সময়ানুবর্তী হোন

আত্মনির্মাণের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হচ্ছে সময় নিয়ন্ত্রণ বা সময়ানুবর্তিতা। নিজের সময় নিজের নিয়ন্ত্রণ রাখতে না পারলে সময়ের যেমন অপচয় হবে তেমনি আপনার মেধার বিকাশও ব্যাহত হবে। সাফল্যের সম্ভাবনাও একইভাবে বিনষ্ট হবে। কারণ যে সময় অপচয় হলো আপনার জীবন থেকে, দিনের যতটুকু অংশই আপনি অহেতুক নষ্ট করলেন, তা কোনোদিনই ফিরে পাবেন না। ফলে যে সময় নষ্ট হলো তার জন্যে অনুশোচনা করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না।

যে সমাজের মানুষ যত বেশি সফল, যে সমাজ যত বেশি অগ্রসর সেখানে সময়ানুবর্তিতা তত বেশি লক্ষণীয়। আমাদের মতো অনগ্রসর সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের যে কোন অ্যাপয়েন্টমেন্ট বা অনুষ্ঠানে দেরি করে আসা একটা ফ্যাশানে পরিণত হয়েছে। যিনি যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তিনি তত দেরি করে অনুষ্ঠানে পৌঁছে নিজের গুরুত্ব জাহির করতে চান। ভিআইপি হলে তো কথাই নেই। মন্ত্রীরা মনে করেন তারা তো দেরি করে যাবেনই, লোকজন তাদের জন্যে অপেক্ষা করবেই। অতএব এক ঘণ্টা দেড় ঘণ্টা, কখনও কখনও দু'ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছেও দুঃখ প্রকাশ করারও সামান্যতম সৌজন্য তারা প্রদর্শন করেন না। এভাবেই দেরি করে অনুষ্ঠান বা আলোচনা শুরু করা বা দেরিতে কোথাও হাজির হওয়া আমাদের কাছে একটা স্বাভাবিক ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। আমাদের মতো অনগ্রসর অন্যান্য দেশগুলোতেও একই অবস্থা। আফ্রিকার দেশগুলোতে কোনোকিছু বিলম্বে শুরু করা স্বাভাবিক ব্যাপার হিসেবে গণ্য করা হয়। সময়কে সেখানে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করা হয় না। আমাদের দেশের মতোই সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক কোনো অনুষ্ঠান বা আলোচনা নির্দিষ্ট সময়ে শুরু বা শেষ হয় না। যখন শুরু হলো তখন থেকেই শুরু হয়েছে বলে ধরা হয়, এক নির্বিকার শ্লথ গতিতে সবকিছু চলতে থাকে, যখন শেষ হয় তখনই শেষ হলো বলে গণ্য করা হয়। অর্থাৎ, সময়ের কোনো ধরাবাঁধা বন্ধন এখানে অচল। আমাদের দেশে তো প্রবাদই আছে, 'খাওয়ার আগে, দরবারের শেষে'। কিন্তু অগ্রসর দেশগুলো, যারা পৃথিবীকে নিয়ন্ত্রণ করছে তারা সবসময় সময়ের ব্যাপারে অত্যন্ত- সজাগ। সময়ানুবর্তিতা তাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। দেরিতে উপস্থিত হওয়া সেখানে অত্যন্ত লজ্জার ব্যাপার। আমাদের এখানে অনুষ্ঠানে এক ঘণ্টা দেরিতে পৌঁছেও মন্ত্রীরা লজ্জিত হন না। কিন্তু জাপানে কোনো মন্ত্রী অনুষ্ঠানে সামান্যমাত্র বিলম্বে পৌঁছলেও সেটা একটা খবরে পরিণত হয়।

আমরা তাই নির্দ্বিধায় বলতে পারি, সময়ানুবর্তিতা হচ্ছে অগ্রসর মানসিকতার প্রতীক। আর সময়ের প্রতি গুরুত্ব না দেয়াটা অনগ্রসরতা ও মূর্খতার প্রতীক। তাই আত্মনির্মাণ করতে হলে সফল হতে হলে আপনাকে প্রতিটি কাজে সময়ানুবর্তী হতে হবে। আপনার সময়কে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসতে হবে।

আপনার যদি দেরি করে ফেলার বদঅভ্যাস থেকে থাকে তাহলে নিচের ৬টি ছোট্ট পদক্ষেপ আপনাকে সময়ানুবর্তী করে তুলতে পারে।

১. কোনো বন্ধু বা সহযোগীকে আপনার সহযোগী সময়রক্ষক নিযুক্ত করুন। সময়ানুবর্তী হতে তার সাহায্য নিতে কোনো সংকোচ করবেন না। আর আপনি দেরি করে ফেলায় বন্ধু বা সহযোগীদের কি অসুবিধা হলো তা তাদের বলতে উদ্বুদ্ধ করুন।

২. সময় কিভাবে প্রবাহিত হচ্ছে সে সম্পর্কে যদি আপনার খেয়াল কম থাকে তা হলে একটি 'বীপার ওয়াচ' কিনুন। প্রতি ঘণ্টায় একটি মিষ্টি ধ্বনি দিয়ে সময় সম্পর্কে ঘড়ি আপনাকে সজাগ করে দেবে।

