দীর্ঘসূত্রিতা এড়ানোর উপায়

আজ করব, কাল করব, সকালে করব, বিকেলে করব। এই করি করি করে করা আর হয় না। আর করা হলেও হয় শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে। ধীরে সুস্থে ভালোভাবে করার জন্যে কাজটি রেখে দিলেও শেষ মুহূর্তে তাড়াহুড়ো করে করতে গিয়ে দেখা যায় যে, দায়সারাভাবে কাজটি শেষ করতে হয়। অথচ আমরা একটু সচেষ্ট হলেই এই দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে উঠতে পারি। জীবনকে করে তুলতে পারি আরও সফল, আরও আনন্দময়।

কিন্তু কেন আমরা দীর্ঘসূত্রিতা কাটিয়ে উঠতে পারি না এই ব্যাপারে মনোবিজ্ঞানী ড. লিন্ডা সাপাদিন দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তিনি সব ধরনের দীর্ঘসূত্রিতার পেছনেই তিনটি সাধারণ অনুভূতি বা আচরণ শনাক্ত করেছেন। ১. আমরা বড় বড় কাজ করতে চাই কিন্তু সে লক্ষ্যে বাস্তবে কাজ শুরু করি না। ২. কাজ শুরু না করার ব্যাখ্যা দাঁড় করাতে আমরা মেধাবী। ৩. আমরা জানি যে, দীর্ঘসূত্রিতার দ্বারা আমরা আমাদের সুখকে স্যাবোটাজ করছি। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই অনুশোচনা দীর্ঘসূত্রিতাকেই আরও বাড়িয়ে দেয়। আমাদের জীবন আত্মপরাজয়ের দিকে ধাবিত হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে দীর্ঘসূত্রিতার মূল কারণ আলস্য নয়। দীর্ঘসূত্রিতার প্রধান কারণ হচ্ছে অজানা আশঙ্কা। এই আশঙ্কা বা ভয় হতে পারে পরিবর্তনের ভয়, নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়, অশান্তির ভয় বা অন্য কোনো ভয়–যার অস্তিত্ব রয়েছে আপনার মনের গহীনে। আর দীর্ঘসূত্রী মানুষ সবসময় পেছনে পড়ে থাকে। অন্যরা যখন সাফল্যের সোপানে ধাপে ধাপে এগিয়ে যায়, সে তখন পেছনে থেকে দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দীর্ঘসূত্রিতার প্রধান ধরন ৬টি।

১. স্বপ্নচারী :

এরা সবসময় চায় জীবন সহজ হোক, কষ্ট মুক্ত হোক। এরা বাস্তব জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে। নিজেকে আকাশকুসুম কল্পনার মাঝে ডুবিয়ে দেয়। আকাশকুসুম কল্পনার মাঝে ডুবে থাকতেই ভালবাসে। কারণ সেখানে কোন কিছুই তাদের জন্যে হুমকি নয়। তারা মনে করে তারা বিশেষ প্রজাতির মানুষ। তাদের নিয়ম অনুসরণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। এ ধরনের স্বপ্নচারী দৃষ্টিভঙ্গি তাদের পেশাগত, পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক সমস্যা সৃষ্টি করে। যা পরিণামে তার মধ্যে এক পলায়নী মনোবৃত্তি জন্ম দেয়।

প্রতিকার :

আপনি যদি এ ধরনের স্বপ্নচারী হন, তা হলে ‘মুহূর্তের ভালোলাগা’ আর ‘নিজেকে ভালোলাগা’ এর মধ্যে পার্থক্য করতে শিখুন। আপনি যদি এখন দিবাস্বপ্নে ডুবে থাকেন বা টেলিভিশনের সামনে বসে অলস সময় কাটান, তাহলে এটা হচ্ছে ‘মুহূর্তের ভালোলাগা’। কিন্তু আপনি যদি নতুন কিছু শেখেন, নতুন কোন বিষয়ে দক্ষতা অর্জনে সময় ব্যয় করেন, তাহলে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়বে, নিজের প্রতি শ্রদ্ধা বাড়বে। এটা হচ্ছে ‘নিজেকে ভালোলাগা’। কাজটা এখনই করতে হবে এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই আপনাকে নামতে হবে। বাস্তবতার আলোকে প্রতিদিন কী কী করা যায় এবং তা করার জন্যে কী কী সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া যায়, তা লিখে ফেলুন। দিনের শেষে কিছুটা সময় ব্যয় করুন দিনের কাজ পর্যালোচনায়। বার বার নিজেকে বলুন, আজকের কাজ আজকেই করব।

২. দুশ্চিন্তাকারী :

