সুস্বাস্থ্যের ৫ ভিত্তি

আত্মনির্মাণের জন্যে নিজের মানসিক শক্তিকে সুসংহত করার পাশাপাশি প্রয়োজন শারীরিক শক্তিকে সংহত করা, অর্থাৎ সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়া। কয়েকটি ছোট ছোট পদক্ষেপ গ্রহণ করে আমরা অনায়াসে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে পারি। সুস্বাস্থ্যের কোয়ান্টাম ভিত্তি হচ্ছে ৫টি। এই ৫টি ভিত্তিকে ব্যবহার করে আমরা অনায়াসে জীবনকে সুস্বাস্থ্যের নতুন ছন্দে ছন্দায়িত করতে পারি।

১. দম

দম হচ্ছে জীবনের মূল ছন্দ। এই দমই শরীরের বাকি সকল ছন্দকে নিয়ন্ত্রণ করে। সঠিক ও পরিপূর্ণ দম প্রতিটি জীবকোষকে প্রকৃতির ছন্দে ছন্দায়িত করে। আর বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার মাধ্যমেই আমরা পরিপূর্ণ দম নিতে পারি। বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্যে দিনে ৫ দফা ১৯ বার করে দম নিন। বুক ফুলিয়ে দম নেয়ার ক্ষেত্রে দম নাক দিয়ে নেবেন, বুক ফুলবে, মুখ দিয়ে ছাড়বেন। প্রথমবার ধীরে ধীরে নাক দিয়ে দম নিয়ে বুক ফোলাতে থাকুন। বুক পুরো ফুলে গেলে ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে দম ছাড়ুন। দম ছেড়ে মনে মনে গুনুন, এক। আবার একইভাবে দম নিয়ে দম ছেড়ে গুনুন : দুই। এভাবে উনিশ পর্যন্ত গুনে শেষ করুন। সারাদিনে এরকম ৫ দফা দমের চর্চা করলে আপনার দেহের প্রতিটি কোষ পর্যাপ্ত অক্সিজেন লাভ করবে। আপনি প্রাণবন্ত প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠবেন। বহুক্ষণ একনাগাড়ে কাজ করতে পারবেন। সহজে ক্লান্ত ও অবসন্ন হবেন না।

২. আহার

দমের পরই দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আহার। সবসময় সুপাচ্য সহজ খাবার গ্রহণ করবেন। অতিরিক্ত মশলা, তেল, ঝাল ও ভাজাপোড়া বর্জন করবেন। খাবারের ব্যাপারে তিনটি বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম, কী খাবেন? দ্বিতীয়ত, কতটা খাবেন? তৃতীয়ত, কখন খাবেন?

কী খাবেন? সবকিছু খাবেন। যা কিছু আপনার ধর্মবিশ্বাস ও আপনার রুচি অনুমোদন করে, তার সবই খাবেন। আত্মনির্মাণের জন্যে, মেডিটেশনের জন্যে, ধ্যানের জন্যে শুধু নিরামিষ খেতে হবে এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। নিরামিষ খেলে শরীর হালকা স্লিম থাকবে এ ধারণাও সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। গরু ঘাস খায়। অর্থাৎ, নিরামিষ খায়। তারপরও সে থলথলে চর্বিদার হয়ে ওঠে। আবার বাঘ শুধু গোশত, অর্থাৎ, আমিষ খায়। তারপরও সে স্লিম, লিকলিকে। নিরামিষ নিয়ে কৌতুকেরও কোনো শেষ নেই। এক ভদ্রলোক নিরামিষভোজী হিসেবে পরিচিত। একবার তার বাসায় দাওয়াতে গিয়ে মেহমান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করলেন যে, গরুর গোশত পরিবেশন করা হচ্ছে। শুধু মেহমানকে দেয়া হচ্ছে তাই নয়, মেজবান নিজেও গরুর গোশত নিচ্ছেন। মেহমান বিস্ময়ের স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, 'আপনি তো নিরামিষভোজী। আপনি গরুর গোশত খাচ্ছেন কেন?' গৃহকর্তা অম্লানবদনে জবাব দিলেন, 'গরু হচ্ছে  "প্রসেসড ভেজিটেবল"। দেখুন, গরু নিরামিষ ছাড়া কিছু খায় না। তাই গরুর গোশতকে অনায়াসে প্রক্রিয়াজাত নিরামিষ বলা যায়। নিরামিষের এমন ব্যাখ্যা শুনলে না হেসে উপায় কী?

