চিনি বা হোয়াইট পয়জন : এলকোহলের মতোই বিপজ্জনক!

৩৫ মিলিয়ন মৃত্যু ঘটাবে চিনি

চিনি শরীরের জন্যে এলকোহলের মতোই বিপজ্জনক। সেইসাথে আসক্তি সৃষ্টিকারীও বটে। শুধু তা-ই নয়, চিনি খাওয়ার সাথে দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক ব্যাধি যেমন হৃদরোগ ডায়াবেটিস ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ার সরাসরি সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। জাতিসঙ্ঘের সাম্প্রতিক ঘোষণা অনুযায়ী, ভবিষ্যতে এ রোগগুলো বছরে ৩৫ মিলিয়ন মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিশুরোগ বিভাগের প্রফেসর রবার্ট এইচ লাস্টিগ ও তার একদল সহকর্মী অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলাফল নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা করেন। তারা দেখেছেন, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে আপনার শরীরে দেখা দিতে পারে নানারকম বিষক্রিয়া। এ-ছাড়াও সব ধরনের বিপাকজনিত রোগ, যেমন উচ্চ রক্তচাপ (চিনির ফ্রুক্টোজ ইউরিক এসিডের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, রক্তচাপ বৃদ্ধিতে যার ভূমিকা রয়েছে), কোলেস্টেরলের আধিক্য, ফ্যাটি লিভার, ডায়াবেটিস, মেদস্থূলতা ও বার্ধক্য প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার সাথে চিনির সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। এসব কারণেই বিশ্বজুড়ে এখন চিনির আরেক নাম ‘হোয়াইট পয়জন’।

মেদস্থূলতার অন্যতম কারণ চিনি

বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু উন্নত দেশগুলোতেই নয় বরং যেসব দেশে পাশ্চাত্যের অনুকরণে প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রচলন বাড়ছে সেখানে মেদস্থূলতা ও এ জাতীয় সমস্যাগুলো ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে অপুষ্টিতে আক্রান্ত মানুষের চেয়ে মেদবহুল মানুষের সংখ্যা শতকরা ৩০ ভাগ বেশি!

মেদস্থূলতাই একমাত্র সমস্যা নয়, স্বাভাবিক ওজন যাদের, তারাও প্রায় সমান ঝুঁকিতে আছেন বলে জানাচ্ছেন পুষ্টিবিজ্ঞানীরা। কারণ, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে এদের মধ্যে শতকরা ৪০ জনের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ কোলেস্টেরল ও লিভারের সমস্যা দেখা দিতে পারে।

অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ ঘটাতে পারে সামাজিক বিপর্যয়!

গত ৫০ বছরে পৃথিবীজুড়ে চিনির ব্যবহার তিনগুণ বেড়েছে। ইউরোপ-আমেরিকার মতো দেশগুলোতে খাদ্যাভ্যাসজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকির অন্যতম কারণ এই চিনি। সাম্প্রতিক একাধিক গবেষণায় দেখা গেছে, চিনিতে থাকা ফ্রুক্টোজ যকৃতে বিষক্রিয়া ও নানারকম দীর্ঘমেয়াদি রোগের কারণ। এভাবে অতিরিক্ত চিনি গ্রহণ মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, অতিরিক্ত চিনি খাওয়ার ফলে দীর্ঘমেয়াদি যেসব রোগ হয়ে থাকে তা খুব ধীরে ঘটে বলে তাৎক্ষণিকভাবে টের পাওয়া যায় না। চিনি যে এভাবে ব্যক্তিস্বাস্থ্যের পাশাপাশি সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে, তা নিয়ে জনস্বাস্থ্য সংস্থাগুলোও ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর প্রতি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হলো- চিনির উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার রোধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

এলকোহলের মতোই বিপজ্জনক আর আসক্তি সৃষ্টিকারী

এক দশকেরও বেশি সময় আগে, সমাজ-মনোবিজ্ঞানী টমাস বিবার ও তার সহযোগীরা সামাজিক স্বাস্থ্যের ওপর এলকোহলের প্রভাব নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা পরিচালনা করেন। এর ভিত্তিতে ২০০৩ সালে একটি উল্লেখযোগ্য বইও প্রকাশ করেন তারা। এলকোহলের নেতিবাচক প্রভাবগুলো সবিস্তারে তুলে ধরা হয় বইটিতে।

তাতে বলা হয়েছে, এলকোহলের মতো চিনিও একইরকম সামাজিক দুর্গতি ঘটাতে পারে। কারণ, এখন প্রায় সব ধরনের প্রক্রিয়াজাত খাবারেই প্রচুর পরিমাণে চিনি ব্যবহৃত হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, যকৃতের ওপর ফ্রুক্টোজের বিষক্রিয়া এলকোহলের মতোই। আর এতে তেমন অবাক হওয়ারও কিছু নেই। কারণ, চিনির গাঁজনের মাধ্যমেই এলকোহল তৈরি হয়। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, অতিরিক্ত চিনি গ্রহণের ফলে মানবদেহে ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে ও বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।

তামাক এবং এলকোহলের মতোই চিনিও আসক্তি সৃষ্টি করে। চিনি যত খাওয়া হয়, তত এটি মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত করে আরো খাওয়ার জন্যে। চিনি খাওয়ার ফলে গ্রেলিন, লেপটিন, ডোপামিন ইত্যাদি হরমোনের স্বাভাবিক প্রবাহ-ছন্দ কিছুটা বাধাগ্রস্ত হয়, যা মস্তিষ্কে ক্ষুধার অনুভূতি বাড়িয়ে দেয় এবং আমরা অতিরিক্ত পরিমাণ খাবার গ্রহণে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।

জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি!

