শিশুবন্ধু জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খান স্মরণে

published : ১৫ নভেম্বর ২০২৩


ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান এবং লেখক ও গবেষক।

 

গত ৫ নভেম্বর ২০২৩ ছিল প্রবাদপ্রতিম শিশু চিকিৎসক, শিশুবন্ধু, সমাজহিতৈষী, শিক্ষাবিদ, চিকিৎসাক্ষেত্রে দক্ষ প্রশাসক, চিকিৎসা-শিল্প উদ্যোক্তা, সদালাপী, সদা সংস্কারমনস্ক এবং সমাজসেবায় স্বাধীনতা পুরস্কার এবং একুশে পদকপ্রাপ্ত জাতীয় অধ্যাপক ডা. এম আর খানের (১৯২৮-২০১৬) ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী।

https://files.quantummethod.org.bd/resize/700/-/media/image/article/article_image_of_article_for_memoir_of_dr_mr_khan_writen_by_dr__md__abdul_majid_20231115a.jpg

শিশুরা দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। মানুষের সৃজনশীল সম্ভাবনার সত্তাকে পুষ্টি দিয়ে মননশীল করে সুচিকিৎসা দিয়ে সুস্থভাবে বড় হওয়ার সুযোগ দিতে হবে এবং এ সুযোগ তার অধিকার। এই বিশ্বাসে বিশ্বাসী ছিলেন বলেই ডা. এম আর খান শিশু চিকিৎসার ওপর বিদেশে বড় ডিগ্রি অর্জন করে সেখানে উঁচু মাপের চাকরির সুযোগ-সুবিধা পরিত্যাগ করে চলে এসেছিলেন নিজ দেশে। দেশে শিশু চিকিৎসার প্রাতিষ্ঠানিক পরিচয় প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন পথিকৃতের ভূমিকায়।

কর্মজীবনে ডা. এম আর খান দেশে-বিদেশে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করেছেন। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার, কেন্ট এবং এডিনবার্গ গ্রুপ হাসপাতালে যথাক্রমে সহকারী রেজিস্ট্রার ও রেজিস্ট্রার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। তারপর দেশে ফিরে ১৯৬৩ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন।

১৯৬৪ সালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিশুস্বাস্থ্য) পদে যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগে যোগদান করেন এবং একবছরের মধ্যেই অর্থাৎ ১৯৭০ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি পান। ১৯৭১ সালে তিনি ইনস্টিটিউট অব পোস্ট গ্রাজুয়েট মেডিসিন এন্ড রিসার্চ বিএসএমএমইউ-এর (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ও ১৯৭৩ সালে এই ইনস্টিটিউটের যুগ্ম-পরিচালকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।

১৯৭৮ সালের নভেম্বরে ডা. খান ঢাকা শিশু হাসপাতালে অধ্যাপক ও পরিচালকের পদে যোগদান করেন। একই বছর অর্থাৎ ১৯৭৮ সালে পুনরায় তিনি বিএসএমএমইউ-এর শিশু বিভাগের অধ্যাপক নিযুক্ত হন এবং দক্ষতা ও সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৮ সালে অধ্যাপক ডা. এম আর খান তার সুদীর্ঘ চাকরিজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন।

সরকারি চাকরি হতে অবসর নিলেও তার বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনে বিভিন্ন সময় পেশাভিত্তিক কর্মকাণ্ড ও সেবা সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে অধ্যাপক ডা. এম আর খান নিজেকে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি বিএসএমএমইউ, আইসিডিডিআর’বি, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব চাইল্ড হেলথ এবং বারডেম-এর সিনিয়র ভিজিটিং প্রফেসর এবং অনারারি উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।

সময়-সচেতন ডা. এম আর খান জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে ব্যয় করেছেন গুরুত্বপূর্ণ কাজে। বিএসএমএমইউ-তে পেডিয়াট্রিক শিক্ষায় পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রি চালুর ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। অন্যদিকে ১৯৭৮ সালে ঢাকা শিশু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও ছিল তার অনন্য ভূমিকা। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স-এর কাউন্সিলর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের সদস্য এবং খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তিনি ছিলেন ঢাকা আহছানিয়া মিশনের কার্যবিধায়ক কাউন্সিলের সিনিয়র সদস্য, ক্যান্সার হাসপাতালের অন্যতম উপদেষ্টা সদস্য এবং বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজ-এর প্রবীনতম সদস্য। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে নতুন পেডিয়াট্রিকস ইউনিট প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে এফসিপিএস, ডিসিএইচ এবং এমসিপিএস—নতুন পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স প্রবর্তন করেন। তাছাড়া বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা, প্রশাসন ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে ডা. খানের অবদান অনস্বীকার্য। সেইসাথে ছিলেন কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের অন্যতম সুহৃদ এবং ধ্যানবিজ্ঞান চর্চার পৃষ্ঠপোষক।

https://files.quantummethod.org.bd/resize/700/-/media/image/article/article_image_of_article_for_memoir_of_dr_mr_khan_writen_by_dr__md__abdul_majid_20231115b.jpg
শিশুবন্ধু এম আর খানের হৃদয়জুড়ে ছিল কোয়ান্টাম কসমো স্কুলের শিশুরা। অশীতিপর বয়সেও তিনি তিন বার বান্দরবান লামার এই স্কুলটি পরিদর্শন করেন।