আমিষকে নিরামিষ মনে করে খাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। মাছ-গোশতকে আমিষ হিসেবেই খাওয়া যেতে পারে। তবে আমিষ সবসময়ই পরিমিত খাওয়া উচিত। দৈনন্দিন খাবার তালিকায় প্রতিদিন পরিমিত শাকসব্জি থাকা উচিত। বাঁধাকপি, ডাঁটা, পুঁইশাক, সজনে ও আঁশ জাতীয় সব্জি বেশি থাকা উচিত। সব ধরনের ডাল খাবেন।

মৌসুমী ফল সবসময় পর্যাপ্ত খাওয়া উচিত। একেক মৌসুমে যে ফল হয়, তা সে মৌসুমের রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। আম, কাঁঠাল, কলা, কুল, পেয়ারা, আমড়া, আনারস, চালতা, জাম্বুরা, আমলকি, অর্থাৎ, দেশীয় ফল প্রচুর পরিমাণে খাবেন। ফ্লু বা ভাইরাস জ্বরের আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই বাজারে আনারস চলে আসে। তখন পরিমিত আনারস খেলে ফ্লু আক্রমণ করার সুযোগ পায় না। সেজন্যেই বলা হয়, মৌসুমের ফলের মধ্যেই মৌসুমের রোগের দাওয়াই রয়েছে। যাদের ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা বেশি তারা শীত আসার একমাস আগে থেকে প্রতিদিন একটি মাঝারি সাইজের জাম্বুরার অর্ধেক খেলে ঠাণ্ডা-সর্দি থেকে অনায়াসে রেহাই পেতে পারেন।

খাবারের ব্যাপারে বিশ্বের সচেতন মানুষেরা এখন প্রাকৃতিক খাবারের প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছেন। পাশ্চাত্যে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ এখন টিনজাত, প্রক্রিয়াজাত ও পরিশোধিত খাবারের বদলে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক খাবারে দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ ও পুষ্টিবিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, প্রক্রিয়াজাত খাবার বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি এমন কি ক্যান্সার সৃষ্টির কারণ হচ্ছে। তাই ময়দার পরিবর্তে লাল আটা খাবেন। চিনির পরিবর্তে গুড় খাবেন। দুধ-চায়ের পরিবর্তে গুড় দিয়ে হালকা রং-চা খাবেন। টিনজাত খাবার পুরোপুরি বর্জন করবেন। ফলের রসের পরিবর্তে টাকটা ফল খাবেন। গুঁড়া দুধ পুরোপুরি বর্জন করবেন। গরুর খাঁটি দুধ প্রত্যেক দিন এক গ্লাস করে খাবেন। হরলিক্স, ওভালটিন ইত্যাদি তথাকথিত পুষ্টিকর খাবার পুরোপুরি বর্জন করে পুষ্টির জন্যে নিয়মিত দুধ, কলা, ডিম খাবেন। মিষ্টি একেবারেই খাবেন না। বিশেষত রঙিন মিষ্টি পুরোপুরি বর্জন করবেন। কারণ খাবারে যে রঙ ব্যবহার করা হয়, তা ক্যান্সার সৃষ্টি করার কারণ হতে পারে।

