বাংলাদেশি ইলিশের সাইজ কীভাবে বড় হলো? সংখ্যায় কেন এত বাড়ল?

published : ৬ অক্টোবর ২০২০

২০১৫ সাল। ঢাকায় সোয়া কেজির চারটা ইলিশ বিক্রি হলো ১ লক্ষ টাকায়। মানে প্রতিটি সোয়া কেজি ইলিশের দাম পড়েছিল ২৫ হাজার টাকা করে।

২০২০ সাল। ঢাকায় এক কেজি দুইশ গ্রাম ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০ থেকে ৮৫০ টাকায়

মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধান।

আসলে ২০২০ সালে হুট করে নেমে যায় নি ইলিশের দাম। ইলিশের দাম নামতে শুরু করেছিল ২০১৬/২০১৭ সাল থেকে।

কিন্তু কেন?

এই মাত্র কয়েক বছরে এত অস্বাভাবিক তফাৎ হয় কীভাবে? যেখানে বিশ্বজুড়ে ইলিশ উৎপাদনকারী অন্যান্য দেশে ইলিশের উৎপাদন উল্টো কমতে থাকছে, সেখানে বাংলাদেশে কীভাবে ইলিশের সাইজ এবং সংখ্যা এত ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে?

এর একটা রহস্য তো নিশ্চয়ই আছে। সে রহস্য উদঘাটন করতে চলুন আমাদের দেশের ইলিশের বর্তমান চিত্রে একবার চোখ বুলানো যাক।

দেশে গত কয়েক বছরের ইলিশ চিত্র

 • ২০০৭-০৮ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২ লাখ ৯০ হাজার টন। ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৫ লাখ ১৭ হাজার টন। ২০১৯-২০২০ সমাপ্ত অর্থবছরে সেই রেকর্ড ভেঙে এখন পর্যন্ত ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টনে উন্নীত হয়েছে। (সূত্র : ইত্তেফাক )

 • ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫ থেকে ১৩০টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। দেশে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম।

 • বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬ শতাংশই উৎপাদিত হচ্ছে বাংলাদেশে। মাত্র চার বছর আগেও এই উৎপাদনের হার ছিল ৬৫ শতাংশ। বিশ্বে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রথম স্থানে।

 • ওয়ার্ল্ডফিশের তথ্য মতে, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত, মিয়ানমার, শ্রীলংকা ও পাকিস্তানে ইলিশের উৎপাদন কমেছে। বাংলাদেশের পরই ইলিশের উৎপাদনে দ্বিতীয় স্থানে ভারত। পাঁচ বছর আগে দেশটিতে বিশ্বের প্রায় ২৫ শতাংশ ইলিশ উৎপাদিত হতো। তবে চলতি বছর তাদের উৎপাদন প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশে নেমেছে।

 • এদিকে ওয়ার্ল্ডফিশ, মৎস্য অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, এবার শুধু পরিমাণের দিক থেকেই নয়, আকৃতির দিকে থেকেও কোনও দেশ বাংলাদেশের ইলিশের ধারেকাছে নেই।

 • বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায় -তিন বছরে ইলিশের দাম কমেছে প্রায় দেড়শ শতাংশ। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে ১ কেজি বা তার ওপরে ইলিশ পাওয়া যেত মাত্র তিন শতাংশ, ২০১৮ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় পাঁচ শতাংশে। ২০১৯ সালে তা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ১০ শতাংশ। অর্থাৎ তিন বছরে বড় ইলিশের প্রবৃদ্ধি ৩০০ শতাংশেরও বেশি। (সূত্র : ইত্তেফাক )

“পাঁচ বছর যদি আমরা নববর্ষে ইলিশ না খাই, ইলিশের সাইজ বেড়ে যাবে…”

