published : ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫
বাংলা সাহিত্য গগনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম সৈয়দ শামসুল হক। যিনি ছিলেন একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, চিত্রনাট্যকার এবং অনুবাদক। বাংলা সাহিত্যকে তিনি-ই করেছেন বহুমাত্রিক ও বিশ্বমুখী। সাহিত্যের প্রায় সকল শাখায় সাবলীল পদচারণার জন্য তাকে বলা হয় 'সব্যসাচী লেখক'।
সৈয়দ শামসুল হক ১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান মাত্র ৩১ বছর বয়সে! এখন পর্যন্ত বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত সর্বকনিষ্ঠ লেখক তিনি।
তিনি সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার একুশে পদক এবং সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা পদক স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করে যথাক্রমে ১৯৮৪ ও ২০০০ সালে। এছাড়াও লাভ করেন বহু স্বর্ণপদক, পুরস্কার ও সম্মাননা।
বাবা চেয়েছিলেন ছেলে ডাক্তার হোক। কিন্তু সৈয়দ হকের স্বপ্ন তিনি লেখক হবেন। এজন্যে বাংলা বিষয়ে লেখাপড়া করতে চেয়েছিলেন তিনি। একথা জানার পর বাবা বহুরকম চাপ দিতে থাকেন তাকে। বললেন, তুমি বিজ্ঞান পড়তে ভয় পাও বলেই ডাক্তারি পড়তে চাচ্ছ না।
বাবাকে দেখিয়ে দেয়ার জন্যে তিনি জগন্নাথ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হলেন এবং ১৯৫১ সালে ১১০০ ছাত্রের মধ্যে ফার্স্ট ইয়ারের পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন। এরপর বাবাকে বললেন, আমি দ্বিতীয় হয়েছি, কিন্তু আমি লেখকই হতে চাই। তারপরও বাবা তার সিদ্ধান্তে অনড়।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার আগেই তিনি দুই শতাধিক কবিতা লিখে ফেলেন। ১৯৫১ সালে ফজলে লোহানী সম্পাদিত ‘অগত্যা’ পত্রিকায় ‘উদয়াস্ত’ নামে তার একটি গল্পও ছাপা হয়। সেটাই ছিল তার প্রথম ছাপা হওয়া লেখা।
গল্প প্রকাশিত হবার পর তিনি লেখালেখির ব্যাপারে আরও বেশি উৎসাহিত হন এবং বাড়ি ছেড়ে চলে যান বর্তমান মুম্বাইতে। সেখানে কাজ করেন চিত্রপরিচালকের সহকারী হিসেবে।
দেড় বছর পর যখন বাড়ি ফেরেন তখন তার জেদের কাছে পরাজিত বাবা ছেলেকে দিলেন একটি মাত্র শর্ত- তুমি মানুষের কথা লিখবে। আর লিখবে সবচেয়ে ভালো কলমে, সবচেয়ে ভালো কাগজে!
১৯৫৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে বাবাকে হারান তিনি। মৃত্যুর আগে বাবা তাকে বলেছিলেন, “বাবা! তোমার ওপর অনেক দায়িত্ব রেখে গেলাম। মাথা ঠান্ডা রাখবে।”
মরণকালে সাত ভাইবোনের দায়িত্ব তিনি রেখে গেলেন সৈয়দ হকের ওপর। বিকেল চারটায় তাকে দাফন করে বাড়িতে এসে অন্যান্য দিনের মতো একগ্লাস চা হাতে নিয়ে হঠাৎ তিনি তাকিয়ে দেখেন, সামনে সাতটা ভাইবোন অসহায় পাখির মতো বসে আছে। মা পড়ে আছেন মূর্ছিত হয়ে।
তিনি এই দায়িত্ব এড়ালেন না। তার ভাষ্যমতে, ‘এক মূহূর্তের জন্যেও আমার মনে হয় নি যে, আমি পারব না। এত বছর পরে আজকে যা দেখছেন, আমাকে বা আমার ভাইবোনদের, তারা কেউ চোর নয়, বাটপার নয়, সমাজের ক্ষতিকর মানুষ নয়। প্রত্যেকে শিক্ষিত, ভদ্র, এবং বৈধ উপার্জন করছে। প্রত্যেকের নিজের বাড়ি রয়েছে ঢাকা শহরে। আমি পারব বলেছিলাম, আমি পেরেছি’।
১৯৫০-এর দশকেই প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস ‘দেয়ালের দেশ’। এ সময় চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন তিনি। তার লেখা চিত্রনাট্যে নির্মিত হয় ‘সুতরাং’, ‘কাগজের নৌকা’, ‘মাটির পাহাড়’, ‘তোমার আমার’। জাতীয়-আন্তর্জাতিক নানা পুরস্কারপ্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘গেরিলা’ নির্মাণ করা হয় তার উপন্যাস ‘নিষিদ্ধ লোবান’ অবলম্বনে।
