কাঁদুন! হাউমাউ করে কাঁদুন!

কাঁদুন। প্রাণ খুলে কাঁদুন। নীরবে অথবা হাউমাউ করে কাঁদুন। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদুন বা ডুকরে ডুকরে কাঁদুন। কান্নাকে মেয়েলী ব্যাপার বা অপ্রয়োজনীয় ব্যাপার মনে করারও কোনো প্রয়োজন নেই। সুস্থ মমতাভরা জীবনের জন্যে কান্না অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনোবিজ্ঞানীরা এখন বিবেচনা করছেন।

আর কান্নাকে যত সহজ ব্যাপার মনে করা হয়, কান্না তত সহজ ব্যাপারও নয়। বললেই কাঁদা যায় না। কাঁদতে হলে একজন মানুষকে কোনো গভীর বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতাকে মানসিকভাবে পুরোপুরি স্মরণ করতে হয় এবং এর সাথে জড়িত সকল দুঃখ ও আঘাতকে সেই মুহূর্তে মনে একীভূত করতে হয়। বেদনার্ত অনুভূতি প্রখর হলেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে চোখ দিয়ে পানির ধারা প্রবাহিত হতে শুরু করে।

চোখের পানি ও কান্না মনের আবেগ প্রকাশের মাধ্যম। তাই মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, দুঃখ ও বেদনার ক্ষতিকর প্রভাব থেকে শরীর ও শরীরের সিস্টেমকে রক্ষা করার এক প্রাকৃতিক নিরাপত্তা প্রক্রিয়া হচ্ছে কান্না। যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটার পল রামসে মেডিকেল সেন্টারের সাইকিয়াট্রি বিভাগের বায়োকেমিস্ট ডা. উইলিয়াম ফ্রাই বলেন যে, দুঃখ, বেদনা, মানসিক আঘাত দেহে টক্সিন বা বিষাক্ত অণু সৃষ্টি করে আর কান্না এই বিষাক্ত অণুগুলোকে শরীর থেকে বের করে দেয়। এ কারণেই দুঃখ ভারাক্রান্ত ব্যক্তি ভালোভাবে কাঁদতে পারলে নিজেকে অনেক হালকা মনে করে।

দুঃখজনিত চোখের পানি এবং জ্বালাপোড়ার কারণে চোখে আসা পানির রসায়নে কোনো পার্থক্য আছে কিনা এ নিয়ে গবেষণার জন্যে ড. ফ্রাই এক গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। একদল ভলান্টিয়ারকে দুঃখে ভরা ছায়াছবি দেখতে দেয়া হয়। তাদেরকে বলা হয় ছবি দেখে কান্না পেলে চোখের পানি টেস্টটিউবে রাখতে হবে। কয়েকদিন পর এদেরকেই সদ্য কাটা পেঁয়াজের ঝাঁঝের সামনে বসিয়ে টেস্টটিউবে চোখের পানি সংগ্রহ করা হয়। বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, দুঃখজনিত চোখের পানি আর পেঁয়াজের ঝাঁঝ লেগে আসা চোখের পানির রাসায়নিক গঠন পুরোপুরি আলাদা।

মনোবিজ্ঞানীরা অবশ্য রাসায়নিক প্রমাণ ছাড়াই অনেক আগে থেকেই বিশ্বাস করে আসছেন যে, কান্না শরীরের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। তারা মনে করেন সমস্যা যে ধরনেরই হোক না কেন, সে সমস্যার সাথে জড়িত অনুভূতির ফলে সৃষ্ট টেনশনকে বের করে দেয় কান্না। মনোবিজ্ঞানী প্রফেসর ফ্রেডরিক ফ্লেচ বলেন যে, মানসিক চাপ ভারসাম্য নষ্ট করে আর কান্না ভারসাম্য পুনরুদ্ধার করে। কান্না সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকে মানসিক চাপ থেকে মুক্তি দেয়। না কাঁদলে সেই মানসিক চাপ বা স্ট্রেস শরীরে থেকেই যায়।

কিন্তু নগর সভ্যতা আমাদেরকে দুঃখজনিত আবেগ অর্থাৎ কান্না প্রকাশে সবসময় বাধা দিয়ে এসেছে। আমাদের এখন ধারণা হচ্ছে কাঁদা এক ধরনের অভদ্রতা। তাই আমরা শুধু কান্নাকেই চেপে রাখি না এর সাথে সাথে ভয়, উৎকণ্ঠা, ক্রোধ সব কিছুকেই চেপে রাখতে সচেষ্ট থাকি। যা আমাদের দেহে ক্রামগত টক্সিন বা বিষাক্ত অণু সৃষ্টিতে সহায়ক হয়। অথচ কান্না এক সম্পূর্ণ মানবীয় ব্যাপার। কান্না শরীরকে সুস্থ করে। কান্না সহানুভূতি ও মমত্বকে আকর্ষণ করে। অশ্রু মমত্ব বাড়ায়। আর মমতাই মানুষকে মানুষ করেছে।