শিশু চিকিৎসায় তিনি এতটা আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন যে তিনি কোনো শিশুকে স্পর্শ করলেই মনে হতো সে অর্ধেক ভালো হয়ে গেছে। তিনি মনে করতেন—'রোগীও একজন মানুষ। আর এ রোগীটি সামাজে আমাদেরই কারো না কারো আত্মীয়স্বজন, আপনজন। রোগী যখন ডাক্তারের কাছে আসেন; তখন সাহায্যপ্রার্থী, কখনো কখনো অসহায় বটে। আর রোগীটি যদি শিশু হয় তাহলে তো কথাই নেই। ডাক্তারের কর্তব্য হবে রোগীর কষ্ট গভীর মনোযোগের সাথে ধৈর্য সহকারে শোনা, রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। রোগীকে সুস্থ করে তুলতে সঠিক রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা যেমন প্রয়োজন; তেমনি রোগীর অভিভাবকদের প্রতি ডাক্তারের সহমর্মিতা প্রদর্শন ও আশ্বস্ত করাও প্রয়োজন। সব রোগীই তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে এমনটিও ঠিক নয়। কারো কারো সুস্থ হতে সময় লাগতে পারে।' মহান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে তিনি বলতেন—হায়াত ও মউতের মালিক যেমন আল্লাহ তায়ালা; তেমনি রোগ হতে মুক্তিদাতাও তিনি। তবে রোগীর আপনজনরা এমন যেন বলতে না পারেন যে, ডাক্তার আন্তরিক ছিলেন না, ডাক্তারের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে!

অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্যে লন্ডন-আমেরিকায় যান। কিন্তু পড়াশোনা শেষ করে আর দেশে ফেরেন না। ওখানেই স্থায়ী হয়ে যান। উন্নত দেশে গিয়ে ভুলে যান পেছনে ফেলে যাওয়া এই জন্মভূমির জনগোষ্ঠীর কথা। কিন্তু ভুলতে পারেন নি ডা. এম আর খান। নিজ জেলা সাতক্ষীরার প্রতি সবসময়ই ছিল তার অদম্য আকর্ষণ। কখনো কোনো প্রসঙ্গে তার জন্মস্থান সাতক্ষীরার কথা উঠলে সুযোগমতো একটি কবিতার ক’টি চরণ দরদ দিয়ে প্রায়ই তিনি শোনাতেন সবাইকে . . . .

‘দেশের সীমানা, নদীর ঠিকানা

যেথায় গিয়েছে হারিয়ে,

সেথা সাতক্ষীরা, রূপময় ঘেরা

বনানীর কোলে দাঁড়িয়ে।’

১৯৫৬ সালে ডা. এম আর খান সস্ত্রীক লন্ডনে যান। প্রসঙ্গক্রমে তিনি বলছিলেন—পড়াশোনা শেষে চাকরির অফার পেয়েছিলেন লন্ডনের হাসপাতালেই। কিন্তু নাড়ির টানে তিনি চলে আসেন দেশে। এমআরসিপি পাস করার পর সিক চিলড্রেন হাসপাতালের প্রধান ডা. ডিকশন ডাকলেন এম আর খানকে। তিনি ওখানে ভালো সুযোগ দিতে চাইলেন। বললেন—'তোমার মেয়ে ম্যান্ডি এখানে পড়ে। তোমার স্ত্রীও এই সমাজে সম্মানিতা। তুমিও ভালো উপার্জন করো। কেন দেশে ফিরতে চাও?' ডা. এম আর খান বলেছিলেন, 'আমার দেশ খুব গরিব। এই গরিবদের চিকিৎসা করার কেউ নেই। আমরা এদেশে পড়ে থাকলে তাদেরকে দেখবে কে?' সেই মুহুর্তে তার মনে পড়ে গিয়েছিল জেনারেল মন্টেগোমারির কথা। তিনি ক্যাডেটদের বলেছিলেন, ‘Don’t forget my God, my country and my queen’ এই তিনটি কখনো ভুলো না।

হ্যাঁ, এ ধরনের দেশাত্ববোধ এবং জাতীয়তাবোধ তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল বলেই তিনি সকল লোভ-লালসাকে জলাঞ্জলি দিতে পেরেছিলেন সেদিন। ডা. ডিকশন বললেন, দেশে তোমাকে খুব স্ট্রাগল করতে হবে। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত ধর্মপ্রাণ তরুন ডা. এম আর খান আল্লাহর প্রতি অবিচল আস্থা রেখে এর উত্তরে বলেছিলেন—God will help us.

অধ্যাপক ডা. এম আর খান ছিলেন একজন লেখক এবং গবেষকও বটে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক জার্নালে তার ৩৭টি গবেষণাধর্মী রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া তিনি শিশুরোগ চিকিৎসা-সংক্রান্ত বই লিখেছেন ৭টি। যা দেশে ও বিদেশে বহুল প্রসংশিত। বইগুলো হচ্ছে : Essence of Paediatrics (প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮৯) Pocket Pediatric Prescriber (প্রকাশকাল : জানুয়ারি ১৯৮২), Essence of Endocrinology, প্রাথমিক চিকিৎসা, মা ও শিশু (প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬), আপনার শিশুর জন্য জেনে নিন (প্রকাশকাল : ২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬), শিশুকে সুস্থ রাখুন, ড্রাগ থেরাপি ইন চিলড্রেন (প্রকাশকাল : জুন ২০০৬) সহ আরো একাধিক গ্রন্থের তিনি যুগ্ম প্রণেতা।