published : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
হাসুন! প্রাণ খুলে হাসুন! হো তেই-এর মত হাসুন। হো তেই ছিলেন জাপানী সাধক। বুদ্ধের বাণী প্রচার করতেন। তাঁর পুরো শিক্ষাই ছিল হাসি। শুধুমাত্র হাসি। তিনি গ্রাম থেকে গ্রামে; বাজার থেকে বাজারে ঘুরে বেড়াতেন। গ্রামের মাঠে বা বাজারের মাঝখানে দাঁড়াতেন। তারপর হাসতে শুরু করতেন। এই হাসি ছিল তার বাণী। তাঁর হাসি যেমন ছিল প্রাণবন্ত, তেমনি ছোঁয়াচে। হৃদয়ের ভেতর থেকে উঠে আসত এই হাসি। দমকে দমকে সারা শরীর নাচিয়ে, পেটে ঢেউ তুলে উঠে আসত এই হাসি। হাসতে হাসতে মাটিতে গড়াগড়ি যেতেন তিনি। তার চারপাশে সমবেত জনতাও হাসতে শুরু করত। সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ত চারপাশে। পুরো গ্রাম-জনপদের সবাই যোগ দিত হাসিতে, হাসতে হাসতে গড়াগড়ি যেত তারা।
গ্রামের লোকেরা হো তেই-এর জন্যে অপেক্ষা করত। কখন তিনি আসবেন? কারণ তিনি নিয়ে আসতেন হাসি, আনন্দ, উচ্ছলতা, আশীর্বাদ। তাঁর সাথে হাসিতে যোগ দিয়ে দুঃখ-শোক ভুলে যেত, রোগ-ব্যাধি থেকে মুক্ত হতো মানুষ। তাই গ্রামের লোক অপেক্ষা করতে হো তেই-এর জন্যে।
'হাসিতে রোগ সারে' কথাটি শুনে কারো কারো হাসি পেতে পারে। কিন্তু কথাটি অত্যন্ত সত্য কথা। যুক্তরাষ্ট্রে স্যাটারডে রিভিউ পত্রিকার সম্পাদক নরমাল কাসিনস-এর কথা ধরা যাক। ১৯৭০-এর দশকে মেরুদণ্ডের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন তিনি। ডাক্তাররা তাঁর রোগ মুক্তির সম্ভাবনা বস্তুত নাকচ করে দিলেন। কয়েক বছর প্রচণ্ড ব্যথায় কষ্ট পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিলেন যে, তিনি কোন ওষুধ আর খাবেন না। পরিবর্তে তিনি নিজের চিকিৎসার জন্যে এক অভিনব প্রক্রিয়া উদ্ভাবন করলেন। যখনই ব্যথায় অস্থির হয়ে উঠতেন তখনই তিনি তার প্রিয় হাসির ছবি লরেল এন্ড হার্ডি, ম্যাক্স ব্রাদার্স ইত্যাদি ছবির ভিডিও ছেড়ে দিতেন। তিনি হাসির বেদনানাশক গুণ উপলব্ধি করলেন। তিনি দেখলেন যে ৫ মিনিটের দম ফাটানো হাসি ২ ঘণ্টা পর্যন্ত ব্যথাবেদনা থেকে তাঁকে মুক্ত রাখে। আর এভাবে হাসতে হাসতেই কোন ওষুধ ছাড়া তিনি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। তাঁর এই রোগমুক্তির বিবরণ সম্বলিত বই 'এনাটমি অভ এন ইলনেস' উঠেছিলো বেস্ট সেলার-এর তালিকায়। নরমান কাসিনস ৭৫ বছর বয়সে ১৯৯০ সালে মারা যান।
হাসির নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে ডাক্তাররা প্রচুর গবেষণা করেছেন এবং করছেন। যত গবেষণা হচ্ছে তত নতুন নতুন তথ্য বেরিয়ে আসছে। ডা. রেমন্ড মুদি তাঁর 'লাফ আফটার লাফ : দি হিলিং পাওয়ার অভ হিউমার' গ্রন্থে লিখেছেন, হাসির সাথে শরীরের স্বাস্থ্যগত অবস্থার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমার পেশাগত জীবনে এমন অনেক ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি যেখানে রোগীরা হাসি দিয়েই সুস্থতা অর্জন করেছে। ডা. মুদি বলেন যে, হাসির সাথে আয়ুর গভীর সম্পর্ক রয়েছে। হাসির বেদনা লোপ করার ক্ষমতা প্রবল। হাসির সাথে