published : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
আমরা সবসময় নিজেকে অন্যের চেয়ে বুদ্ধিমান, যোগ্য ও শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরার জন্যে সচেষ্ট থাকি। কারণ বর্তমান যুগ হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বিতার যুগ, প্রতিযোগিতার যুগ। নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে না পারলে আপনি অন্যদের পেছনে পড়ে যাচ্ছেন। এই প্রচেষ্টায় আপনি কখনো কখনো সফল হচ্ছেন, হাততালি পাচ্ছেন, ফুলের মালা পাচ্ছেন, আনন্দে আপনার বক্ষ স্ফীত হচ্ছে, চেহারা উজ্জ্বল হচ্ছে। কিন্তু রাতে যখন বিছানায় একা ঘুমুতে যাচ্ছেন, নিজেকে নিয়ে যখন একান্তে ভাবছেন তখন আপনি নিজেও স্বীকার করবেন যে, আপনার নিজেরও ব্যক্তিত্ব উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। অনেক গুণ আছে যা আপনি কাজে লাগান নি, অনেক কৌশল রয়েছে যা আপনি আয়ত্ব করতে পারেন নি। মেধার অনেক ক্ষেত্রকে বিকশিত করতে পারেন নি। তাই নিজের উন্নয়নের সুযোগও রয়েছে। এর ফলে আমরা প্রতিদিন বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করি, আমরা পরিবর্তিত হই। আর এই পরিবর্তনের লক্ষ্য সবসময় থাকে আরও ভালো মানুষ হওয়ার। প্রতিদিনই আমরা চাই আমাদের ব্যক্তিত্ব আরও আকর্ষণীয় হোক, আরও সুন্দর হোক, প্রভাব বলয় আরও বাড়ুক। আমরা আমাদের ভুল ভ্রান্তিগুলো কাটিয়ে উঠতে পারলেই আমাদের ব্যক্তিত্ব আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে।
ব্যক্তিত্বের উন্নয়ন বা আত্ম উন্নয়নের জন্যে আমরা কিছু ছোটখাট কর্মসূচি বা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারি, যা আমাদেরকে উন্নত মানবে রূপান্তরিত করবে।
আমরা প্রতিনিয়তই কিছু কাজ করতে চাই। আমরা মনে করি যে, এই কাজগুলো করতে হবে। কিন্তু দেখা যায় যে, সে কাজগুলো করা হয় না, জমতে থাকে। যেমন, চিঠি লিখব কিন্তু লেখা হয় না। ব্যায়াম করে ওজন কমাব, তাও করা হয় না। কিছু প্রয়োজনীয় কাজ যা করা দরকার, তাও জমে থাকে। এই কাজগুলো যেন জমে থাকতেই ভালবাসে, অথবা আমাদের মধ্যেই এমন আলস্য রয়েছে যা কাজকে পিছিয়ে দেয়। হয়তো আমরা ব্যস্ত অথবা ক্লান্ত বা সময় মতো কাজটি করতে মন চাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে আমাদের আসল সমস্যা হচ্ছে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের অভাব। তাই কাজ করার আগে আমাদের লক্ষ্যস্থির করতে হবে।
লক্ষ্য সবসময় মানসিক প্রেরণা যোগায়, আপনার শক্তিকে বাড়িয়ে দেয়। তবে গবেষকরা দেখেছেন যে, লক্ষ্য যদি খুব ভাসা হয় তাহলে তা আদৌ কার্যকরী হয় না। আর বাস্তবতার সাথে লক্ষ্যের সঙ্গতি না থাকলে তাও ফলপ্রসূ হয় না। আমরা অনেক সময় অবাস্তব, অসম্ভব লক্ষ্য স্থির করি। যে সময়ের মধ্যে যে কাজ করা সম্ভব নয় অনেক সময় আমরা সেই সময়ের মধ্যে সেই কাজগুলো করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসি। পরিণামে সে কাজগুলো করা হয় না। তাই লক্ষ্যস্থির করার আগে আপনাকে নিশ্চিত হতে হবে যে আপনার লক্ষ্য সুনির্দিষ্ট, চ্যালেঞ্জমূলক কিন্তু অর্জনযোগ্য। আর এ লক্ষ্য অর্জনের সুনির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। তাহলেই আপনি তা বাস্তবে রূপদান করতে পারবেন। আপনার কার্যপ্রণালীর মধ্যে একটু বৈচিত্র্য নিয়ে এলে নিজেকে লক্ষ্যাভিসারী রাখা সহজ হবে। আপনার রুটিনের মাঝে ছোটখাট পরিবর্তন কাজের উদ্দীপনা বাড়িয়ে দেবে। যেমন, ভিন্ন পথে কর্মস্থলে যাওয়া, নতুন মানুষের সাথে পরিচিত হওয়া নতুন কিছু কাজ সৃষ্টি করা।
