হাদীস শরীফ – কেন পড়বেন? কীভাবে পড়বেন?

তিনি মানুষকে মুক্ত করার পথ খুঁজেছিলেন।

তিনি অনুভব করেছিলেন যে মানুষ আসলে মুক্তি চায় – অশান্তি থেকে, অভাব থেকে, নিরাপত্তাহীনতা থেকে, অবিচার থেকে, শোষণ থেকে। তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছিলেন মানুষের কষ্ট। মানুষের দুঃখ থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজতেই তিনি বছরের পর বছর নিমগ্ন হয়েছিলেন সাধনায় ও প্রার্থনায়।

জীবদ্দশায় তাই তিনি রেখে গিয়েছেন এমন কিছু বাণী উপদেশ যা স্থান-কাল ভেদ করে প্রতিটি মানুষকে নিয়ে যেতে পারে মুক্তির পথে শান্তির পথে সাফল্যের পথে।

সে বাণীগুলোরই বাংলা মর্ম অনুবাদ নিয়ে হাদীস শরীফ। হাদীস শরীফের প্রতিটি বাণী প্রতিটি কথা আমাদের জীবনকে পালটে দিতে পারে – সমস্যাকে রূপান্তরিত করতে পারে সম্ভাবনায়, সীমাবদ্ধতাকে শক্তিতে, অন্ধকারকে আলোতে। ব্যক্তিজীবন, শারীরিক মানসিক আত্মিক জীবন, পারিবারিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন বদলে যেতে পারে, যোগ হতে পারে নতুন মাত্রা, উন্মোচিত হতে পারে নতুন দিগন্ত।

যেমন, কেউ যদি একটি গুপ্তধনের মানচিত্র পায় তাহলেই কি সে গুপ্তধনের অধিকারী হয়ে যায়? তা কিন্তু হয় না। তাকে অনেকটা পথ পাহাড় পর্বত পাড়ি দিয়ে মানচিত্র অনুসরণ করে জায়গামতো পৌঁছাতে হয়, তবেই সে উদ্ধার করতে পারে গুপ্তধন।

একইভাবে এই বইটিও আমাদের জীবনের জন্যে তেমনি একটি মানচিত্র। বইটি শুধু হাতে রাখলেই হবে না, এক দুবার পড়লেই হবে না। এটিকে অনুসরণ করে জায়গামতো পৌঁছাতে হবে আমাদেরকেই। তবেই মিলবে সাফল্যের সন্ধান। আমরা পৌঁছাতে পারব সেখানে যেখানে নবীজী (স) আমাদেরকে নিতে চেয়েছেন – ইহকাল ও পরকালীন সাফল্যের শিখরে।

শুরু করুন আপনার দৈনন্দিন চিন্তাধারা ও জীবনাচার নিয়ে

আমরা যা ভাবি যা চিন্তা করি, দিন শেষে আমরা কিন্তু তা-ই। অনেক সময় অনেক ছোট ছোট ভুল চিন্তা, আচার আচরণ আমাদের মধ্যে পারিপার্শ্বিকতার কারণে বা নানান কারণে চলে আসে। আর এখন তো নিউজ মিডিয়া, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাবে নানাভাবে আমাদের মধ্যে অশুদ্ধ চিন্তাধারা ও দৃষ্টিকোণ খুব সূক্ষ্মভাবে প্রবেশ করছে। কিন্তু ভুল চিন্তাধারা ভুল আচার কেবল ভুলের গন্তব্যেই নিয়ে যেতে পারে।

তাই প্রথমে চিহ্নিত করুন নবীজীর কোন বাণীগুলো আপনাকে নতুন করে চিন্তা করতে বা ভাবতে শেখায়। যেরকম, ২৮ নাম্বার হাদীসে বলা আছে,

“মানুষকে ভালো ভাবা সঠিক ইবাদতের অংশ”

আপনি কি মানুষকে ভালো ভাবেন? নাকি সবাই খারাপ এমন নেতিবাচক ধারণা পোষণ করেন? বা ভালো ভাবলে পরে যদি খারাপ হয়, এমন নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন?

যদি তাই হয় তবে এই হাদীসটি আপনাকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে এবং তা হবে আপনার কল্যাণেই।

পুরো বই জুড়ে এমনি অজস্র হাদীস আছে যা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ভুল চিন্তা ভাবনা অভ্যাসগুলো শুধরে দিতে পারে।

এরকম বাণীগুলোকে চিহ্নিত করুন এবং নিয়মিত চোখ বুলান। স্রষ্টার রহমত প্রার্থনা করুন। নিশ্চয়ই আপনি আপনার কল্যাণের পথে অনেকটা অগ্রসর হবেন।

আপনার কাজই নির্ধারণ করবে আপনি কে

আমরা সবাই কিছু না কিছু কাজ করছি প্রতিনিয়ত – হতে পারে সেটা জ্ঞানার্জনের জন্যে, জীবিকার জন্যে, সংসারের জন্যে বা নিজের জন্যে। যে কাজটাই আমরা করছি সে কাজটা আসলে কীভাবে করা উচিৎ? কাজটাকে কীভাবে দেখা উচিৎ? কীভাবে কাজ করলে স্রষ্টার রহমত যুক্ত হবে? কীভাবে কাজ করলে অভিশপ্ত হবে? এর উত্তর আছে হাদীস শরীফের কর্ম অধ্যায়ে।

