৩১ তম বছর হোক নৈতিকতার পুনর্জাগরণের বছর

৮০-দশক এবং ৯০ এর দশকের শুরু। দেশ নিয়ে দেশের মানুষ এত হতাশ যে দেশ ছেড়ে যাওয়ার প্রতিটি সুযোগকে কাজে লাগাতে তারা মরিয়া। জনপ্রিয় টিভি নাটকের ডায়ালগ- “ট্যাকা দেন, দুবাই যামু”। অথবা “বিদেশে গিয়া ওসি-ডিসি (অনিয়ন কাটিং, ডিস ক্লিনিং) করুম, তা-ও এই দেশে থাকমু না”।

আমজাদ হোসেনের নাটকের ব্যাঙ্গা চরিত্র

'উচ্চশিক্ষার্থে বিদেশ গমন' ছিল জাতীয় দৈনিকের অন্যতম বিজ্ঞাপন।

চিত্র- উচ্চ শিক্ষার্থে বিদেশ গমন বিজ্ঞাপন

ইরাকের কুয়েত দখল এবং আমেরিকার ইরাক আক্রমণ নিয়ে বৈশ্বিক অস্থিরতাও চলমান।

সেসময় একজন মানুষ তার বিশ্বাসের কথা বলতে দাঁড়ালেন।

চিত্র- ১ জানুয়ারি, ১৯৯৩। পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে।

শ্রোতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী এবং শুভানুধ্যায়ী সাংবাদিক ও রিপোর্টারবৃন্দ।

প্রধান অতিথি জাতীয় অধ্যাপক মরহুম ডা. নুরুল ইসলাম। বিশেষ অতিথি ইতিহাসবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, সভাপতি প্রয়াত কথাশিল্পী রাহাত খান।

অনুষ্ঠানের নাম কোয়ান্টাম মেথড ক্যাসেটের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। যদিও অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল কোয়ান্টাম মেথড বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান।

শিথিলায়ন ক্যাসেট

কিন্তু অনিবার্য কারণে বইয়ের কাজ শেষ না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত ক্যাসেট প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সেটাই হয় অনুষ্ঠানের মূল উপজীব্য।

তার আগে মূল আলোচনা করেন বইয়ের লেখক শহীদ আল বোখারী মহাজাতক।

কী ছিল তার আলোচনায়?

সেসময়ের সর্বাধিক প্রচারিত জাতীয় দৈনিক ইত্তেফাকে পরদিন যে বক্স আইটেম ছাপা হয়, তার শিরোনাম ছিল- আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাকডাকা প্রশান্তি।

রিপোর্টার নাজিমুদ্দিন মোস্তান তাতে লেখেন- প্রধান বক্তা শহীদ আল বোখারী (মহাজাতক) ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় জীবনে আত্মবিশ্বাস পুনরুদ্ধারের জন্যে “অপরিমেয় শক্তির উৎস” মনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার আহবান জানান। তিনি বলেন, একমাত্র আহাম্মকেরা ভাগ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। পরিকল্পিত জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার জন্যে নেতিবাচক চিন্তার আচ্ছন্নতা দূর করে মনোবলের উদ্বোধন ঘটাইতে হইবে।

পাঠক খেয়াল করবেন, রিপোর্টার ‘অপরিমেয় শক্তির উৎস’ কথাটিকে ঊর্দ্ধ কমার মধ্যে দিয়েছেন। সাধারণত কোনো প্রকাশের ব্যাপারে দায়িত্ব নিতে না চাইলে বা সংশয় থাকলে পত্রিকাতে এরকম করার রীতি এখনও পালিত হয়।

যখন দেশে, উপমহাদেশে এবং বিশ্বে – সর্বত্র চলছে নেতিবাচকতার সঞ্চারণ, সেরকম সময়ে ব্যক্তির সম্ভাবনা সম্পর্কে, জাতির সম্ভাবনা সম্পর্কে আশাবাদের কথা এত প্রবলভাবে তিনি উচ্চারণ করেছিলেন যে সবাই হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

কিন্তু তার বিশ্বাসে ঘাটতি ছিল না, কমতি ছিল না বিশ্বাসের কথা নিয়ে নিরন্তর আহবান জানাবারও।