দুশ্চিন্তাকারীরা সবসময় নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তাকেই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। আর এজন্যে তাকে মূল্যও দিতে হয় অনেক। তার নিরাপদ ও আরামদায়ক এলাকার সীমানা খুবই ছোট। কোন ঝুঁকি বা পরিবর্তনের মুখোমুখি হলেই দুশ্চিন্তায় তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে। ঝর্ণাধারার মতো অবিরাম গতিতে দুশ্চিন্তার প্রবাহ চলতে থাকে তার মনের ভেতরে। ‘যদি এই এই হয়’ তাহলে কী অবস্থা দাঁড়াবে এই নেতিবাচক আশঙ্কায় সে একেবারে সঙ্কুচিত হয়ে যায়। যদি এই বিরক্তিকর চাকরিটা ছেড়ে দেই, আর কোন চাকরি না পাই? এই আশঙ্কায় সে চাকরি ছাড়তে পারে না। অনিশ্চয়তা মোকাবিলা করার চেয়ে সে একঘেয়ে নিরাপদ জীবনকেই বেছে নেয়। সাধারণত দেখা যায়, এই ধরনের দুশ্চিন্তাকারীদের বাবা-মা বা অভিভাবক রয়েছেন, যারা এদের প্রতিটি প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসেন এবং অবচেতনভাবে তাদের সন্তান যে তাদেরকে ছাড়া চলতে পারে না এই অনুভূতিতে আনন্দ পান। দুশ্চিন্তাকারীদের জীবনে আনন্দ খুবই কম থাকে। তারা সহজেই ক্লান্ত হয়ে যায়।

প্রতিকার :

অধিকাংশ দুশ্চিন্তাকারীর অন্তরেই ঘুমিয়ে আছে প্রাণবন্ত সাহসী সত্তা। আপনি যদি একঘেয়েমিতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন, যদি কিছুই ভালো না লাগে, তাহলে আপনাকে বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সবকিছুর মধ্যেই বিপদ কল্পনা করা থেকে বিরত থাকুন। সিদ্ধান্ত নিন। কারণ সিদ্ধান্ত নেয়া থেকে বিরত থাকাও এক ধরনের সিদ্ধান্ত। আর তা নিজের জন্যেই ক্ষতিকর। নতুন পরিস্থিতি ও পরিবেশ সম্পর্কে শুধুমাত্র খারাপ দিকগুলো না ভেবে সম্ভাবনাগুলো নিয়ে ভাবুন। ভালো দিকগুলো নিয়ে ভাবলে অনুভূতিই পাল্টে যাবে। আপনি নতুন সুযোগ গ্রহণ করতে পারবেন। নতুন কাজে হাত দেয়ার সাহস পাবেন।

৩. অমান্যকারী :

কর্তৃত্ব বা ক্ষমতার বিরুদ্ধে এদের ক্ষোভ রয়েছে। কিন্ত এরা এই ক্ষোভ প্রকাশ করে খুবই সংগোপনে। এই ধরনের দীর্ঘসূত্রিতাকারী কাউকে যদি বলেন, ‘এ কাজটা করে দাও।’ সে সাথে সাথে বলবে ‘ঠিক আছে, করে দেব।’ কিন্তু তারপর সে তার প্রতিজ্ঞার কথা ‘ভুলে যাবে’ অথবা আধাআধি কাজটি করবে বা অনেক দেরিতে কাজটি করবে। ব্যক্তিগত বা পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এরা অন্যের প্রয়োজন পূরণের বেলায় এই একই কৌশল অবলম্বন করে। এ ধরনের আচরণ তাকে ক্ষমতার অনুভূতি প্রদান করে। কিন্তু এর ফলে তার সহকর্মী বা সঙ্গীরা নিজেদের অবহেলিত ও ব্যবহৃত ভাবে। পরিণামে অমান্যকারী নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পরও সে নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দেয় যে, এই জটিল বিশ্বে একজন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ বলেই সে শাস্তি পাচ্ছে। সে অসুখী হলেও এ নিয়ে গর্বিত।

প্রতিকার :

প্রতিক্রিয়ার বদলে ক্রিয়া করতে শিখুন। নিজেকে জীবনের শিকার বলে মনে করার পরিবর্তে জীবনে সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে ভাবুন। অন্যরা আপনার ব্যাপারে কি করছে সে দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আপনি নিজের জন্যে কি করছেন তা নিয়ে ভাবুন। মনে রাখুন নিজে উদ্যোগী হওয়া ও প্রো-একটিভ হওয়াই শক্তিমান ও ক্ষমতাবান হওয়ার প্রথম শর্ত।

৪. সঙ্কট সৃষ্টিকারী :

আমরা অধিকাংশই কোনো না কোনোভাবে শেষ মুহূর্তে কাজ ভালো করতে পারি। হাতে আর সময় নেই, এখন না করলেই নয়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক পূর্ণোদ্দমে কাজ শুরু করে। আমরা কাজ শেষ করি। একজন সঙ্কট সৃষ্টিকারী সবসময় নাটক করতে চায়। এক ধরনের আচরণ থেকে অন্য ধরনের আচরণে চলে যায়। প্রথমত সে পরিস্থিতিকে আমল দেয় না। চাপ অনুভব না করলে শুরুই করতে পারে না। পরে অতিরিক্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে। সব বাদ দিয়ে সময়মতো কাজ শেষ করার জন্যে লেগে যায়। এ ধরনের প্রক্রিয়া তারুণ্যে চলে। কিন্তু ৪০-এর পর এ প্রক্রিয়ার সাথে শরীর তাল মিলাতে পারে না।