২০১৩ সাল। বৈশাখে ইলিশ মাছ বর্জনের আহ্বান জানাল কোয়ান্টাম।

কোয়ান্টামের স্পষ্ট ভাষ্য ছিল যে বৈশাখে ইলিশ মাছগুলোকে হত্যা না করে ডিম পাড়ার সুযোগ দেয়া হলে ইলিশ মাছের সাইজ বেড়ে যাবে। যদি মাত্র পাঁচ বছর বৈশাখে ইলিশ না খাওয়া হয় তাহলে বেড়ে যাবে ইলিশ মাছের ওজন এবং স্বাদ।

সাধারণ মানুষ তো বটেই, এমন কি বিশেষজ্ঞরাও সন্দিহান ছিলেন, যে বাঙালির পক্ষে বৈশাখে ইলিশ বর্জন অসম্ভব ব্যাপার। কারণ অনেকেই বিশ্বাস করতেন যে বৈশাখ মানেই পান্তা-ইলিশ। কোটি বাঙালির বর্ষবরণ করতে হবে পান্তা-ইলিশ দিয়ে।

অথচ বাঙালির ইতিহাসে বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বলে কিছু নেই। কারণ বৈশাখ হচ্ছে ইলিশ মাছের ডিম পাড়ার সময়। এ সময়ে একটি ইলিশ হত্যা মানে এক লাখ ইলিশ হত্যা!

আসলে আমাদের পূর্বপুরুষরা কখনোই বৈশাখে ইলিশ খান নি। বৈশাখে ইলিশ আমাদের কোনো ঐতিহ্য নয়, বরং ৮০-র দশকে চালু করা একটি ট্রেন্ড।

এই ট্রেন্ড শুরু করে একশ্রেণীর ব্যবসায়ী যারা এই ট্রেন্ডের মাধ্যমে নিজেদের পকেট ভারী করেছে। ট্রেন্ডের অজুহাতে চড়া দামে ইলিশ বিক্রি করেছে সাধারণ মানুষের কাছে চড়া দামে।

স্বাভাবিকভাবেই মিডিয়াতেও এর প্রচারণা পায় ব্যাপকভাবে। ফলে রাতারাতি বৈশাখে ইলিশ খাওয়াটা স্ট্যাটাস সিম্বল হিসেবে স্বীকৃতি পায়। এর ফলে লাখো বাঙালির ঘরে ঘরে চলতে থাকে পান্তা-ইলিশ দিয়ে বর্ষবরণ। বর্ষবরণে ঘরে ঘরে এক একটি ইলিশের সাথে মৃত্যু হয় লাখো ইলিশের। দেশ হাঁটতে থাকে ইলিশশূন্যতার পথে।

এইজন্যে বৈশাখে ইলিশ বর্জনের আহ্বান দেয় কোয়ান্টাম। কোয়ান্টামের বাণী ছিল স্পষ্ট - পাঁচ বছর যদি আমরা নববর্ষে ইলিশ না খাই, তবে ইলিশের সংখ্যা এবং সাইজ বেড়ে যাবে।

পাঁচ বছরে লাগে নি, তিন বছরেই ফল পাওয়া গেছে

কোয়ান্টাম বৈশাখে ইলিশ বর্জন করে ২০১৩ সালে। এর তৃতীয় বছরের মাথায় আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ে গোটা জাতির মধ্যে।

২০১৬ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার মেন্যু থেকে ইলিশ বাদ দেন। ২০১৭ সালেও তিনি বৈশাখে ইলিশ বাদ দেন এবং পরিষ্কার বলেন যে, পান্তা ইলিশ খাই না পহেলা বৈশাখে।

এরপর মাছ গবেষণাকেন্দ্র ওয়ার্ল্ডফিস তাদের রিপোর্ট প্রকাশ করে - ২০১৩ সালে আমাদের দেশে ইলিশের গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম। কিন্তু ২০১৪ সালে তা বেড়ে হয়ে যায় ৫৩৫ গ্রাম। এবং ২০১৫ সালে গড় ওজন হয় ৬২৮ গ্রাম।

মাত্র তিন বছরে বদলে যায় ইলিশের ইতিহাস। ধ্বংসন্মুখ ইলিশ হয়ে ওঠে প্রাচুর্য।

কোয়ান্টামের আহ্বানের সাত বছরের মাথায় ২০২০ সালে বাংলাদেশ আজ বিশ্বে সর্ববৃহৎ ইলিশ উৎপাদনকারী দেশ। ইলিশ উৎপাদনের এই প্রবৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশকে এখন ইলিশ উৎপাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ইতিবাচকতার কী প্রভাব পড়েছে ইলিশের ওপর?