সৈয়দ শামসুল হক চলচ্চিত্রের জন্যে বেশ কিছু গানও লিখেছেন। যার মধ্যে রয়েছে ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘তুমি আসবে বলে কাছে ডাকবে বলে’, ‘এই যে আকাশ এই যে বাতাস’।
৫৭টি উপন্যাস, ৬০টি কাব্যগ্রন্থ, ১৪টি গল্পগ্রন্থ, ১০টি নাটকসহ আরো বেশকটি প্রবন্ধ, শিশুসাহিত্য, ইংরেজি বই, স্মৃতিকথা ও মুক্তগ্রন্থের লেখক তিনি। অনুবাদ করেছেন কবি হাফিজসহ বিশ্বখ্যাত কবিদের কবিতা এবং শেক্সপিয়ারের নাটক।
‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’, ‘নুরলদীনের সারা জীবন’ তার বিখ্যাত কাব্যনাট্য।
সৈয়দ হকের আধ্যাত্মিক চেতনা সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই সেভাবে জানেন না। কিন্তু এ-ব্যাপারে বলতে তিনি কখনো কার্পণ্যবোধ করেন নি।
কোর্স প্রত্যয়নে হাজার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার পরিবার হচ্ছে সুফি পীর পরিবার। আমি বাবা হযরত শাহ সৈয়দ আলী মাহমুদের ত্রয়োদশ পুরুষ। আমার শরীরে আধ্যাত্মিক রক্ত নিশ্চয়ই প্রবাহিত আছে। আমি স্রষ্টায় বিশ্বাস করি, সৃষ্টির শক্তিতে বিশ্বাস করি। সর্বোপরি বিশ্বাস করি সকল ধর্মের সকল মানুষের ভেতরে সত্য বিরাজ করে। সেই সত্যকে যেন আমরা অনুভব করি’।
শেষ জীবনে তার ড্রইংরুমে টি-টেবিলের ওপরে থাকত কোরআনের ইংরেজি ও বাংলা অনুবাদ। আল কোরআন বাংলা মর্মবাণীটাও তিনি খুব পছন্দ করেছিলেন। এটাও তার ড্রইংরুমে টেবিলের ওপর হাতের কাছে থাকত।
যত বড় লেখকই হোন, অধ্যায়নটাকে বাদ দেয়া যাবে না
সৈয়দ হক প্রতিদিন সকালে ঘড়ি ধরে টেবিলে বসতেন। প্রতিদিন যতটুকু সময় লেখার জন্যে বরাদ্দ রাখতেন ঠিক একই পরিমাণ সময় পড়ার জন্যেও ব্যয় করতেন।
তার ভাষায়, আমি চার ঘণ্টা লিখলে চার ঘণ্টা পড়ি। আমি মনে করি, ‘মানুষের অভিজ্ঞতা দু-রকমের। পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আমার যাপিত জীবন দেখা। আর পরোক্ষ অভিজ্ঞতাটা হলো শোনা অথবা পড়া। তো পড়ার চেষ্টা করেছি। একজীবনের অর্ধেকের বেশি সময়টাই পড়েছি’।
কাজ করে যেতে হবে; আপনি বেঁচে থাকবেন কাজের মধ্য দিয়ে
তিনি বলতেন, কাজে অধৈর্য হলে চলবে না; এই জীবনের কোনো শর্টকাট নেই। মানুষ অতি সাধারণভাবে কেবল শর্টকাট খোঁজে, সময় দিতে চায় না। যিনি-ই সময় দেবেন তিনি-ই সফল হবেন।
জীবনের ৬৪টি বছর তিনি লেখালেখির কাজেই নিয়োজিত ছিলেন।
শেষের দিকে অসুস্থতা বেড়ে যাওয়ায় নিজের হাতে লিখতে পারতেন না। মুখে মুখে বলতেন, তার সহধর্মিণী আনোয়ারা সৈয়দ হক তা লিখতেন।
মারণব্যাধি ক্যান্সারও তার কাজ থেকে তাকে দমাতে পারে নি। নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও তিনি কাজ করে গেছেন।
কর্মময় মৃত্যুর মনছবি/লক্ষ্য থাকতে হবে
সৈয়দ হকের মনছবির বিবরণ তার নিজের ভাষায়- লেখক হওয়া মানেই কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে জন্মগ্রহণ করা। আর মৃত্যুর সময়ও যেন কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে মরতে পারি।
প্রকৃতপক্ষে এই কর্মময় মৃত্যুই তিনি পেয়েছেন।
মৃত্যুর মাত্র দু-মাস আগে ২৭ জুলাই ২০১৬ সালে হাসপাতালে রোগশয্যায় থাকা অবস্থায় তিনি এই কবিতাটা লেখেন-
মৃত্তিকার ঘন অন্ধকারে
মৃত্যুপরে মৃত্তিকায় এই দেহ প্রোথিত ফসল,
অন্তিম প্রার্থনা শেষে ফিরে যায় সকল স্বজন
চল্লিশ কদম দূরে পৌঁছুতে না পৌঁছুতে তখন—
বলা হয় ফেরেশতা কবরে নামে সংখ্যায় দুজন—
সম্ভবত সেই তারা যারা ছিল কাঁধের ওপরে
যখন জীবিত ছিল এই লোক, কাঁধের ওপরে
যারা প্রতি মুহূর্তের পাপপুণ্য যা কিছু সে করে
সব লিখে রাখে তারা বিবরণ বিশ্বস্ত অক্ষরে।
এখন এ কবরের মৃত্তিকার ঘন অন্ধকারে
স্বর্গীয় আলোটি ফোটে
সে আলোয় পড়া যেতে পারে
তাদের প্রতিটি পাতা—জীবিতেরা এমন ওধারে
যেতে যেতে গল্প করে—
লোকটি কি বেঁচে যেতে পারে
এইবার শেষবার—বস্তুত যে ছিল পাপী-তাপী?
