published : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
আমরা জানি, মন আমাদের অসুস্থ করে তুলতে পারে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি, আমাদের ভয়, সন্দেহ, প্রতিক্রিয়া ও সংস্কার থেকে বেশির ভাগ রোগের জন্ম হয়। মানসিক চাপ, টেনশন, দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা মোকাবিলার পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া দ্বারাই নির্ধারিত হয় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের অবস্থা। আবার মন দ্বারাই নির্ধারিত হয় কি অসুখে আমরা আক্রান্ত হবো এবং কতদিন বেঁচে থাকব। অবশ্য মন যেমন আমাদের রোগব্যাধি ও মৃত্যুর কারণ হতে পারে, তেমনি তা নিরাময়, প্রশান্তি ও সুস্বাস্থ্যের মাধ্যমও হতে পারে।
ডা. ভেরনন কোলম্যান মনের শক্তির উপর দীর্ঘ গবেষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, আমরা যদি আমাদের আবেগ এবং প্রতিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে পারি তাহলে মন আমাদের দেহের বিপক্ষে নয় বরং দেহের পক্ষে এক প্রচণ্ড শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। তিনি বলেছেন, মনের শক্তিকে বাস্তব ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে প্রয়োগ করে আমরা আমাদের শরীরকে টেনশনপ্রুফ করে তুলতে পারি।
মনের শক্তি প্রয়োগ করে সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা ও দেহকে টেনশনপ্রুফ করে তোলার জন্যে নিম্নোক্ত দশটি ধাপ অত্যন্ত ফলপ্রসূ হতে পারে।
আত্মবিশ্বাসের অভাব থাকলে আপনি ক্রমান্বয়ে টেনশনে আক্রান্ত হবেন। নিজের উপরে যদি আস্থা না থাকে তাহলে অন্যদের দাবি ও প্রত্যাশার মুখে নিজেকে অসহায় মনে হবে। আর আপনি সহজেই টেনশনজনিত রোগে আক্রান্ত হবেন। আত্মবিশ্বাসহীনতা কাটিয়ে ওঠার জন্যে নিজেই শক্তির উপর বেশি করে বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। এর একটি সুন্দর উপায় বলে দিচ্ছি। কাগজ-কলম নিয়ে বসে নিজেকে একজন বিজ্ঞাপন লেখক হিসেবে কল্পনা করুন। মনে করুন, আপনি একটি পণ্য এবং সম্ভাব্য ক্রেতাদের কাছে এই পণ্য বিক্রি করতে হবে। তাই নিজের সম্পর্কে বলতে পারেন এমন ভালো ভালো সকল কথা চিন্তা করুন। আর নিজের যা যা গুণ রয়েছে সব এক এক করে লিখুন। গুণাবলী লেখার সময় নিজের কিছু কিছু গুণকে একটু অতিরঞ্জিত করে ফেলুন, কারণ সব বিজ্ঞাপনেই তা করা হয়। নিজের দুর্বলতার কথা যা আপনি ভালো করেই জানেন তা নতুন করে দেখার কোনো প্রয়োজনই নেই। নিজের গুণাবলীর তালিকা বারবার পড়ুন।
অভিজ্ঞতা সাক্ষ্য দেয় যে, যারা সবসময় অন্যকে সন্তুষ্ট করতে চেষ্টা করে, অন্যে কি মনে করবে না করবে তা ভাবে, তারা বেশি টেনশনে ভোগে। আর যারা নিজের ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকে গুরুত্ব দেয় তাদের টেনশন তুলনামূলকভাবে কম। তাই বলে নিষ্ঠুর বা অভদ্র হওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার শুধু নিজের প্রয়োজন এবং ইচ্ছা সম্পর্কে আর সজাগ হওয়ার দরকার এবং আপনি যা পছন্দ করেন সে ব্যাপারে আপনার সুস্পষ্ট বক্তব্য থাকা উচিত। নিজের জন্যে দৃঢ় হতে শিখুন। আপনি যখন সত্যি সত্যি কিছু একটা করতে চান না তখন বিনয়ের সাথে 'না' বলুন। আপনি অনুভব করবেন, এই 'না' বলতে পারায় আপনি স্বস্তি পেয়েছেন এবং আপনার টেনশন কমে গেছে। আর যাকে 'না' বললেন তিনিও দেখবেন ব্যাপারটিকে সহজভাবে নিয়েছেন। যা করবেন না কখনোই তা বলবেন না। কারণ করব করব বলে দীর্ঘসূত্রিতা আপনার যেমন টেনশনের কারণ হবে, তেমনি পক্ষেরও তা বিরক্তির উদ্রেক করবে।
বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের দরকার কিছু প্রত্যাশা, অর্জন করার জন্যে কিছু লক্ষ্য, দেখাশোনা করার মতো বা লালন করার মতো কোনোকিছু। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যে ছাড়া আপনার জীবন শূন্য থাকবে। উদ্দেশ্য, লক্ষ্য এবং আশা জীবনের সকল সমস্যাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করবে। জীবনের লক্ষ্য নির্ধারণের জন্যে তারুণ্যে আপনার যা আশা-আকাঙ্ক্ষা ছিল তার একটি তালিকা তৈরি করুন। কল্পনা করুন কৈশোরে কি কি আশা ও উদ্দীপনা আপনাকে উদ্দীপিত করেছিল। এখন চিন্তা করুন সেসব স্বপ্ন ও আশার কোন্ কোনটি আপনাকে এখন উদ্দীপিত করে। আপনি অনুভব করবেন, আপনার অনেক আশা এখন আপনার নাগালের মধ্যে। আপনি ইচ্ছে করলে, প্রচেষ্টা চালালে সেসব অর্জন করতে পারেন। আর এই নতুন আশাই আপনার জীবনের লক্ষ্যে পরিণত হতে পারে।
আপনি যদি আসল সমস্যা ও তুচ্ছ সমস্যার মধ্যে পার্থক্য করতে না পারেন, কোন্ কাজ আগে করবেন এবং কোনটা পরে করবেন এবং আপনার জন্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা যদি নির্ধারণ করতে না পারেন তাহলে আপনি টেনশনে আক্রান্ত হবেন। অহেতুক উৎকণ্ঠার বোঝা বাড়তে থাকবে। আপনি যদি সচেতনভাবে গুরুতর সমস্যা ও তুচ্ছ সমস্যার মধ্যে পার্থক্য স্থাপন না করেন তাহলে মন সবগুলো সমস্যাকে গুরুতর সমস্যা হিসেবে ধরে নেবে। তাছাড়া আপনি যদি তুচ্ছ জিনিস নিয়ে চিন্তা করেন তাহলে গুরুতর সমস্যা সমাধানে পিছিয়ে পড়বেন। অবশ্য সমস্যা বা কাজের অগ্রাধিকার নির্ধারণ কঠিন কিছু নয়। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে আপনার জন্যে কোনটা গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ নয় এমন কাজে সময় নষ্ট করা বোকামি মাত্র। আপনার জীবনে কি কি বিষয় মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে তার একটি তালিকা প্রস্তুত করুন। তারপর সিদ্ধান্ত নিন, বিষয়গুলোর মধ্যে কোনটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ। তাহলেই দেখবেন, মানসিক চাপ কমে গেছে।
আপনি যদি চাপা স্বভাবের হয়ে থাকেন এবং সবকিছুই নিজের মধ্যে চেপে রাখতে চান তাহলে আপনাকে আবেগ প্রকাশ করতে শিখতে হবে। আপনি যদি দুঃখ পান এবং কাঁদতে ইচ্ছে হয় তাহলে কাঁদুন, হাউমাউ করে কাঁদুন। গবেষকরা দেখেছেন আবেগজনিত কারণে চোখে যে পানি আসে সে পানির রাসায়নিক গঠন ধুলাজনিত কারণে সৃষ্ট চোখের পানির রাসায়নিক গঠন থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। কান্না জিনিসটি দুশ্চিন্তা ও বিষণ্নতা প্রতিরোধক। তাই কাঁদতে ইচ্ছে করলে লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই- নিঃসঙ্কোচে কাঁদুন।
রাগ ও ক্রোধ প্রকাশ করে ফেলতে হবে। কারণ রাগ আপনার জন্যে দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ও আর্থিক ক্ষতির কারণ হতে পারে। ক্রোধ জমিয়ে রাখলে তা আপনার ক্ষতির কারণ হতে পারে। বিশেষ পরিস্থিতিতে রাগ অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। কোনো কারণে আপনার যদি রাগ হয়ে থাকে, প্রকাশ করে ফেলুন। আপনি যদি রেগে গিয়ে থাকেন, বলুন, আপনি এই কারণে রাগ করেছেন আপনার যদি মনে হয় কোনো শারীরিক কার্যক্রমের মাধ্যমে রাগ প্রকাশ করা দরকার তাহলে তাই করুন। ফুটবলে জোরে একটা লাথি মারুন, দেয়ালে জোরে ২/১টা থাপ্পড়ও মারতে পারেন। কিংবা বাথরুমের কল ছেড়ে জোরে জোরে কথা বলে রাগকে কমিয়ে ফেলতে পারেন। রাগ নিজের মধ্যে পুষে রাখবেন না, যে কোনো উপায়ে একে প্রকাশ করুন। আপনার ভিতরের টেনশন কমে যাবে।
