published : ২৬ আগস্ট ২০২৪
বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের সমাজ ও অর্থনীতি। অচিরেই দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রবেশ করবে স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায়। পরবর্তী জাতীয় লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে রূপান্তর। এ-জন্যে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতির ভিত্তি তৈরির বিকল্প নেই। যার নেতৃত্ব দেবে দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ জনশক্তি।
কোরিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম- উন্নয়নের মাপকাঠিতে অর্ধশতক আগেও প্রায় আমাদের অবস্থানে থাকা এই দেশগুলো যে আকাশচুম্বী সমৃদ্ধি অর্জন করেছে তা কিন্তু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিকে অগ্রাধিকার দিয়েই।
চীনের কথাও এখানে প্রাসঙ্গিক। দেশটি দেখল এর বিপুল জনগোষ্ঠী যদি প্রথাগত ডেস্কজবের দিকেই ঝুঁকে থাকে তাহলে দীর্ঘমেয়াদে চাকুরির সঙ্কট দেখা দেবে দেশে, বাড়বে বেকারত্ব। এই চিন্তা থেকে তারা তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনে, জ্ঞানভিত্তিক পাঠ্যক্রম বদলে হয় দক্ষতাভিত্তিক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষতাই সমৃদ্ধ করেছে দেশটির অর্থনীতিকে।
অন্যতম কারণ বাংলাদেশের ডেমোগ্রাফি বা জনমিতি।
জাতিসংঘের হিসাব বলছে, ২০২১ সালে আমাদের মোট জনসংখ্যার ৫৫ শতাংশ ছিল ‘ওয়ার্কিং এইজ পপুলেশন’ বা কর্মক্ষম জনশক্তি, যাদের বয়স ১৮ থেকে ৬৪ বছরের মধ্যে। ২০৩০ নাগাদ এই হার বেড়ে দাঁড়াবে ৫৭ শতাংশে।
এই জনসংখ্যাকে প্রকৃত অর্থেই জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে তাদের জন্য যুগোপযোগী বিজ্ঞান শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। ডিজিটাল প্রযুক্তি শিক্ষাদান পদ্ধতিরও প্রয়োজন ডিজিটালাইজেশন।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের গবেষণামতে বিশ্বজুড়ে বর্তমানে শিক্ষার যে ধরনটি নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে সেটি হলো STEM এডুকেশন। Science, Technology, Engineering এবং Mathematics- এই চারটি বিষয়ের আদ্যক্ষর নিয়ে STEM।
STEM এডুকেশনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং একুশ শতকের জন্য দক্ষ জনবল গড়ে তোলা। যেসব দেশ STEM এডুকেশনের ওপর জোর দেবে তারাই ভবিষ্যতে এগিয়ে যাবে- মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
STEM শিক্ষার মূল বিষয় হচ্ছে পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি ব্যবহারিক বিষয় দেখানো।
BUET-এর ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারসীম মান্নান মোহাম্মদী বলেন, বিজ্ঞান, প্রকৌশল, প্রযুক্তি এবং গণিতের ধারণাগুলোকে সমন্বিতভাবে শিখতে হবে। যে-কোনো সমস্যার সমাধান, সেগুলোর বিশ্লেষণ এবং এক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ানোর জন্যেই STEM শিক্ষা জরুরি।
STEM শিক্ষায় যারা শিক্ষিত তাদের জন্য প্রতি বছর ১৭ শতাংশ হারে কাজের সুযোগ বাড়ছে। যেখানে অন্য ডিগ্রিধারীদের জন্য কর্মসংস্থান বাড়ছে ১০ শতাংশ হারে।
আসলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল পেতে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার বিকল্প নেই। আর এক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে তরুণদেরই।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা Artificial Intelligence (AI), মেশিন লার্নিং, বিজনেস ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), রোবোটিক্স, বিগ ডেটা এনালাইসিস, ডাটা সিকিউরিটি, ডাটা ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিজিটাল মার্কেটিং, ফিনটেক, কোডিং, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ব্লকচেইন, সাইবার সিকিউরিটি, ভার্চুয়াল রিয়েলিটি, কনটেন্ট ক্রিয়েশন- এগুলোকেই ধরা হচ্ছে Future Job তথা ভবিষ্যতের কর্মসংস্থান।