কিছু মানুষ মিলে যখন সঙ্ঘবদ্ধভাবে কল্যাণচিন্তা করে এবং সে অনুযায়ী কাজ করে - তখন সে চিন্তা, সে কাজ, সে বাণী ছড়িয়ে পড়ে দিকে দিকে। সাধারণ মানুষ একাত্ম হয় সে কল্যাণশক্তির সাথে।

যখন কোয়ান্টাম শুরু করল ইলিশ সচেতনতা এবং কোয়ান্টাম পরিবারের সদস্যরা বৈশাখে পান্তা-ইলিশের বদলে পান্তা-পিয়া বেছে নিল, তখন হাসি ঠাট্টা করার লোকের অভাব ছিল না। কিন্তু কোয়ান্টাম তার সত্যে অটল ছিল।

এরপর এর সাথে যোগ হয়েছে সাধারণ মানুষ। ইলিশ সচেতনতা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে।

পান্তা-ইলিশ এখন শুধু কিছু শোষকদের পহেলা বৈশাখের খাবার। সাধারণ মানুষ একে বর্জন করেছে। মা-ইলিশ আশ্রয় ফিরে পেয়েছে বাংলার পানিতে।

মানুষ যেরকম ইতিবাচক শক্তির ভাইব্রেশন অনুভব করে, ঠিক একই ভাবে অনুভব করে প্রাণী জগত। বাংলার ইলিশের কাছে পৌঁছে গেছে আমাদের সকলের কল্যাণশক্তির ভাইব্রেশন। যার ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে নিরাপত্তাবোধ।

আসলে যে-কোনো প্রাণীর মাঝে নিরাপত্তাবোধ তৈরি হলে তার স্বাস্থ্য বেড়ে যায়। এর প্রমাণ আমরা দেখতে পাচ্ছি এখন চোখের সামনে। ইলিশের সাইজ ইলিশ উৎপাদনকারী আর কোনো দেশে বাড়ে নি, বেড়েছে শুধু এই বাংলাতে। সারা পৃথিবীতে ইলিশের সাইজ ছোট, আমাদের দেশে মাত্র ৫ বছরের মাথায় ২০১৯ সালে ইলিশের গড় ওজন বেড়েছে ৩৫০ গ্রাম।

যখন কোনোকিছুর প্রতি মনোযোগ দেয়া হয় এবং সেটার যত্ন নেয়া হয়, তখন সে জিনিসের প্রবৃদ্ধি ঘটে।

কোয়ান্টাম একটি ছোট সঙ্ঘ। কিন্তু এখানে কিছু মানুষের মন, কিছু মানুষের আত্মা একাত্ম। এবং এই একাত্ম মনগুলো যখন দেশকে ভালবেসে, দেশের মানুষকে ভালবেসে, দেশের ইলিশকে ভালবেসে কল্যাণচিন্তা এবং কল্যাণ কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তখন এই কল্যাণশক্তির প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে।

সাধারণ মানুষ সবসময় সাহসী মানুষের পক্ষে থাকে এবং সত্যের পক্ষে থাকে।

কোয়ান্টাম স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে সাহস করেছিল, বৈশাখে তুমুল জনপ্রিয় পান্তা-ইলিশ বর্জনের ডাক দিয়েছিল এবং সাধারণ মানুষ সেই সাহসের ডাকে সাড়া দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের অনুমান ভুল প্রমাণিত করে সত্যের সাথে একাত্ম হয়েছে। দেশের ইলিশকে বাঁচাতে বৈশাখে পান্তা-ইলিশ বর্জন করেছে। তাই আজকে আমাদের পরিচয় ইলিশশূন্য জাতি নয়, বরং ইলিশ প্রাচুর্য জাতি।