কিন্তু কান্না না এলে কি করা যাবে? এ সমস্যা অনেকেরই। বিশেষত দায়িত্বশীল পুরুষরা কাঁদতে পারেন না। আপনি কাঁদতে না পারলে প্রথম সচেতন হয়ে উঠুন যে, আপনার কাঁদা প্রয়োজন। আপনার কাঁদা কেন প্রয়োজন একথা ঘনিষ্ঠজনদের বলুন। আপনি ইচ্ছেমতো কাঁদুন। কারণ, না কাঁদার মানে হচ্ছে আবেগ প্রকাশের সহজ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে বঞ্চিত রাখা। তবে অবিশ্বাস্য হলেও দেখা গেছে যে, বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ব্যক্তি সহজে কাঁদতে পারে না। দুঃখ, ক্ষতি বা বেদনার ব্যাপারে অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হলেই মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। আর গবেষণায় দেখা গেছে, বিষণ্ণ মানুষ তার বিষণ্ণতা কাটিয়ে ওঠার ক্ষেত্রে অগ্রসর হতে শুরু করে কান্নার মাধ্যমে। তাই মনোবিজ্ঞানী ড. গে গায়েরলুম চমৎকারভাবে বলেছেন, সমাজ যাদেরকে না কাঁদতে শিখিয়েছে, তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে প্রাণ খুলে কাঁদতে শেখা।

ডা. লুম তার বই ‘ইউর সেকেন্ড লাইফ’-এ কাঁদার কৌশল বর্ণনা করেছেন। একটি ঘরে আরাম করে বসুন। নিশ্চিত হোন টেলিফোন বা কোনো লোক আপনাকে বিরক্ত করবে না। এবার বুকের উপর দুই হাত রাখুন। দ্রুত শ্বাস নিন। দ্রুত শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে শিশুর কান্নার মতো আওয়াজ করুন। আওয়াজের প্রতি খেয়াল করুন। আওয়াজের পিছনের বেদনাকে অনুভব করুন। চাপা কান্নার মত আওয়াজ করুন। যে বিষয়গুলো আপনার দুঃখ-বেদনার কারণ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে ভাবুন। বার বার চাপা কান্নার মতো আওয়াজ করুন। আর এই কান্নার পেছনের দুঃখ-বেদনার কথা ভাবুন। নিজেকে মানুষ হওয়ার অনুমতি দিন। কাঁদতে আর অসুবিধা হবে না।

প্রথমবারে সফল না হলে অনুশীলনের পুনরাবৃত্তি করুন। মাথাব্যথা করতে শুরু করলে কাঁদার অনুশীলন করুন। বেশিরভাগ সময়ই মাথাব্যথা আপনার ভেতরে সঞ্চিত টেনশনেরই বহিঃপ্রকাশ। তখন কাঁদতে শুরু করুন। কাঁদতে পারলেই দেখবেন কেমন হালকা লাগা শুরু করেছে। কান্নার মধ্যে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, হাউমাউ কান্না বেশি উপকারী। ফোঁপানি সারা শরীরে মৃদু ও ছন্দময় তৎপরতা সৃষ্টি করে। এই ধরনের কান্না শুধু কণ্ঠনালীতেই নয়, বুকে, পেটে, নাভিমূলে এমনকি সাইনাসেও কম্পন সৃষ্টি করে এবং ভেতর থেকে আপনাকে প্রশান্ত করে তোলে।

মনোবিজ্ঞানী ডা. স্যাভারি বলেন যে, সচেতনভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদাও স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। যখন আপনি সচেতনভাবে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে চেষ্টা করছেন তখন আপনার মনোযোগ এক কেন্দ্রবিন্দুতে আবদ্ধ হচ্ছে। তখন আপনি আপনার ভয়, ক্রোধ, দুঃখ বেদনাকে অবলোকন করার চেষ্টা করুন। দম ছাড়তে ছাড়তে অবলোকন করুন এই টেনশন বা দুঃখ, রাগ, ক্ষোভ, ব্যথা-বেদনার কারণগুলো আপনাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এর ফলে আপনি আপনার জন্যে ক্ষতিকর আবেগকে স্বীকারও করলেন আবার সচেতনভাবে তা বেরও করে দিলেন।

কান্নার মাধ্যমে আপনি আপনার দুঃখ, ক্ষোভ, ব্যথা-বেদনা সব বের করে দিন। তা না হলে ঘরের মধ্যে ময়লা জমিয়ে রাখলে তা যেমন সারা ঘরের পরিবেশকে দুর্গন্ধময় করে তোলে, তেমনিভাবে জমানো দুঃখ আপনার সমগ্র অস্তিত্বকেই তমাসাচ্ছন্ন করে দিতে পারে।

আপনি সহজে কাঁদতে পারলে আপনার সমস্যা সমাধান সহজ। কিন্তু যদি সহজে কাঁদতে না পারেন একটু চেষ্টা করুন। আমরা কোয়ান্টামের একটি ওয়ার্কশপে ২৫ জন ভলান্টিয়ার নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্নার অনুশীলন করছিলাম। কাঁদতে হবে শুনে প্রথমে কাঁদা তো দূরের কথা, চাপা হাসি, খিলখিল হাসি, মুচকি হাসিতে ব্যস্ত হয়ে উঠল সবাই। প্রায় দশ মিনিট কেটে গেল হাসিতেই।

তারপর আস্তে আস্তে সচেতন অনুশীলন শুরু হলো। ১ ঘণ্টার অনুশীলনে কাঁদলেন সবাই। কান্নার অনুভূতি সবার কাছেই ছিল অপূর্ব। অনেকেই ছেলেবেলার পর এই প্রথমবার কেঁদেছিলেন। আপনিও একইভাবে আপনার দুঃখ, বেদনা, ব্যথা, অনুশোচনা, ক্ষোভকে কান্নারূপে বের করে শারীরিক-মানসিক সুস্থতার নতুন ছন্দে অনুরণিত হোন।