পরোক্ষ ধূমপান ও মাদকাসক্তির কারণে মৃত্যুহার বেড়ে যাওয়ায় গত কয়েক দশক ধরে বিশ্বজুড়ে সচেতন মানুষ তামাক, এলকোহল ইত্যাদির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের দাবি জানিয়ে আসছেন। চিনি খাওয়ার দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করে তারা এখন সোচ্চার হয়ে উঠেছেন চিনির বিরুদ্ধেও।

কারণ, খোদ আমেরিকাতেই শুধু বিপাকজনিত অসুস্থতার চিকিৎসায় বছরে ব্যয় হয় ১৫০ বিলিয়ন ডলার, যা আমেরিকায় স্বাস্থ্যখাতে ব্যয়িত মোট অর্থের ৭৫ ভাগ। সেখানে সামরিক বাহিনীতে যোগ দিতে গিয়ে শতকরা ২৫ জনই অযোগ্য ঘোষিত হচ্ছেন শুধুমাত্র মেদস্থূলতার কারণে। এ অবস্থায় আমেরিকার সাবেক তিনজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা ও ইউএস জয়েন্ট চীফ অব স্টাফ-এর বর্তমান চেয়ারম্যান মেদস্থূলতাকে অভিহিত করেছেন ‘জাতীয় নিরাপত্তার হুমকি’ হিসেবে।

সব খাবারেই চিনির ভূত ॥ চাই সচেতনতা ও কার্যকর উদ্যোগ

ভোগ্যপণ্য হিসেবে চিনির ব্যবহার কমানোর ব্যাপারে বিশ্বজুড়ে সচেতনতা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটি, যখন আমাদের প্রায় সব খাবারেই চিনি একটি অন্যতম অপরিহার্য উপাদান হয়ে উঠেছে! বিশেষজ্ঞদের পরামর্শটা এবার সরাসরি- তা হলো, চিনি এবং চিনিযুক্ত সকল প্রক্রিয়াজাত খাবার ও পানীয় যেমন বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয়, সোডা, বোতলজাত জুস, স্পোর্টস ড্রিংকস ইত্যাদি পণ্যে বিক্রয়-কর ও মূল্য সংযোজন কর বাড়ানো, যেমনটি করা হয়েছে তামাক ও এলকোহলের ক্ষেত্রে। সেইসাথে চিনির উৎপাদন ও এর ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রেও চাই যথাযথ মনোযোগ।

কানাডা ও ইউরোপের কিছু দেশ ইতোমধ্যেই এ পদক্ষেপ অনুসারে কাজ শুরু করেছে। চিনি এবং চিনিযুক্ত প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে উচ্চ হারে কর-আরোপ করেছে তারা। আমেরিকাও এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই। কারণ, জরিপে দেখা গেছে, একজন আমেরিকান বছরে ২১৬ লিটার সোডা পান করে, যার শতকরা ৫৮ ভাগই হলো চিনি। তাই প্রতি ক্যান সোডায় ১০-১২ সেন্ট বাড়তি কর নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানে। মার্কিন নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন, এতে একদিকে যেমন বছরে বাড়তি রাজস্ব আদায় হবে ১৪ বিলিয়ন ডলার, তেমনি এসব খাবার ও পানীয় গ্রহণের হার কিছুটা হলেও কমবে।

শিশুরা যেন থাকে নিরাপদ

ফ্রান্স হাঙ্গেরি ডেনমার্কও ইতোমধ্যেই কিছু প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম হলো অধিক চর্বিযুক্ত খাবার ও চিনির ওপর উচ্চ কর-আরোপ। শুধু তা-ই নয়, অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার যেমন ফাস্টফুড, বিভিন্ন ব্র্যান্ডের কোমল পানীয় ও বোতলজাত জুসের ব্যাপারে শিশু-কিশোরদের নিরুৎসাহিত করে তুলতে উন্নত বিশ্বের অনেক স্কুল-কলেজ তাদের ক্যাফেটেরিয়ার ভেন্ডিং মেশিন থেকে এসব খাদ্যপণ্য সরিয়ে নিয়েছে।

চিনি নিয়ে পাশ্চাত্যের সাম্প্রতিক এই ভয়াবহ পরিস্থিতি আমাদেরকে এ ইঙ্গিতটিই দিচ্ছে যে, এ বিষয়ে আমাদেরও যথাযথ সচেতনতা জরুরি। আর তাই একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে নিজেরা সচেতন হওয়ার পাশাপাশি আমাদের পরিবার কর্মক্ষেত্র স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ চারপাশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন করে তুলতে পারি।

তথ্যসূত্র : বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’-এ প্রকাশিত স্বাস্থ্য-নিবন্ধ       

‘দি টক্সিক ট্রুথ এবাউট সুগার’ (২ ফেব্রুয়ারি, ২০১২)