাদের আলসার বাড়িয়ে দেবে। কিন্তু কোনো কোনো আলসার, যেমন, পেপটিক আলসারের সবচেয়ে ভালো চিকিৎসাই হলো রোজা। কারণ খাওয়ার পর একজন মানুষের পাকস্থলীতে যে এসিড নিঃসরণ হয়, রোজার সময় তা কমে যায়। কারণ তখন সে না খেয়ে থাকে। যে কারণে রোজা রাখলে পেপটিক আলসারের রোগীদের সমস্যাগুলো অনেক কমে যায়।
একটা ধারণা সাধারণভাবে প্রচলিত আছে যে, রোজার মাসে খাবারের কোনো হিসাব নাই। অর্থাৎ রোজা রাখার পর ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত একজন মুসলমান হালাল হলে যে-কোনো খাবার- যত খুশি খেতে পারে, আকণ্ঠ পান করতে পারে। ধর্মে তাকে এই ছাড় দেয়া হয়েছে। আর এই অবিদ্যাপ্রসূত ধারণারই ফসল হলো – অন্য সময় আমরা যা খাই, রোজার সময় তার চেয়ে বেশি খাই। অন্য সময় যদি দুবেলা খাই (কারণ অনেকেই নাশতা বা দুপুরের খাবার যে-কোনো একটা খুব হালকা করেন), তো রোজার মাসে খাই তিনবেলা। ইফতারে ভূরিভোজ, তারপর ডিনার এবং শেষরাতে ভরপেট সেহরি। রোজার মাসে আমাদের খরচ বেড়ে যায়, বাড়ে দ্রব্যমূল্য। আর ব্যবসায়ীরাও এ সুযোগে আয়োজন করেন রমজান ফেস্টিভাল, ইফতার ফেস্টিভাল (!) ইত্যাদি। অর্থাৎ খাদ্যসংযমের একটি পবিত্র ধর্মবিধানকে আমরা রূপান্তরিত করেছি খাদ্য উৎসবের আয়োজনে!
কিন্তু ধর্ম কি তা বলে? রমজানের যে আরবি প্রতিশব্দ ‘সিয়াম’- সেই সিয়ামের আক্ষরিক অর্থই হলো ‘সংযম’। এবং এ সংযম শুধু খাবার বা পানি থেকে সংযম নয়, এটা চিন্তায়, কথায়, আচরণে – সবক্ষেত্রেই। কাজেই যুক্তি বলে, রমজানের এই একমাসের সংযম চর্চা একজন মানুষের ভোজন প্রবণতাকে কমাবে, তার বাড়তি ওজন কমবে, কমবে খাওয়াবাবদ তার খরচ। যদি তা না হয়, তাহলে বুঝতে হবে রোজার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গিতেই তার ভ্রান্তি আছে।
পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থার শিকার হয়ে আমরা অনেকেই এখন পণ্যদাস। পণ্য দিয়েই আমরা মাপি আমাদের স্ট্যাটাস, ভালো থাকা, খারাপ থাকা ইত্যাদি। এর এ প্রক্রিয়ারই নতুন সংযোজন হিসেবে এখন আমরা হয়ে উঠছি ভোজনদাস। বুফে ডিনার, বুফে লাঞ্চ, দামী আইসক্রিম শপ, পিজা আর ফাস্ট ফুড রেস্টুরেন্টে বন্ধুবান্ধব পরিবারকে নিয়ে যাওয়া আর ফেসবুকে সে ছবি আপলোড করাই আমাদের কারো কারো স্ট্যাটাস বাড়ানোর উপায়!
ইফতার আর সেহরি পার্টি এই ভোজনদাসত্বেরই আরেকটি ধর্মীয় ভার্সন! অর্থাৎ ধর্মের নামে হলেও এ পার্টিগুলোতে খাবার-দাবার নিয়ে যে বিলাসিতা হয়, তার সাথে কি ধর্মের মিল আছে! নবীজী (স) কীভাবে ইফতার করতেন!
হযরত আনাস ইবনে মালিকের (রা) বর্ণনা থেকে জানা যায়, নবীজি (স) ইফতার করতেন তাজা খেজুর দিয়ে। যদি তাজা খেজুর না পাওয়া যেত, তাহলে শুকনো খেজুর দিয়ে। আর যদি তাও না পাওয়া যেত, তাহলে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে। এরপর তিনি মাগরিবের নামাজ পড়ে নিতেন।
আর ভোজনদাসত্বের সাম্প্রতিক সংযোজন হলো সেহরি পার্টি। অভিজাত এলাকার হোটেলগুলো এখন সেহরির সময় খোলা থাকে! ব্যাপারটা এমন নয় যে, বাসায় রান্না করার সুবিধে নেই, তাই হোটেলে সেহরি খেতে বাধ্য হচ্ছেন, তাদের জন্যে এটা। বরং এটা তথাকথিত অভিজাত বিলাসবহুল হোটেল-রেস্টুরেন্টের কথা যেখানে দলবেঁধে সেহরি খাওয়ার নামে বিপুল অর্থ খরচ করে এসে একশ্রেণীর মানুষ তৃপ্তির ঢেকুর তোলেন এই ভেবে যে, তার স্ট্যাটাস বাড়ানো গেছে!
হযরত আনাস ইবনে মালিকেরই আরেকটি বর্ণনা থেকে জানা যায়, একবার নবীজী (স) সেহরির সময় তাকে বললেন, আনাস আমি রোজা রাখার নিয়ত করেছি। আমাকে কিছু খাবার দাও। আনাস (রা) তখন তাকে কয়েকটি খেজুর আর একটা পাত্রে পানি দিলেন! নবীজী (স) তাই খেলেন।