আসলে আমাদের কাজগুলো আমাদেরকে পরিশুদ্ধ করে এবং সেটা যে-কোনো কাজ হতে পারে। নবীজী তার জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র এতটা সফলভাবে পরিচালনা করতে পেরেছিলেন কারণ তিনি প্রতিটি কাজকে গুরুত্ব দিয়ে করেছিলেন। এবং তিনি সেভাবেই করেছেন যেভাবে কাজের সাথে স্রষ্টার রহমত যুক্ত হতে পারে।

তাই নিজেকে একটু সময় নিয়ে প্রশ্ন করুন, যে সারাদিন কী কী কাজ করেন আপনি? আপনার কাজগুলোকে আপনি কীভাবে দেখেন? আপনার লক্ষ্য কী? আপনার কাজের সীমাবদ্ধতাগুলো কোথায়?

এরপর হাদীস শরীফে নবীজীর কর্ম নিয়ে বাণীগুলো পড়ুন। যে বাণীগুলো আপনার মনে বিশেষ দাগ কাটে তা চিহ্নিত করুন। নিয়মিত চোখ বুলান – দিনে একবার বা ৩ দিনে একবার বা সপ্তাহে একবার। নবীজীর ফরমুলাগুলোকে আপনার কাজে আপনার পেশায় প্রয়োগ করতে সচেষ্ট হন।

ইনশাল্লাহ, আপনার কাজগুলো আপনাকে বহুদূর নিয়ে যাবে। আপনার সীমাবদ্ধতাগুলোকে আপনি অতিক্রম করতে পারবেন। স্রষ্টা আসলে আপনার চেষ্টাটা দেখবেন। এবং তিনি যে-কোনো উসিলায় আপনার কাজের বহুগুণ প্রতিদান দিতে পারেন।

আপনি চেষ্টা করুন, কর্মে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।

যত্ন নিন আপনার পরিবারের ও আপনজনের

নবীজী (স) যেখানেই গেছেন সেখানেই মানুষের হৃদয় তার জন্যে ভালবাসায় উদ্বেলিত হয়ে উঠেছে। এত ব্যস্ত ও কর্মপ্রিয় মানুষ হবার পরও তার পরিবার কখনো তার ভালবাসা কোনো অংশে কম অনুভব করে নি। এর একটি কারণ যে তিনি হৃদয় উজাড় করে ভালবেসেছেন। আরেকটি হচ্ছে তিনি তার পরিবারের মানুষ, কাছের মানুষ, এমনকি দূরের মানুষদেরও সেভাবে যত্ন নিয়েছেন যেভাবে নিলে তারা তার ভালবাসা অনুভব করতে পারবে।

আসলে আমরাও কিন্তু আমাদের ভালবাসি, আপনজনদের ভালবাসি এবং মানুষের মনে ভালবাসার পাত্র হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই। কিন্তু কীভাবে প্রকাশ করতে হবে, কীভাবে যত্ন নিতে হবে সেটা অনেক সময় বুঝে উঠতে পারি না। অনেক সময় আমাদের কর্তব্যগুলোও সুস্পষ্ট থাকে না আমাদের সামনে।

নবীজী মানুষের এই ঘাটতিগুলোকে লক্ষ্য করে বেশ কিছু বাণী ও উপদেশ রেখে গেছেন আমাদের জন্যে। তাই হাদীস শরীফে পরিবার ও আপনজন সংক্রান্ত বাণীগুলো পড়ুন। খেয়াল করুন কোন কোন দিকটি আপনি যথাযথভাবে পালন করছেন না। বা কোন হাদিসটি অনুসরণ করে আপনি সম্পর্কগুলোকে আরও সুন্দর আরও জোরদার করতে পারবেন।

এমন এক যুগে যখন পরিবারগুলোতে অশান্তি অস্থিরতা কলহ বিশৃঙ্খলা বিরাজমান, যখন পৃথিবীজুড়ে পরিবারগুলো ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে, আপনি নবীজীর (স) দেখানো পথ ধরে আপনার পরিবারকে রূপান্তরিত করুন প্রশান্তির উৎসে। 

ধর্ম ও ধর্মাচার

আমরা অনেকেই হয়তো নামাজ পড়ি, কিন্তু স্রষ্টার সামনে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার অনুভূতির স্তরে পৌঁছতে পারি না। বা রোজা রাখছি কিন্তু তবু যেন কিছু অপূর্ণতা রয়ে যাচ্ছে আমাদেরই ভুলের কারণে যার জন্যে আত্মিকভাবে সে তৃপ্তি অনুভব করতে পারছি না।

আসলে স্রষ্টার কাছে পৌঁছার পথে কিছু বাস্তব নিয়ম অনুসরণ করা প্রয়োজন যার মাধ্যমে পথের যাত্রা সহজ হবে এবং দ্রুত পৌঁছানো যাবে।