এসব ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে অর্জন করতে হবে জ্ঞান ও দক্ষতা। তাহলেই ব্যক্তিগত উন্নয়নের পাশাপাশি সমৃদ্ধি আসবে দেশের অর্থনীতিতে।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস)-এর প্রক্ষেপণ অনুসারে, ২০২৫ সাল নাগাদ তথ্যপ্রযুক্তি খাত থেকে বাংলাদেশ আয় করবে ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০৩১ সাল নাগাদ এই পরিমাণ ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছানো খুবই সম্ভব।
এই সম্ভাবনাগুলোকে বাস্তবে রূপ দিতে পারলে ডলার আয় কিংবা রপ্তানি বহুমুখীকরণের সুযোগ তো বাড়বেই। সেই সাথে অনেকখানি সহজ হবে বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির মতো সামষ্টিক অর্থনৈতিক লক্ষ্যগুলো অর্জন। আর তা সম্ভব হতে পারে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ জনশক্তির হাত ধরে- পরিসংখ্যান এটাই বলছে।
বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার ল-ইয়ার ব্যাংকার- এই চিরাচরিত লক্ষ্যের বদলে এন্ট্রিপ্রিনিয়ারশীপ বা উদ্যোক্তা হওয়ার মানসিকতা বাড়ছে। বর্তমানে প্রায় ১০ লক্ষ মানুষ ফ্রিল্যান্সিংএর সাথে জড়িত আছে, যাদের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ফ্রিল্যান্স আউটসোর্সিং করছে ৬.৫০ লক্ষ।
তবে তথ্যপ্রযুক্তিতে তুলনামূলক কম দক্ষ হওয়ায় তারা পারিশ্রমিক পাচ্ছে অনেক কম। তা সত্ত্বেও বছরে তারা আয় করছে ১ বিলিয়ন ডলার। তাহলেই বুঝুন দক্ষতা বাড়লে এই আয় কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে!
আর ফ্রিল্যান্সারদের সিংহভাগই যেহেতু তরুণ, অতএব তারা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যত জ্ঞানী ও দক্ষ হবে, তত বাড়বে এই খাতে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সুযোগ।
আচার্য জগদীশ চন্দ্র বসু, ড. কুদরত-এ-খুদা, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, পিসি রায়, মেঘনাদ সাহা, আব্দুস সাত্তার খান, ডা. শাহ এম ফারুক, ড. মাকসুদুল আলম, ড, জামাল উদ্দিন প্রমুখ জগদ্বিখ্যাত বিজ্ঞানী রয়েছে আমাদের।
পিছিয়ে নেই আমাদের বর্তমান তরুণসমাজও। তুলনামূলক অনেক কম প্রযুক্তিগত সুবিধা নিয়েও বাংলাদেশের তরুণরা যেভাবে বিশ্বমঞ্চে দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে, আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান প্রতিযোগিতা ও ফ্রিল্যান্সিংএ যে অসামান্য মেধার স্বাক্ষর রাখতে তা রীতিমত বিস্ময়ের।
Oxford Internet Institute (OII) এর হিসাবে অনলাইন কর্মী সংস্থানে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ২য়। মোট অনলাইন কর্মীর ১৬ শতাংশ নিয়ে ভারতের ঠিক পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
এমতাবস্থায় তরুণ প্রজন্মের প্রতি উদাত্ত আহ্বান- নিজেদের বড় ভাবুন, দেশকে বড় ভাবুন, ভালো ভাবুন। নিজের কাজ করুন সবচেয়ে ভালোভাবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নিজেদের দক্ষ করে তুলুন। তাহলে বৈশ্বিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে দেশ পৌঁছে যাবে নেতৃস্থানে। পরিণত হবে সমৃদ্ধশালী স্বপ্নের বাংলাদেশে।
ইনশাআল্লাহ সব সম্ভব!