published : ১৩ আগস্ট ২০২৫
অধ্যাপক ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম
ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি
অধ্যাপক ও প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এন্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই)
গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
প্রফেসর ড. শমশের আলী, আমাদের দেশের বিজ্ঞান জগতে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন একজন পদার্থবিজ্ঞানী। গণমাধ্যমে বিজ্ঞান, ধর্ম ও মানবতা নিয়ে তার অসংখ্য বক্তব্য শুনে থাকলেও, তার সঙ্গে আমার প্রথম সরাসরি সংযোগ ঘটে ১৯৯২ সালে, জাতীয় বিজ্ঞান জাদুঘরে। সেখানে তার একটি বিজ্ঞান বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। তার সাবলীল ও জীবনঘনিষ্ঠ বিজ্ঞান বক্তৃতা আমাকে এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, সেই দিনের কিছু অংশ আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান।
প্রকৃতির মাঝে সুপ্ত থাকা বিজ্ঞানের উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, ‘মৌমাছির কুঠুরি কেন ষড়ভুজাকৃতির হয়?’ তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন, এর পেছনে রয়েছে মহাজ্যামিতি এবং পদার্থবিদ্যা। ষড়ভুজাকার গঠন সর্বোচ্চ স্থান ব্যবহারের পাশাপাশি কুঠুরিকে সর্বোচ্চ চাপ সহ্য করার ক্ষমতা দেয়। বিজ্ঞানীরা মৌমাছির এই রহস্য উন্মোচন করে সেটিকে বাণিজ্যিক উদ্যানতত্ত্বে কাজে লাগিয়েছেন। ফল ও ফুলের বাগানে গাছ লাগানোর সময় ষড়ভুজাকার নকশা ব্যবহার করা হয়, যা সর্বোচ্চ স্থান ব্যবহার নিশ্চিত করে। এর ফলে প্রতিটি গাছ সমান আলো-বাতাস পায় এবং যে-কোনো দিক থেকে দেখলে সারিবদ্ধভাবে সাজানো মনে হওয়ায় বাগানটি নান্দনিক দেখায়।
সেই বক্তৃতায় তিনি আরও একটি চমৎকার উদাহরণ দিয়েছিলেন : শীতে মানুষ কেন হাত-পা গুটিয়ে থাকে, আর গ্রীষ্মে একজন যুবক কেন মাঠে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকে? এর কারণ হলো পদার্থবিজ্ঞানের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল নিয়ন্ত্রণ। শরীর থেকে তাপ বের হওয়া বা তাপ ধরে রাখা নির্ভর করে শরীরের পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল কমানো বা বাড়ানোর ওপর।
অধ্যাপক শমশের আলীর সাথে আমার দ্বিতীয় সাক্ষাৎ ঘটে ১৯৯8 বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় (বাউবি)-তে প্রভাষক পদের সাক্ষাৎকারে। তিনি সেই বোর্ডের সভাপতি ছিলেন, যেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর এ কে এম আমিনুল হক, প্রফেসর এস ডি চৌধুরী এবং ড. সুজায়েতুল্লাহ চৌধুরী। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার ফলাফল অর্থাৎ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দেখে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি তোমাকে দুটো প্রশ্ন করব। যদি দুটোরই সঠিক উত্তর দিতে পারো, তবে বাউবিতে তোমার চাকরি নিশ্চিত।’ আমি কিছুটা নার্ভাস হয়ে সম্মতি জানালাম।