তথাকথিত কোমল পানীয় পান করবেন না। কারণ এই পানীয়ের মধ্যে নেশা রয়েছে। আর এই তথাকথিত কোমল পানীয় ডায়াবেটিস এবং কিডনি ও মূত্র ব্যাধির কারণ। কোমল পানীয়ের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমাদের দেশের বিশিষ্ট কিডনি ব্যাধি বিশেষজ্ঞ ব্রিগেডিয়ার সিরাজ জিন্নাত ১৯৯৪ সালের বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবসের আলোচনা সভায় সুস্পষ্ট মতামত ব্যক্ত করেছেন। কোমল পানীয় আপনার কিডনি ও মূত্রাশয়ের জন্যে অত্যন্ত কঠিন প্রমাণিত হতে পারে। তাই কোমল পানীয়ের পরিবর্তে সবসময় ডাব খাবেন। ডাবের পানিতে ১৯টি প্রাকৃতিক খনিজ দ্রব্য রয়েছে যা স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত উপকারী।

কতটুকু খাবেন? সবসময় পরিমিত খাবার খাবেন। বেশি খেলে আপনার রোগ-ব্যাধি বেশি হবে। এ ব্যাপারে হযরত মোহাম্মদ (স)-এর একটি হাদীস আমরা অনুসরণ করতে পারি। তিনি বলেছেন : তুমি তোমার পাকস্থলীর এক-তৃতীয়াংশ খাবার ও এক-তৃতীয়াংশ পানীয় দ্বারা পূর্ণ করো। আর বাকি এক-তৃতীয়াংশ ফাঁকা রাখো। দীর্ঘ নিরীক্ষায় দেখা গেছে যে, এভাবে খাবার গ্রহণ করলে পাকস্থলীর ব্যাধি থেকে পুরোপুরি মুক্ত থাকা যায় এবং শরীরের ওজন সবসময় নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কখন খাবেন? বর্তমান বিশ্বের একজন বিশিষ্ট ডায়েটিশিয়ান ডা. পল রোয়েন দীর্ঘ ৩০ বছরের গবেষণায় দেখেছেন যে, রাতে ভুরিভোজন হার্ট এটাকের মাধ্যমে হঠাৎ মৃত্যুর আদর্শ ব্যবস্থা। তাই রাতে ভুরিভোজন থেকে সবসময় দূরে থাকা উচিত। সুস্বাস্থ্য ও ওজন নিয়ন্ত্রণের জন্যে তিনি বলেছেন : সকালবেলা ভরপেট নাশতা করুন, দুপুরে তৃপ্তির সাথে খান এবং রাতে খুব হালকা খাবার গ্রহণ করুন।

৩. ব্যায়াম

আহারের পর আসে ব্যায়াম বা শরীরচর্চার প্রয়োজনীয়তা। ব্যায়ামের মধ্যে যোগ ব্যায়াম ও কোয়ান্টাম ব্যায়াম হচ্ছে সবচেয়ে ভালো ব্যায়াম। এরপরই হচ্ছে হাঁটা। প্রতিদিন ২০/২৫ মিনিট ব্যায়াম করা বা হাঁটা প্রয়োজন। হাঁটলে ঘণ্টায় ৪ মাইল গতিতে হাঁটতে হবে।

৪. পরিচ্ছন্নতা

পরিমার্জন ও পরিশীলন। দেহের সার্বিক পরিচ্ছন্নতা ও পোশাক-পরিচ্ছদ পরিষ্কার রাখা। শরীর থেকে সকল বর্জ্য বর্জনে পর্যাপ্ত পানি পান করা ও নিয়মিত স্বাভাবিক ঠাণ্ডা পানিতে গোসল করা

৫.ছন্দায়ন

প্রতিটি দিনকে একটা ছন্দের মধ্যে আনা। ঘুম, জেগে ওঠা, খাবার, ব্যায়াম- প্রতিটি ক্ষেত্রেই রুটিন অনুসরণ করা। ভার্চুয়াল ভাইরাস বর্জন ও রাত ১১টায় সবরকম স্ক্রিন বন্ধ করা

সুস্বাস্থ্যের জন্যে এ ৫টি ধাপ অনুসরণ করুন। আপনি এক প্রাণবন্ত শরীরের অধিকারী হবেন।