published : ৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬
লিখন ফেরিওয়ালা। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় যারা যাতায়াত করেন, তাদের অনেকের চোখেই হয়তো পড়েছে ব্যতিক্রমী এই যুবককে নিজের ভ্যানে নানানরকম পণ্য বোঝাই করে যে ঘুরে ঘুরে বিক্রি করছে মানুষের কাছে।
ভ্যানের ফেরিওয়ালা আরো অনেক আছে। কিন্তু লিখনের সাথে তাদের পার্থক্য হলো, লিখন একজন শিক্ষিত যুবক। পলিটেকনিকের ছাত্র থাকা অবস্থায়ই সে চলে যায় সাউথ কোরিয়ায়। পাঁচ বছর সেখানে কাটিয়ে ভিসা শেষে যখন দেশে ফিরে আসছিল, তখন আত্মীয় বন্ধু সবাই নিরুৎসাহিত করেছিল এই বলে যে দেশের অবস্থা ভালো না। কাজকর্ম না পেয়ে বেকার বসে থাকতে হবে।
কিন্তু লিখন ফিরল। আর দশজন শিক্ষিত (!) যুবকের মতো চাকরি না খুঁজে নিজের উদ্যোগেই কাজে নেমে পড়ল। কিন্তু তার সামর্থ্য ছিল কম। আর এই কম সামর্থ্য দিয়ে যা সে করতে পারল, তাহলো এক ভ্যান বোঝাই মালামাল নিয়ে সেগুলোই ফেরি করে বেড়ানো। এবং লোকলজ্জা, পাছে লোকে কিছু বলে , পরিবারের ভ্রুকুটি সবকিছুকে উপেক্ষা করে সে নেমে পড়ল তার কাজে। আর তার প্রতিদানে এখন একটু একটু করে সচ্ছলতা আর স্বনির্ভরতার দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে লিখন। কাজটা সে এতই এনজয় করে যে, ভবিষ্যতেও সে এই কাজই করতে চায়।
ঘানার ৩৩ বছর বয়সী যুবক ইমানুয়েল। পড়াশোনা করেছেন বিজনেস স্টাডিজে। এরপর চলে যান আমেরিকায়, ক্যারিয়ারে হয়ে ওঠেন একজন একাউন্টেন্ট। কিন্তু একসময় সিদ্ধান্ত নিলেন বিদেশে আর থাকবেন না। দেশে ফিরে যাবেন ।
যেই ভাবা সেই কাজ। ওয়ান ওয়ে টিকেট কেটে একদিন চেপে বসলেন ঘানাগামী একটি বিমানে। গ্রামে ফিরে নিজের জমিতে গড়ে তুললেন আনারসের ফার্ম। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে আনারস উৎপাদন আর বাজারজাত করে পুরোদস্তর একজন কৃষক এখন ইমানুয়েল। আর বলা বাহুল্য আগের যে-কোনো সময়ের চেয়ে জীবনে সে এখন অনেক বেশি তৃপ্ত ও সুখী। প্রাচুর্যও এসেছে তার জীবনে।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্যে ইমানুয়েলের পরামর্শ, সামর্থ্য কম থাকলে অত বড় কিছু করার দরকার নেই। যা আছে, তা দিয়েই শুরু করুন। যদি গুণগত মান ঠিক রাখতে পারেন, তাহলে বাজার আপনি পাবেনই। পণ্য বিকোবে তার নিজের গুণেই।
এই লিখন, ইমানুয়েলরা আমাদের লক্ষ লক্ষ সেইসব তরুণদের প্রেরণার উৎস যারা শিক্ষিত হয়েও বেকার (!) হয়ে থাকে বছরের পর বছর! গ্রাজুয়েট আর এমবিএ ডিগ্রিধারী হয়েও যারা ঝাড়ুদারের মাত্র ৩১৯ টি পদের জন্যে দরখাস্ত করে ১৯ হাজার! পিওনের মাত্র ৩৬৮ টি পোস্টের জন্যে আবেদন করে ২৩ লাখ, যাদের ২ লাখ ২২ হাজারই ইঞ্জিনিয়ার। এমনকি যাদের মধ্যে পিইএচডি ডিগ্রিধারী ২৫৫ জনকেও পাওয়া গেছে। অথচ ঝাড়ুদার এই পোস্টটির জন্যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয় নি। আর পিওনের পোস্টটির জন্যে মাত্র মেট্রিক পাশ হলেই চলতো।