অনেক সময় ধর্মকে কঠিন করে ফেলা হয় বা অন্য কারো মুখে শুনে আমরা নির্দিষ্ট কোনো ধর্মাচার পালন করতে উদ্বুদ্ধ হই যা হয়তো নিজের কাছেও পরিষ্কার নয়। এর ফলে ধর্মের সে আলো আমাদের হৃদয় পৌঁছাতে পারে না।

এখন যেহেতু হাদীস শরীফ আমাদের হাতে হাতে, আমরা নিজেরাই দেখে নিতে পারি যে নবীজী আসলে কী করতে বলেছেন কীভাবে করতে বলেছেন।

ধর্ম প্রশান্তির পথ, আলোর পথ। আমরা যত আমাদের নবীজীর বাণী অনুসরণ করতে পারব তত ধর্মের গভীরে আলোর দেখা পাব। এ জন্যে আপনি ধর্মীয় যে আচারগুলো অনুসরণ করেন, যেমন নামাজ আদায়, রোজা রাখা, যাকাত দেয়া, দান করা, কোরবানি করা ইত্যাদি – এই বিষয়গুলো হাদীস শরীফে পড়ে আপনার জ্ঞানকে আরেকটু ঝালাই করে নিন। বা নতুন নতুন পয়েন্টস সংযুক্ত করুন।

প্রিয় নবীর হাত ধরে আপনার ধর্ম সাধনায় যোগ হবে নতুন দিগন্ত নতুন মাত্রা।

একটি বই যখন আপনি পড়ার জন্যে পড়বেন আর যখন বাস্তব জীবনে প্রয়োগের জন্যে পড়বেন, তখন বইটিকে আপনি ভিন্নভাবে উপলব্ধি করবেন। আপনার প্রয়োজনকে অনুভব করে হাদীস শরীফ পড়া শুরু করুন। দেখবেন বই আপনার সাথে কথা বলছে।

একজন মহাপুরুষ, একজন দার্শনিক, একজন সমাজ বিপ্লবী, একজন সফল মানুষ, এক অসাধারণ হৃদয়বান ব্যক্তি এবং পৃথিবীর বুকে শেষ নবী - হযরত মুহাম্মদ (স)। তার প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টি তাকে তার পর্যায়ে পৌঁছে দিয়েছিল।

তাই তিনি রেখে যেতে পেরেছেন এমন এক বাণী সংকলন যা ১৪০০ বছর ধরে যে-কোনো সংকটে যে-কোনো প্রয়োজনে মানুষকে মুক্তির পথ দেখাচ্ছে। এবং আগামী শত বছরেও দেখাবে।

আজকে পৃথিবীজুড়ে যে অস্থিরতা, ব্যক্তিজীবনে সামাজিক জীবনে পারিবারিক জীবনে যে অস্থিরতা– মানুষ মুক্তি খুঁজছে। কিন্তু কীভাবে খুঁজতে হয় মানুষ জানে না।

পরম করুণাময় তাই সময়ের প্রয়োজনে আমাদের কাছে শেষ নবীকে পাঠিয়েছেন।

নবীজী খুব সহজ ভাষায় সংক্ষিপ্তভাবে এবং বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করা যায় এমন পয়েন্টস আকারে আমাদেরকে তার বাণীগুলো দিয়ে গেছেন। বাংলা ভাষায় সেই বাণীগুলোকে সহজ করে তুলে ধরা হয়েছে হাদীস শরীফ বইয়ে।

এখানে প্রতিটি বাণী প্রতিটি পয়েন্ট যে-কোনো জায়গায় যে-কোনো সময়ে যে-কোনো ক্ষেত্রে শিখে আপনি সাথে সাথে প্রয়োগ করতে পারেন। এবং প্রয়োগ করতে যে খুব কষ্ট হবে তাও নয়। প্রয়োজন একটু চর্চা, একটু নিয়মিত চোখ বুলানো।

আসুন আমরা এই পবিত্র মাহে রমজানে এই নিয়ত করি যে আমরা যেন এই জ্ঞানকে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি এবং এই হাদীসটি (১৬ নং) স্মরণে রাখি –

সাধারণ বিশ্বাসীর চেয়ে অটল বিশ্বাসীকে আল্লাহ বেশি পছন্দ করেন। প্রতিটি কল্যাণকর কাজে সাহস করে ঝাঁপিয়ে পড়ো। আল্লাহর কাছে তা চাও এবং পাওয়ার জন্যে বিরামহীনভাবে লেগে থাকো। নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো। কখনো হাল ছেড়ে দিও না। কোনো বিপদ-মুসিবত এলে কখনো বোলো না যে, ‘যদি এটা না করতাম তাহলে এ বিপদ হতো না’। কারণ এই ‘যদি’ শব্দটি বিভ্রান্তির দরজা খুলে দেয়। বরং বলো, ‘আল্লাহ যা নির্ধারিত করেছেন, তা-ই হয়েছে’। (আর ভবিষ্যতে কী করতে পারো, তার পরিকল্পনা করো।)

—আবু হুরায়রা (রা); মুসলিম, ইবনে মাজাহ