৩. দেরি এড়ানোর জন্যে কিছু অতিরিক্ত সময় হাতে রাখুন। অজুহাত প্রদানের সুযোগের উপর আস্থা রাখবেন না। ট্রাফিক জ্যামের অজুহাত কোনো অজুহাতই নয়, কারণ এখন ট্রাফিক জ্যাম নৈমিত্তিক ব্যাপার।

৪. নিজেকে পুরস্কৃত করুন। সপ্তাহে তিনবার যদি সময়ের আগেই নির্দিষ্ট কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেন তাহলে নিজেকে পুরস্কৃত করুন। নিজের জন্যে কিছু একটা কিনুন, নিজেকে ধন্যবাদ দিন। আর দেরি করার জন্যে নিজেকে শাস্তি দেয়ার ব্যবস্থা করুন। যেমন, রেস্তোরাঁয় খাবার দাওয়াতে পৌঁছতে ১৫ মিনিটের চেয়ে বেশি দেরি করে ফেললে খাবারের বিল নিজে দিয়ে দিন অথবা বাথরুমে ১৫ বার কান ধরে উঠ-বস করুন।

৫. ঘড়ির কাঁটাকে এগিয়ে রাখুন। ঘড়ি ৫/১০ মিনিট এগোনো থাকলে সময়মত কাজ সম্পাদন সহজতর হতে পারে।

৬. দেরি করার জন্যে কোনো অজুহাত দাঁড় করাবেন না। সাধারণত দেখা যায়, কর্মস্থলে দেরিতে পৌঁছার পেছনে অবচেতন মনে এক ধরনের বিশেষ ভাবনা কাজ করে- যেমন, 'সবাই তো দেরিতে আসে, আমিও না হয় দেরি করলাম', কিংবা 'কালকে একটু বেশি সময় কাজ করেছি, আজকে না হয় একটু দেরিতেই গেলাম', অথবা 'একদিন দেরিতে গেলে কী আর ক্ষতি হবে'! এ ধরনের অজুহাত বা যৌক্তিকতায় আপনি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কারণ আপনার জীবন থেকে যে সময় নষ্ট হয়ে গেল তা আর ফেরত আসবে না। আর দেরি করার যে বদঅভ্যাস সৃষ্টি হলো তা আপনার অগ্রগতিকেই রুদ্ধ করবে। কর্মস্থলে আপনি ঊর্ধ্বতনদের চোখে দায়িত্বহীন প্রতিপন্ন হবেন।

নিজের জীবনকে সময়ানুবর্তী করে তুলে সাফল্যের পথে অগ্রসর হওয়ার এক মোক্ষম পন্থা হচ্ছে নিয়মিত মেডিটেশনে অটোসাজেশন প্রদান। মেডিটেশনে মনের বাড়িতে গিয়ে প্রতিদিন বলুন : 'আজ দিনের প্রতিটি কাজ আমার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিটি কাজ আমি সময়মতো করব। প্রতিটি অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষায় সময়ানুবর্তী হবো।'

আর বন্ধুদের, পরিচিতদের বা সহযোগীদের সময়ানুবর্তী করে তোলার জন্যে আপনি নিম্নোক্ত ৬টি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।

১. তাদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিন। তাদের ডাকুন। সময়ানুবর্তী হতে বাধ্য করুন। তারা নিয়মিত দেরি করায় আপনি কেন ক্ষুদ্ধ হচ্ছেন তা তাদের বুঝিয়ে দিন।

২. বেশি বিনয়ী হবেন না। কোনো বন্ধু বা সহযোগী পেশাগত বা ব্যবসায়িক অ্যাপয়েন্টমেন্টে পুনরায় দেরি করলে তাদের নিঃসঙ্কোচে বলুন যে আপনি দেরি পছন্দ করেন না এবং এই বলার কারণে যদি তারা অস্বস্তি বোধ করে, করতে দিন।

৩. খাওয়ার আমন্ত্রণে কোনো মেহমান যদি অস্বাভাবিক দেরি করেন বা দেরিতে আসা যদি তার অভ্যাসে পরিণত হয়ে থাকে তা হলে তার জন্যে অপেক্ষা করবেন না। আপনি আহারপর্ব শুরু করে দিন।

৪. কেউ দেরিতে আসার কোনো অজুহাত দিলে তা শোনার প্রয়োজন নেই। তাকে সরাসরি বলে দিন, এই কারণ শুনতে গিয়ে আরও সময়ের অপচয় হচ্ছে।

৫. অপেক্ষা করার জন্যে এমন জায়গা বেছে নিন যেখানে আপনি অপেক্ষা করতে অস্বস্তি বোধ করবেন না। রেস্তোরাঁয় বসে অপেক্ষা করার চেয়ে বইয়ের দোকানে গিয়ে বইয়ের উপর চোখ বুলানো অনেক বেশি স্বস্তিদায়ক।

৬. কেউ দেরি করলে আপনি অপেক্ষা না করে চলে যান। এই চলে যাওয়ার ফলেই আপনার অনুভূতি সে সহজেই বুঝতে পারবে।

নিজে সময়ানুবর্তী হওয়া ও অন্যকে সময়ানুবর্তী হতে বাধ্য করার জন্যে এই পদক্ষেপগুলোই হচ্ছে পরীক্ষিত পন্থা।