যখন কোনো কাজ একেবারে নিরানন্দ মনে হয় এ রকম একঘেয়েমিপূর্ণ কাজ সম্পন্ন করতে পারার জন্যে নিজেকে পুরস্কৃত করুন। সে পুরস্কার যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন।
আপনি নিজেকে যখন পছন্দ করতে শুরু করবেন তখনই আপনি আত্মবিশ্বাসী ও সৃজনশীল হয়ে উঠবেন। চেহারায় প্রশান্তি আসবে, বুক টান টান করে হাঁটতে চাইবেন। কণ্ঠস্বরে বলিষ্ঠতা আসবে। দৈনন্দিন কাজের বাধাগুলো আপনার কাছে সহনীয় মনে হবে। তাই নিজের সম্পর্কে ধারণাকে উন্নত করার জন্যে আপনাকে সচেষ্ট থাকতে হবে। আপনার কাজের প্রশংসাসূচক চিঠি, নোট, যে-কোনো প্রশংসাপত্র, মানপত্র, সার্টিফিকেট এগুলোকে সযত্নে একটি ফাইলে রেখে দিন। কোনো কারণে কখনও হতাশা সৃষ্টি হলে বা মন খারাপ লাগলে এই কাগজগুলোর দিকে তাকান। উল্টান। আপনি উদ্দীপনা ফিরে পাবেন।
যোগ্যতাগুলোকে বেশি করে কাজে লাগান। গুণগুলোকে যত বিকশিত করবেন, দোষ তত ঢাকা পড়ে যাবে। যখন সময় পাবেন তখন দোষগুলো নিয়ে ভাববেন। নিজের সীমাবদ্ধতা নিয়ে চিন্তা করে রাতের ঘুম নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই।
নেতিবাচক চিন্তাকে পুরোপুরি বাদ দিন। নিজের কাজ করার ক্ষমতা ও শক্তি সম্পর্কে বেশি করে ভাবুন। প্রয়োজনে আপনি কি কি পারেন তার লিস্ট তৈরি করুন। যখনই কাউকে অভিনন্দিত করার সুযোগ পান তাকে অভিনন্দন জানান। আপনার অভিনন্দন তাকে খুশি করার সাথে সাথে আপনার মধ্যেও আনন্দের সঞ্চার করবে। প্রয়োজনে ঝুঁকি নিতে শিখুন। ঠাণ্ডা মাথায় হিসেব করে ঝুঁকি নিতে না পারলে বড় কিছু করা যায় না। ঝুঁকিতে যে সবসময় আপনি জয়ী হবেন তা নয়। তবে ঝুঁকি নিয়ে হেরে গেলেও আপনি তা থেকে শিখতে পারছেন।
প্রয়োজনে নিজেকে নতুনভাবে উপস্থাপিত করুন। চেহারায় কিছু পরিবর্তন, গোঁফ, দাড়ি বা চুলের নতুন বিন্যাস, নতুন পোশাক পরিচ্ছদ এমন কি জুতোয় নতুন করে পলিস লাগিয়ে আপনার ব্যক্তিত্বের প্রকাশকে উন্নত করতে পারেন।
হাতে সময় থাকতেই কাজ শুরু করুন। যারা দেরিতে কাজ শুরু করে তারা এক অর্থে অত্যন্ত আশাবাদী। তারা মনে করেন দেরিতে করলেও ঠিক সময়ে কাজ শেষ করতে পারবেন। বুঝতে পারে না, অন্যরা এই দেরি করাটাকে কখনো ভালো চোখে দেখে না। কোথাও দেরিতে উপস্থিত হওয়া অন্যদের মনে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করে। তাই সবসময় সময়মত হাজির হোন। সময়ানুবর্তী হওয়ার জন্যে ঘড়ির কাঁটা পাঁচ মিনিট এগিয়ে রেখে কোনো লাভ হয় না। বরং সময়মত কোথাও পৌঁছাতে হলে হেঁটে রওনা দিলে যে সময় লাগবে তার পনেরো মিনিট আগে রওনা দিন। আর যানবাহনে করে যেতে হলে কমপক্ষে আধঘণ্টা সময় হাতে রাখুন। তাহলে জ্যামে আটকা পড়লেও আপনি সময়মত হাজির হতে পারবেন।