তার প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘জিন প্রকৌশল কী এবং এতে ব্যবহৃত কাঁচি কোন ধাতুর তৈরি?’ আমি উত্তরে বললাম, ‘কোনো জীবকোষের ডিএনএ-তে পরিবর্তন ঘটিয়ে সেই জীবের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করার কৌশলই হলো জিন প্রকৌশল। তবে এতে কোনো ধাতব কাঁচি ব্যবহার করা হয় না, বরং জৈব অণু এনজাইমকে মলিকুলার সিজার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।’
তিনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন, ‘বেশ! এবার বলো, দেশে জনসংখ্যা বাড়ছে, কিন্তু জমির পরিমাণ কমছে। এমতাবস্থায় খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে আমরা কোন ধরনের কৃষি অনুসরণ করব?’ আমি তাৎক্ষণিকভাবে উত্তর দিলাম, ‘আমার মনে হয়, বাংলাদেশের জন্য উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল এগ্রিকালচারই সবচেয়ে উত্তম পদ্ধতি হবে। এখানে আমরা জিন প্রকৌশলসহ নানা আধুনিক কৃষিপ্রযুক্তি ব্যবহার করে অধিক ফলনশীল ও পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল ও পশুপাখির জাত উদ্ভাবন করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে পারি।’
আমার উত্তর শুনে তিনি এতটাই খুশি হয়েছিলেন যে, অন্য বোর্ড সদস্যদের আর কোনো প্রশ্ন করতে দেন নি। তিনি আমাকে বললেন, ‘অসাধারণ! কবে যোগদান করতে পারবে?’ সেই মুহূর্তে আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম।
বাউবি-তে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের পর একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ‘কৃষিবিজ্ঞানের বইটি সুন্দর হয়েছে। বাউবি ক্যাম্পাসে কৃষি সম্পর্কিত নতুন কিছু করার কোনো প্রস্তাব আছে কি?’ কিছুটা ভেবে আমি বললাম, ‘স্যার, ক্যাম্পাসে গাছপালা তেমন নেই। আমরা সীমানা প্রাচীর ঘেঁষে বনজ ও ফলজ গাছ লাগাতে পারি।’ তিনি খুব খুশি হয়ে ইঞ্জিনিয়ার একরামুল হককে ডেকে আমাকে সহায়তা করতে বললেন। বন বিভাগের সহায়তায় আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে বাউবি ক্যাম্পাসে প্রায় ছয় হাজার বৃক্ষরোপণ করেছিলাম।
অধ্যাপক শমশের আলীর সঙ্গে যুক্তিতে জেতা ছিল খুবই কঠিন। জ্ঞানসাগর এই মানুষটি ছিলেন প্রচণ্ড প্রত্যুৎপন্নমতি। ওপেন স্কুলের এসএসসি শিক্ষার্থীদের জন্য কৃষিবিজ্ঞানের বইটি সম্পাদনার পর সেখানে কৃষিতে উচ্চতর একাডেমিক প্রোগ্রাম ও গবেষণার সম্ভাবনা না দেখে আমি ভবিষ্যতের কথা ভেবে বাউবি ছেড়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটে (ব্রি) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানের জন্য আবেদন করি এবং নিয়োগপত্র পাই। তৎকালীন ব্রি-র মহাপরিচালক ড. মামুনুর রশীদ স্যারের উৎসাহে আমি সেখানে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিই।
যোগদানের আগে আমি উপাচার্য প্রফেসর ড. শমশের আলীর সঙ্গে দেখা করে আমাকে চাকরি প্রদান এবং আমার মেন্টরিংয়ের জন্যে তাকে কৃতজ্ঞতা জানাই। পাশাপাশি, ব্রি-তে যোগদানের পরিকল্পনার কথাও তাকে বলি। তিনি মনোযোগ দিয়ে বাউবি ছাড়ার কারণগুলো শুনলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ রেজিস্ট্রারকে ডেকে বাউবি প্রতিষ্ঠার মূল প্রকল্পটি আনতে বললেন। প্রকল্পটি দেখে তিনি আমাকে বললেন, ‘এই প্রকল্পে স্কুল অব এগ্রিকালচার অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট নামে একটি নতুন অনুষদ খোলার সুযোগ আছে। আমি মনে করি, এই অনুষদ প্রতিষ্ঠা করে তুমি তোমার পেশাগত পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারো। তুমিই হতে পারো এই স্কুলটির প্রথম শিক্ষক।’ আরো অনেক যুক্তিপূর্ণ ও উৎসাহব্যঞ্জক কথা বলে তিনি আমাকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের অনুরোধ জানালেন।