এই হচ্ছে আমাদের একশ্রেণীর তরুণসমাজ যারা ভুগছে এক প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসহীন, উদ্যমহীন, চাকর মানসিকতায়। যে দেশে অশিক্ষিত কোনো মানুষ বেকার বসে নেই, সে দেশে কাজের অভাব কীভাবে হয়! শিক্ষিত বেকার কেন থাকবে? যদি থাকে, তার মানে বুঝতে হবে সেটা শিক্ষা নয়, সেটা কুশিক্ষা।
অথচ আমাদের পূর্ব পুরুষরা ছিলেন উদ্যোক্তা, স্বাধীনজীবী আর অভিযাত্রীর জাতি। ৩০০ বছর আগে ১৭০০ সালে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ১০ লক্ষের ওপরে। ৮০ হাজার দক্ষ তাঁতীর বাস ছিল এ শহরে। যাদের হাতে বোনা সিল্ক আর মসলিন ও জামদানি যেত পারস্যে, রোমে, বাগদাদে, চীনে।
শুধু কাপড়ই না, স্টিল, লবণসহ কৃষি ও অন্যান্য শিল্পপণ্যও রপ্তানি হতো সারা বিশ্বে। ইংরেজরা আসার আগে বিশ্ব জিডিপি-র যে ২৩% উৎপাদন করতো মুঘল ভারত, তার ৫০% ই আসতো বাংলা থেকে। বাংলা ছিল মুঘল ভারতের সবচেয়ে প্রাচুর্যময়, সবচেয়ে শিল্পোন্নত মুলুক। আর ঢাকা ছিল এর বাণিজ্যিক রাজধানী। এই বাংলা থেকেই শ্রীলঙ্কা গিয়েছিলেন বিজয় সিংহ, পত্তন করেছিলেন সিংহল রাজ্যের (তার নামেই এই নাম)।
দু’শ বছরের ইংরেজ গোলামি আমাদের এমনই শৃঙ্খলিত করল যে, আজ প্রায় ১০০ বছর হয়ে গেলেও মানসিকতায় এখনো আমরা দাসত্ব ছাড়তে পারি নি। স্বদেশী ঠাকুরের চেয়ে বিদেশি কুকুরকেই আমরা শ্রেয় মনে করি। কাপড় কাচার সাবানকে বলি ‘বাংলা সাবান’ আর গায়ে মাখার সাবানকে বলি ‘বিলাতি সাবান’!
পিএইচডি ডিগ্রিধারী হয়ে পিওনের চাকরিতে দরখাস্ত করতে আমাদের লজ্জা হয় না! কিন্তু নিজের হাতে কাজ করে স্বাধীন পেশা বেছে নিতে গিয়ে আমরা মরমে মরে যাই। ভাবি, পাছে যদি লোক কিছু বলে!
এই চাকর মানসিকতা থেকেই আমাদের এখন বেরিয়ে আসতে হবে। তরুণদের জন্যে তাই কিছু পরামর্শ-
১. লেখাপড়ার পাশাপাশি শিক্ষাজীবন থেকেই চিন্তা করতে থাকুন স্বাধীনভাবে কোন উদ্যোগ আপনি নিতে পারেন।
২. সেজন্যে প্রয়োজনীয় দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগান।
৩. আপনার কাজের সহযোগী হতে পারেন, এমন ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ বজায় রাখুন।
৪. ঝুঁকি নিতে ভয় পাবেন না। পৃথিবী সাহসী মানুষের জন্যে। হিসেব করে যে ঝুঁকি নিতে পারে, সাফল্য তার ঘরেই আসে।
৫. নিয়মিত মেডিটেশন করুন। অটোসাজেশন দিন, আমি পারি, আমি করব। মেডিটেশনের আত্মমগ্নতা আপনাকে আত্মবিশ্বাস যোগাবে, যোগাবে নতুন আইডিয়া ও সৃজনশীলতা।