তারই ফলশ্রুতিতে আজ ৩ দশকের মাথায় এসে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় অর্থনীতি।

বিআইডিএস (বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ) এর বর্তমান মহাপরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. বিনায়ক সেন ৯০ এর দশকে ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির রিসার্চ ফেলো। তার একটি প্রবন্ধ ‘স্বাধীনতার বিশ বছর : অর্থনীতির চর্চা’ বইটিতে তিনি লেখেন,

ড. বিনায়ক সেনই সম্প্রতি প্রথম আলোর সাথে একটি সাক্ষাতকারে বলেছেন, বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ৭-৮% হওয়া অস্বাভাবিক নয়।

প্রথম আলোরই আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ৫ ডিসেম্বর, ২০২২- ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে বাংলাদেশ।

বৈশ্বিক ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি)পরিচালিত সমীক্ষা তুলে ধরে তারা বলে, ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

আগামী এক-দুই দশকে এক ট্রিলিয়ন তথা এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে এই দেশে। গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি যদি ৫ শতাংশেও নামে, তাতেও ২০৪০ সালের মধ্যেই এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মাইলফলক স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। আর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হলে ২০৩০ সালেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ভেঙে পড়া অর্থনীতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছিলেন, “বাংলাদেশ হলো এক তলাবিহীন ঝুড়ি!”

সেসময় বিশ্বে পরিচিত দুই উন্নয়ন অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, “ভুগত দিক থেকে বাংলাদেশ ‘দেশ’ হতে পারে, কিন্তু এর অর্থনীতি ঠিক নেই। এবং ‘ঠিক’ হতে ২০০ বছর সময় লাগবে (যদি আদৌ ‘ঠিক’ হয়)!”

২০০ বছর লাগে নি। ৪৫ বছরেই বাংলাদেশ হয়ে গেল পৃথিবীর ৪১ তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ (২০১৫ সালে)। ২০৩২ সালে আশা করা যাচ্ছে উঠে আসবে ২৪ তম অবস্থানে।

স্বাধীনতার পর দেশ যখন চরম খাদ্য সংকটে, অনেকেই বললেন, এত বিপুল জনসংখ্যার খাদ্যের ভার দেশ বইতে পারবে না।

কিন্তু দেশ পেরেছে। আয়তনে পৃথিবীর ৯৪ তম দেশ হওয়া সত্ত্বেও খাদ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন দশম। ধান উৎপাদনে তৃতীয়। সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আলু এবং আম উৎপাদনে সপ্তম, কাঁঠালে দ্বিতীয়, পেয়ারায় অষ্টম। গত একযুগে দ্বিগুণ হয়েছে মাথাপিছু ফল খাওয়ার পরিমাণ। তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ২য়, পাট রপ্তানিতে ১ম, আউটসোর্সিংয়ে ৮ম।

৭১ এ যে দেশটি ছিল আমাদের স্বাধীনতার শত্রু, তাদের নীতিনির্ধারকরা এখন বলছেন, দেশকে ‘সুইজারল্যান্ড’ না ‘বাংলাদেশ’ বানিয়ে দিলেই তারা সন্তুষ্ট হবেন!

ব্যক্তি, সমাজ ও জাতীয় পর্যায়ে এসব ইতিবাচক পরিবর্তনের নেপথ্য অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে কোয়ান্টাম। সেই কোয়ান্টামই আজ তিন দশক পুরো করে পদার্পণ করেছে ৩১ তম বছরে।

৬ জানুয়ারি, ২০২৩ টোটাল ফিটনেস ডে উদযাপনের মধ্য দিয়ে হতে যাচ্ছে এর চমকপ্রদ সূচনা।

শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক ফিটনেস অর্থাৎ পরিপূর্ণ ফিটনেসের যে প্রশিক্ষণ গত ৩০ বছরে ধরে কোয়ান্টাম দিয়ে আসছে, তার প্রক্রিয়ায় আরো সম্পৃক্ত করতে হবে নিজেদের এবং তারপর তা বৃহত্তর সমাজের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার কাজে নিবেদিত হবার আহ্বান জানিয়ে শুরু হচ্ছে নতুন বর্ষ ২০২৩। কোয়ান্টামের ৩১তম বর্ষ।