আমি তো দুর্বৃত্ত হেন, এইসব নেই ভাবাভাবি!
কোয়ান্টাম মেথড কোর্সের চলমান ৪০০তম ব্যাচে অংশ নেন তিনি। কোর্সের ৪র্থ দিন প্রত্যয়ন অনুভূতি বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন কোয়ান্টাম চেতনার প্রতি, ফাউন্ডেশনের প্রতি তার মুগ্ধতার কথা।
তার কোর্সের অনুভূতি : কোয়ান্টাম মেথড চলমান ৪০০ কোর্সে বরেণ্য কবি ও বিশিষ্ট কথাশিল্পী সৈয়দ শামসুল হক
কোয়ান্টামের যে-কোনো আমন্ত্রণে তিনি সাড়া দিয়েছেন সবসময়। রক্তদাতা সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, মেডিটেশন সিডির মোড়ক উন্মোচন বা কোয়ান্টামের ডকুমেন্টারির জন্যে সাক্ষাৎকার প্রদান- সময় সুযোগ পেলে ফাউন্ডেশনের কোনো আহ্বানকেই ‘না’ বলেন নি তিনি কখনো।
২০০৯ সালে কোয়ান্টামমের ভেতরে সাংস্কৃতিক চর্চার জন্যে তৈরি হয় একটি মুক্তমঞ্চ। সৈয়দ শামসুল হকের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয় ‘সৈয়দ হক মঞ্চ’। ২০১৫ সালে তিনি সস্ত্রীক কোয়ান্টামমে পাঁচদিনের এক সফরে গিয়ে নিজেই আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মোচন করেন এর নামফলক।
সারাজীবন দেশে-বিদেশে সরকারি-বেসরকারি অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। কিন্তু কোয়ান্টামের এই সামান্য উপহারটি তাকে এতটাই আপ্লুত করেছিল যে, মঞ্চের নামফলক উন্মোচনের সময় থেকে মঞ্চে ওঠা পর্যন্ত অবিরাম তার চোখ দিয়ে অশ্রু গড়াচ্ছিল। নিখাদ মমতামাখা এ সম্মাননাকেই তিনি মনে করতেন তার জীবনের শ্রেষ্ঠ সম্মাননা। মঞ্চে উঠে নিজের অনুভূতি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে জানান, “আমি যেখানেই থাকি, আমার প্রাণ এখানে রয়ে গেল”
দেখুন – ‘সৈয়দ হক মঞ্চ’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে তার শুভেচ্ছা বক্তব্য
যেদিন তার মৃত্যু হয় সেদিন রাতেই কোয়ান্টামম মসজিদে তার জন্যে দোয়া হয়। পরদিন ছিল কোয়ান্টাম প্রোমাস্টারদের নিয়ে সজ্ঞা জালালি অনুষ্ঠান। এ প্রোগ্রামকে গুরুজী উৎসর্গ করেন তার আত্মার অনন্ত প্রশান্তি কামনায়।
পরবর্তী শুক্রবার ফাউন্ডেশনের সকল সেন্টার/শাখা/সেলে অনুষ্ঠিত সাদাকায়ন কার্যক্রমে তার রুহের মাগফিরাতের জন্যে দোয়া করা হয়।
সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম ২৭ ডিসেম্বর ১৯৩৫ সালে উত্তরাঞ্চলীয় জেলা কুড়িগ্রামে। তিনি মহাজাগতিক সফরে পাড়ি জমান ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ সালে।
আসলে নক্ষত্রের মতো জ্বলজ্বল যদি করতে হয় তাহলে লক্ষ্যকে ঠিক রেখে কাজ করতে হয় নীরবে নিভৃতে; আমৃত্যু সেটাই করে গেছেন সৈয়দ শামসুল হক। আজ তার মৃত্যুদিবসে আমরা গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি শক্তিমান এই লেখকের প্রতি।