ব্যথার সম্পর্ক একেবারে সাপে-নেউলে। তিনি বলেন যে, হাসির সময় পেশীর টান অনেকটা আলগা হয়ে যায়। তাই দম ফাটানো হাসি পেশীর ব্যথা নিমেষে দূর করে দিতে পারে। ব্যাপারটিকে এভাবেও ব্যাখ্যা করা যায় : অচেতনভাবে পেশীতে সৃষ্ট টেনশন মাথাব্যথা সৃষ্টির কারণ বা বৃদ্ধির কারণ। হাসির সময় পেশী শিথিল হয়ে আক্রান্ত এলাকার টেনশন কমিয়ে দেয়। ফলে ব্যথা নিরাময় হয়। ডা. মুদি তার এক ডাক্তার বন্ধুর কথা উল্লেখ করে বলেন যে, তিনি তাঁর রোগীদের হাসিয়েই তাদের মাথাব্যথা দূর করে দিতেন।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডা. উইলিয়াম ফ্লাই হাসির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, অন্যান্য আবেগের চেয়ে হাসি একটি ভিন্নতর আবেগ। হাসি এক ধরনের ব্যায়ামের কাজ করে। হাসিতে পেশী সক্রিয় হয়ে ওঠে, হার্ট রেট বেড়ে যায়, দম দ্রুত হয়, রক্তের অক্সিজেন গ্রহণ ক্ষমতা বেড়ে যায়। ক্রীড়াবিদদের ব্যায়ামের অনুরূপ ফল পাওয়া যায় হাসিতে। হাত, মুখ, পা ও পেটের পেশীর একটা 'মিনি ওয়ার্ক আউট' হয়ে যায় হাসির ফলে। (এর আগে যখন আপনার হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে গিয়েছিলো, তখনকার পেটের পেশীর ব্যথা স্মরণ করুন)। হাসিতে ডায়াফ্রাম, থোরেক্স, সার্কুলেটরি ও এন্ডোক্রাইন সিস্টেমেরও ব্যায়াম হয়। হাসি মস্তিষ্ককে ক্যাটেকোলামাইন হরমোন নিঃসরণে উদ্বুদ্ধ করে। আর এই ক্যাটেকোলামাইনই শরীরের নিজস্ব ব্যথানাশক এনডোরফিন নিঃসরণ করে রক্তপ্রবাহে।
ডা. উইলিয়াম ফ্লাই বিশ্বাস করেন যে, এক মিনিট প্রাণখোলা হাসি কয়েক মিনিট গভীর শিথিলায়নের মত উপকারী আর ২০ বার হাসি কয়েক মিনিট জগিং-এর সমান। শুধু তাই নয়, সাইকো-নিউরো-ইমিউনোলজির ক্ষেত্রে গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে নেতিবাচক আবেগ, যেমন বিষণ্নতা শরীরের ইমিউন সিসটেমকে দুর্বল করে দেয় আর এর ফলে ঠাণ্ডা লাগা থেকে ক্যান্সার পর্যন্ত যেকোনো ব্যাধি সহজে আক্রমণ করতে পারে। পক্ষান্তরে হাসি ইমিউন সিস্টেমকে শক্তিশালী করে এবং যেকোনো রোগ প্রতিরোধ, রোগ নিরাময় দ্রুততর করতে ইমিউন সিস্টেমকে সাহায্য করে।
অবশ্য এ হাসিরও প্রকারভেদ রয়েছে। সব হাসিই নিরাময় করে না। কিভাবে হাসছেন, তা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, কেন হাসছেন তাও তেমনি গুরুত্বপূর্ণ। ডা. অলসন হাসিকে তিন ভাগে ভাগ করেছেন। এক- বিদ্রূপাত্মক হাসি। এ হাসি অন্যকে ছোট করে নিজেকে বড় করার চেষ্টা করে। তাই বিদ্রূপাত্মক হাসির কোন নিরাময় ক্ষমতা নেই। দ্বিতীয়টি, কোন হাসির কথা শুনে হাসা। এর নিরাময় ক্ষমতা রয়েছে। তৃতীয়ত, নির্মল প্রাণখোলা হাসি। ডা. রেমন্ড মুদি বলেন যে, এই তৃতীয় ধরনের হাসি হচ্ছে স্বর্গীয়। এ হাসির নিরাময় ক্ষমতা সবচেয়ে বেশি। তিনি বলেন যে, এই নির্মল হাসি হাসার ক্ষমতা যার রয়েছে, সে নিজের ও অন্যের সব কিছুকেই অনেকটা নিরাসক্তভাবে দেখার ক্ষমতা রাখে। তারা নিজের বা অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা না হারিয়েও জীবনকে কৌতুকপূর্ণ ভাবে দেখতে পারে।