তবে কবে নাগাদ এই নতুন স্কুল শুরু হবে এবং আমি সত্যিই সেখানে স্থানান্তরিত হতে পারব কিনা, তা নিয়ে আমি দ্বিধায় ছিলাম। আমার সংশয় বুঝতে পেরে তিনি তৎক্ষণাৎ ডেপুটি পরিচালক তারাব আলীকে ডেকে বোর্ড অব গভর্নরস-এর সভায় নতুন স্কুল চালুকরণ এবং আমাকে সেখানে প্রভাষক হিসেবে স্থানান্তরের এজেন্ডা সংযোজনের পরামর্শ দিলেন। তার দ্রুত কর্মপরিকল্পনার ফলস্বরূপ, এক সপ্তাহের মধ্যেই আমি কৃষিতে একটি নতুন অনুষদের প্রথম শিক্ষক হিসেবে নতুন কর্মোদ্যমে ব্রি-তে যোগদানের পরিকল্পনা বাদ দিলাম।
দেশে উন্মুক্ত শিক্ষার পথিকৃৎ প্রফেসর আলীর সাথে আমার এমন অনেক স্মৃতিময় ঘটনা রয়েছে, যার প্রতিটিই ছিল আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান, শিক্ষণীয় এবং অনুপ্রেরণাদায়ক। তার প্রজ্ঞা, দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা এবং অন্যের যুক্তি মনোযোগ দিয়ে শোনার পর নিজের মতামত প্রদান আমাকে সর্বদা অনুপ্রাণিত করে।
প্রফেসর শমশের আলীর সঙ্গে আমার মিথস্ক্রিয়ার তৃতীয় অধ্যায় ছিল বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির একজন ফেলো হিসেবে। তিনি প্রায় এক যুগ এই প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ছিলেন। আমার ইন্ডাকশন সেরিমনিতে শুভেচ্ছা বক্তব্যে তিনি প্রথমেই বাউবি-তে আমার চাকরির সাক্ষাৎকারের কথা উল্লেখ করেছিলেন। তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত সুপরিচিত একজন বিজ্ঞানী। বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমিতে ভূমিকা রাখার জন্যে তিনি আমাকে অনুপ্রাণিত করতেন এবং বিশ্ব ইসলামিক একাডেমি অব সায়েন্সে আমাকে মনোনয়ন দেয়ার জন্যে আমার জীবনবৃত্তান্ত তাকে দিতে বলেছিলেন।
বাংলা ভাষায় লেখা আমার ‘জিনোম এডিটিং’ বই এবং বিজ্ঞানের নানা বিষয়ে আমার লেখাগুলো পড়ে তিনি মন্তব্য করতেন এবং উৎসাহিত করতেন। মৃত্যুর প্রায় দু-সপ্তাহ পূর্বে তিনি আমাকে হোয়াটস অ্যাপে ফোন করেছিলেন। আমার ফোনটি তখন সাইলেন্ট থাকায় কলটি মিস করি। পরবর্তীকালে একাধিকবার কল ব্যাক করলেও কোন সাড়া পাই নি। হাওয়াই রাজ্যে আমেরিকান ফাইটোপ্যাথোলজিক্যাল সোসাইটির (American Phytopathological Society, APS) বার্ষিক সম্মেলন ‘প্লান্ট হেলথ ২০২৫’-এ অংশগ্রহণকালে প্রফেসর শমশের আলীর মৃত্যু সংবাদ পেয়ে ভীষণ মর্মাহত হয়েছি। ফোনে তিনি আমাকে কী বলতে চেয়েছিলেন জানা হলো না! মহান আল্লাহপাক প্রফেসর শমশের আলীকে বেহেশতে চিরশান্তিতে রাখুন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রফেসর শমশের আলীর কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। বিজ্ঞানের আলোয় সমাজকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অনন্য। তার মৃত্যু দেশের জন্যে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তবে শিক্ষা ও গবেষণায় তার বিশাল অবদান এবং সর্বোপরি তার আদর্শ ও দর্শন মানবজাতির পাথেয় হয়ে চির অম্লান থাকবে বলে আমার বিশ্বাস।