আমরা মনে করি, অতিব্যস্ততা ও উৎকণ্ঠা মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু কর্মহীনতা ও একঘেয়েমিও একইভাবে মানসিক চাপ ও উৎকণ্ঠার কারণ হতে পারে। আপনার যদি মনে হয় জীবন একেবারে একঘেয়ে হয়ে উঠেছে তাহলে কিছু শখের কাজকর্ম নিয়ে মেতে উঠুন। এটি যেমন কোনোকিছু সংগ্রহের কাজ হতে পারে, তেমনি হতে পারে কোনো সেবামূলক তৎপরতা। আপনি ভালবাসেন এমন কিছু তৎপরতা বা অন্যের উপকার হয় এমন কোনো কাজে জড়াতে পারলে আপনি নিশ্চয় গর্ব অনুভব করবেন। আর মাঝে মাঝে ঝুঁকি নিতে ভয় পাবেন না। ব্যর্থতার আশঙ্কা রয়েছে এমন কাজের ঝুঁকিও কখনও-সখনও নিতে পারেন। এতে একঘেয়েমি দূর হবে।
হাসি কিভাবে মানবদেহে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে তা এখনো রহস্যাবৃত। কিন্ত হাসি দমকে স্বাভাবিক করে, রক্তসঞ্চালন প্রক্রিয়াকে সুন্দর রাখে, রক্তচাপ কমায় এবং অভ্যন্তরীণ নিরাময় হরমোন সরবরাহ বৃদ্ধি করে। তাই প্রতিদিন হাসার জন্যে নতুন নতুন উপলক্ষ সৃষ্টি করুন। এজন্যে প্রথম, হাস্যোজ্জ্বল, সুখী ও রসিক লোকদের সাথে যতদূর সম্ভব সময় বেশি কাটানোর চেষ্টা করতে থাকুন। দ্বিতীয়ত, মজার মজার বই, কমিক, কার্টুন পড়ুন। এছাড়া শিশুদের সাথে কৌতুক, খেলাধুলা ও মজা করুন।
মমতা ও প্রেম এক সর্বপ্লাবী সঞ্জীবক শক্তি। যে কোনো বয়সের নরনারী একটি উষ্ণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থেকে লাভবান হতে পারেন। আমেরিকার ইনস্যুরেন্স কোম্পানিগুলো পরিসংখ্যান নিয়ে দেখেছে যে যদি কোনো স্ত্রী প্রতিদিন সকালবেলা অফিসে যাওয়ার আগে স্বামীকে চুমু দিয়ে বিদায় জানায় তাহলে যাত্রাপথে স্বামীর দুর্ঘটনার আশঙ্কা অনেক কমে যায় এবং স্বামীর আয়ু গড়পড়তা পাঁচ বছর বেশি হয়ে থাকে।
কারো প্রতি মমতা বা ভালবাসা থাকলে আপনার অনুভূতিকে গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। কাউকে ভালবাসলে তাকে সে কথা বলার মধ্যে কোনো অন্যায় নেই। ঘর থেকে বেরোনোর সময় হাসিমুখে বিদায় নিন বা দিন। প্রিয়জন, বন্ধু বা সন্তান-সন্ততির প্রতি আদর, মমতা ও প্রেমের শালীন প্রকাশে কখনোই সঙ্কোচ করবেন না।
টিভি বা সিনেমার পর্দার সামনে বসলেই আপনার শরীর-মন শিথিল হবে এমন কোনো কথা নেই। টিভির সামনে বসে থাকা সত্ত্বেও দিনের সমস্যা ও উৎকণ্ঠা আপনার মনোলোকে বিচরণ করতে পারে। তাই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় শিথিলায়ন করুন। কল্পনাকে আপনার চিন্তা ও দেহের উপর কর্তৃত্ব করতে দিন। দরজা বন্ধ করে আধ ঘণ্টার জন্যে হাত-পা ছেড়ে কার্পেটের উপর বা শক্ত বিছানায় শুয়ে পড়ুন। লম্বা দম নিতে নিতে শরীরকে শিথিল হয়ে যেতে দিন। কল্পনাকে আপনার সবচেয়ে সুখকর স্থান বা স্মৃতিতে বিচরণ করতে দিন। প্রাকৃতিক দৃশ্যের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলুন। পাখির কলতান শুনুন। ফুলের গন্ধ অনুভব করুন। আকাশের নীলিমা আর গাছের পাতার সবুজের বৈচিত্র্যে নিজের দৃষ্টিকে হারিয়ে ফেলুন। আপনি শিথিলায়নের গভীর স্তরে পৌঁছে যাবেন। দেহ-মন যেমন প্রশান্ত হয়ে উঠবে, তেমনি সেই অবস্থায় নিজের মনোদৈহিক উন্নয়নের জন্যে অটোসাজেশন ফলপ্রসূ ভূমিকা রাখতে পারবে।