হাসির এই গুরুত্বের কারণেই মহানবী (স.) হাসিমুখে কথা বলার প্রতি অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তিনি বলেছেন কারো সাথে হাসিমুখে কথা বলাও একটি সদকা অর্থাৎ দান। হাসিমুখে কথা বলা যেমন নিজের দেহমনের জন্যে উপকারী তেমনি হাসি হচ্ছে সংক্রামক। আপনি হেসে কথা বললে অন্যের মাঝেও এই হাসির প্রভাব পড়বে। তার চেহারায়ও হাসি ফুটে উঠতে পারে। তাই লস অ্যাঞ্জেলেসের ব্যথা বিশেষজ্ঞ ডা. ডেভিড ব্রেসলার হাসিখুশি ও ইতিবাচক মানুষের সাহচর্যে থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। দীর্ঘ গবেষণায় তিনি দেখেছেন, 'হাসিখুশি ও ইতিবাচক মানুষ অন্যদের হাসিখুশি ও ইতিবাচক করে তোলে'। আসলে আপনি যাদের সাথে বেশি মিশবেন তাদের একটা প্রভাব আপনার উপর পড়বে। তাই নিজে হাসিখুশি ও আশাবাদী থাকুন। নিয়মিত হাসুন। দিনে ১৫/২০ বার হাসুন। হাসিখুশি ও আশাবাদী মানুষের সাথে বেশি বেশি মিশুন। আপনার জীবন হাসিময় হয়ে উঠবে।
ভোরে ঘুম ভাঙার পর চোখ বন্ধ রাখা অবস্থায় বেড়ালের মত আড়মোড়া ভাঙুন। শরীরের প্রতিটি পেশীকে টান টান করুন। কয়েকবার লম্বা দম নিন। ৩/৪ মিনিট সময় পার হওয়ার পর আপনি হাসতে চেষ্টা করুন। প্রথম দিকে হা-হা..... হি-হি... করে হাসতে চেষ্টা করুন। হা-হা হি-হি শব্দ করে হাসতে চেষ্টা করার ফলে যে শব্দ সৃষ্টি হবে সেই শব্দই আপনাকে ক্রমান্বয়ে নির্মল প্রাণখোলা ও দমফাটানো হাসির রাজ্যে নিয়ে যাবে। আপনি হাসির রাজ্যে হারিয়ে যাবেন কয়েক মিনিটের জন্যে। প্রথম দিন চেষ্টা করেই হয়তো আপনি প্রাণখোলা হাসি হাসতে পারবেন না, হয়তো হা-হা হি-হি শব্দ করবেন। কারণ আপনি হয়তো হাসতে ভুলেই গেছেন। কিন্তু কয়েকদিন অনুশীলন করার পরই দেখবেন আপনার ভেতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বেরিয়ে আসছে নির্মল স্বর্গীয় হাসি। হাসিতে ডুবে থাকুন ৫ মিনিটের জন্যে। আপনার এই স্বর্গীয় হাসি পুরো দিনটিকেই করে তুলবে আনন্দ উচ্ছল।
হাসির মনোদৈহিক উপকারিতার জন্যে পৃথিবীর দেশে দেশে লাফিং ক্লাব বা হাসির ক্লাব রয়েছে। বোম্বের ডা. মদন কাটারিয়ার হাসির ক্লাব তো রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। আপনিও কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এবং আত্মীয়স্বজন নিয়ে এই হাসির ক্লাব গঠন করতে পারেন। যাঁরা সকালে বা বিকেলে হাঁটেন তারা হাঁটার সাথে সাথে কিছুক্ষণ হেসে নিতে পারেন। তাতে শরীর মন চাঙ্গা হয়ে উঠবে আরও দ্রুত।
যৌথ হাসির চর্চা খুব সহজ। ৫/৬ জন থেকে এক/ দেড়শত জন একত্রে হাসতে পারেন। প্রথম গোল হয়ে দাঁড়ান সবাই। একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হা-হা হো-হো হি-হি করে কৃত্রিমভাবে হাসতে চেষ্টা করুন। দেখবেন সুড়সুড়ি শুরু হয়ে গেছে। একজন দিলখোলা দমফাটানো হাসি দেয়ার সাথে সাথে অন্যরাও কিছুক্ষণের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত হাসিতে ফেটে পড়বেন। কারণ হাসি ছোঁয়াচে। ৫/১০ মিনিটের পেট ফাটানো হাসি আপনার দেহমনকে চাঙ্গা রাখবে সারাদিন।