প্রতিকার :

সময়সীমার মধ্যে কাজ করা বীরত্বব্যঞ্জক কিছু নয়, এটি নিয়ম। ‘সঙ্কট সৃষ্টি’ করে কাজ করাটা একমাত্র প্রক্রিয়া নয়। সঙ্কটসৃষ্টিকারীদের কাজের ব্যাপারে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে সমস্যায় ভোগেন। নিজেকে পুরোপুরি উদ্বুদ্ধ করতে পারলে আগে থেকেই কাজে হাত দেয়া যায়।

৫. নিখুঁত কর্মসম্পাদনকারী :

এরা প্রতিটি কাজই নিখুঁতভাবে করতে চায়। যে-কোন কাজ করতে গেলেই সে তার আত্মমর্যাদাকে এর সাথে জড়িয়ে ফেলে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এরা আদর্শবাদী এবং সময় ও শক্তি ব্যয়ের ব্যাপারে অবাস্তববাদী। ওদের কাউকে পেন্সিল চোখা করে দিতে বলুন। দেখবেন সে হয়তো খুব বিব্রতভাবে পেন্সিলের দিকে তাকাবে এবং সারাদিনই হয়তো এর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ভাববে কীভাবে সুন্দর করে পেন্সিলটি চোখা করা যায়। অথবা সে তখনই পেন্সিল চোখা করতে লেগে যাবে এবং দিনের শেষে পেন্সিল সত্যিকার অর্থেই সুন্দর চোখা করে নিয়ে আসবে কিন্তু কাটতে কাটতে এত ছোট করে নিয়ে এসেছে যে তা দিয়ে আপনি আর লিখতে পারবেন না। এরা প্রতিটি জিনিসকেই হয় একেবারে নিখুঁত অথবা কিছুই না এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে। কোনো কাজে ব্যর্থ হলে তারা নিজেদেরকেই ব্যর্থ ভাবে। নিখুঁত কর্মসম্পাদনারীরা মনের গভীরে সবসময় মনে করে পুরোপুরি না পারলেই শেষ হয়ে গেলাম। দীর্ঘসূত্রিতা এদের কাছে বিচারকে বিলম্বিত করারই এক প্রক্রিয়া, আপনি না খেললে কখনো হারবেন না। কাজ না করলে ব্যর্থও হবেন না।

প্রতিকার :

আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আপনার কী করা উচিত তা না ভেবে আপনি কতটুকু করতে পারেন তা নিয়ে ভাবুন। কোনো মানুষই নিখুঁত নয়। তাই কোনো কাজই নিখুঁত হতে পারে না। আপনার মাঝে মাঝে ভুল করা উচিত। টেবিলের ওপর আধাবেলা সব এলোমেলো করে রাখুন। পোশাকে একটু খুঁত থাকুক না এক বেলা। যখন দেখবেন এর ফলে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে না তখনই আপনি শিখবেন—নিখুঁত নয়, সুন্দরভাবে সময়মতো কাজ করাটাই গুরুত্বপূর্ণ।

৬. সব কাজের কাজী :

সব কাজের কাজীকে কখনো দীর্ঘসূত্রী মনে হয় না। কারণ সে সবসময় ব্যস্ত। সবসময় কাজ করতে চায়। সে সবাইকে খুশি করতে চায়। সবার কাজ করে দিতে চায়। কাউকেই না বলতে পারে না। সব কাজের কাজীকে আপাতদৃষ্টিতে দেখে মনে হয়, সেই সফল হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। আত্মনির্ভরশীল হওয়া ও সব কাজ করার সংগ্রামে সে তার কাজ ও সময়ের মধ্যে সমন্বয় করতে ব্যর্থ হয়। যাদের সে খুশি করতে চেয়েছিল, তাদেরকেও সে খুশি করার জন্যে মরিয়া হয়ে চেষ্টা করে, তাদেরও খুশি করতে পারে না। কারণ সে তার সামর্থ্যের অতিরিক্ত কাজ হাতে নিয়েছিল।

প্রতিকার :

 সব কাজের কাজীদের উচিত না বলতে শেখা। হাতে সময় ও কাজ কতটা আছে সেটা বিবেচনা করে হ্যাঁ বলুন। এ সপ্তাহে করতে না পারলে আগামী সপ্তাহে আসতে বলুন। যতটুকু আপনি করতে পারবেন ততটুকুই করুন। বাকিটুকু ছেড়ে দিন অন্যদের জন্যে। তা হলেই আপনি সুখী হবেন। অন্যরাও আনন্দ পাবে।

আপনি এবার চিন্তা করুন এ ৬ ধরনের দীর্ঘসূত্রীর মধ্যে আপনি কোন গ্রুপে পড়েন। সেভাবে পদক্ষেপ নিন। দীর্ঘসূত্রিতা থেকে মুক্ত হয়ে সুন্দর জীবনের পথে অগ্রসর হোন।