সময় বাঁচানোর জন্যে আপনার কর্মদিবসগুলোতে এক ঘণ্টা কম ঘুমান। ঘুম থেকে প্রতি কর্মদিবসে এক ঘণ্টা বাঁচাতে পারলে বছর শেষে আপনি দেখবেন পুরো একটা মাস পেয়ে যাচ্ছেন। আর এই অতিরিক্ত একটি কর্মমাস যোগ করতে পারায় আপনি আপনার অনেক অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে পারবেন। আর অহেতুক রাত জেগে কাজ করার চেষ্টা করবেন না। কারণ অধিকাংশ মানুষের বেলায় সকালেই তার কর্মক্ষমতা বেশি থাকে।
সবকিছু নিখুঁতভাবে করার চেষ্টাও এক অর্থহীন প্রচেষ্টা। বেশিরভাগ সময় নিখুঁত করতে গিয়ে আমরা দেরি করে ফেলি। তাই আপনার কাজ যদি আশি ভাগ নিখুঁত আর বিশ ভাগ মোটামুটি হয় তাহলেই আপনি উতরে গেলেন। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আপনি অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গেলেন। সময়মত কাজ শেষ করতে হলে অহেতুক টেলিফোন ও অবাঞ্ছিত দর্শনার্থীর হাত থেকে নিজেকে কৌশলে রক্ষা করুন। অবাঞ্ছিত দর্শনার্থী হলে আপনি চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পড়ুন। সরাসরি তাকে প্রশ্ন করুন যে, আমি আপনার কী উপকারে আসতে পারি? সরাসরি প্রসঙ্গে চলে যান। দাঁড়িয়েই আলাপ শেষ করে তাকে বিদায় দিন। অহেতুক ভদ্রতার খাতিরে খোশগল্পে গিয়ে নিজের মূল্যবান সময় নষ্ট করবেন না। অপ্রয়োজনীয় টেলিফোনের জবাব দেয়ার জন্যে দিনের সবচেয়ে অফলপ্রসূ সময় বেছে নিন, যেমন দুপুরের খাবারের আগে অথবা বিকেলে অফিস থেকে যাওয়ার আগে এই জবাবী টেলিফোন করতে পারেন।
ক্রোধ অনেক সময়ই প্রবঞ্চিত হওয়া বা অসহায়ত্বের অনুভূতির প্রকাশ ঘটায়। আমরা উত্তেজিত হয়ে উঠি, উত্তেজনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই কিন্তু উত্তেজনাকে নিয়ে কি করব তা বুঝতে পারি না। আপনি ক্রোধের কারণগুলো খুঁজে বের করুন। সে কারণগুলোকে দূর করার জন্যে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করুন, দেখবেন রাগ উত্তেজনা কমে গেছে।
পড়াশুনা করুন জীবনের জন্যে আত্মনির্মাণ ও আত্ম আবিষ্কারের জন্যে। আত্মনির্মাণ ও আত্ম উন্নয়নমূলক বই পড়ুন। শরীর-স্বাস্থ্য, খাবার, ব্যায়াম ইত্যাদি বিষয়ক প্রয়োজনীয় বইপত্র সংগ্রহ করে পড়ুন। সফল মানুষদের জীবনী গ্রন্থসমূহ সংগ্রহ করে পড়ার সাথে সাথে চিরায়ত সাহিত্য কর্মের মাঝে অবসর সময়ে নিজেকে ডুবিয়ে রাখুন। জীবন সম্পর্কিত জ্ঞানই আপনার চলার পথকে সহজ করতে পারে।
নিজের ভেতরে ডুব দেয়া ছাড়া নিজের সম্ভাবনাকে আবিষ্কার করা যায় না। তাই প্রতি রাতে শোয়ার আগে বিছানায় গিয়ে চুপচাপ বসুন। ধ্যানের প্রক্রিয়ায় নিজের দেহমনকে প্রশান্ত করুন। নিজের সারাদিনের কাজের পর্যালোচনা করুন। ভুলগুলোর জন্যে নিজের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিন। ভালো কাজের জন্যে নিজেকে ধন্যবাদ দিন। নিজের যোগ্যতার প্রতি নতুনভাবে বিশ্বাস স্থাপন করুন। তারপর ঘুমিয়ে পড়ুন।
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আবার ধ্যানে বসুন। সারাদিনের কাজের পরিকল্পনা করুন। নতুন বিশ্বাসে নতুন দিনের কাজ শুরু করুন। আপনার ব্যক্তিত্ব যেমন উন্নত হবে তেমনি আপনি ধীরে ধীরে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করবেন।