ভালবাসি, ভালবাসি

published : ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫

আমাদের এই অজ্ঞাত-অখ্যাত জেলা স্কুলেও ভ্যালেন্টাইন এসে পড়েছে। সবার খুশি-খুশি ভাব। মেয়েরা ক্লাসে বসে ব্যাগের ভেতর চকচকে মোড়কের উপহার লুকাতে ব্যস্ত। ঘন্টা বাজার মিনিট দশ আগ থেকে সবাই বাথরুম যেতে থাকে। ফিরে আসে চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে। কী যে মজা লাগে দেখতে! হাসি পায়! হিংসা হয়! আমারও তো এমন একদিন ছিল। এমনভাবে আমিও লিপস্টিক দিয়ে অপেক্ষা করতাম ফুল-হাতে কেউ আসবে বলে। খুব বেশিদিন আগে না তো- সাত-আট বছর? আজ ভাবতেও লজ্জা লাগে। কেউ কি বিশ্বাস করবে? আজ আমার দিন কেবল বাসা-স্কুল-প্রাইভেট। পঙ্গু বাবার ওষুধ আর রান্না। কখনও স্কুলের ফাংশন, নাচ-গান-আবৃত্তি। আর কখনও কোন মুরুব্বি দয়ালু মহিলার একটা বুড়ো-বয়স্ক লোকের ছবি নিয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাবে রাজি করানো। কেউ কি বিশ্বাস করবে? একদিন আমারও ছিলো এক আশ্চর্য ভালবাসা?

বোনেদের সাথে ছোটবেলার কোন ছবি নেই। একটা একটা করে পুড়িয়েছি সবগুলো! কেন থাকবে? বাইরের কেউ এসে দেখলে ভাবতো আমি বোধহয় আত্মীয় কেউ! আমার ফর্সা মা, টুকটুকে বোনদের পাশে আমার হতচ্ছাড়া কালো চেহারাটা মিলতো না যে! পাড়ার খালাম্মা এসে জানতে চাইতো আমি ‘পালিত’ কিনা! আমি কান্না করতাম। কারো সামনে না; সবার বড় যে! কি দোষ আমার? হয়েছি বাবার মতন! মায়ের কালো চুল- সাদা চোখ কোনোটাই পাইনি। আমার হাতের লেখা ভালো, রান্নায় যেন জাদু! কিন্তু লোকে আসলে আমি হেঁসেল ঠেলতাম, আর বোনেরা মেহমানের সাথে টিভি দেখত। বোনদের চুলে-হাতে মেহেদি দিতাম আমি। আমার চুলে কেউ দিত কি? আম্মা জোর করে চেষ্টা করতেন কাক আমাকে ময়ূর বানানোর। চোখ জ্বলতো, ঠোঁট জ্বলতো। গালের হলুদ ধুয়ে যেত চোখের পানিতে। আম্মাকে বলতাম, হলুদ ঘষায় বোধ হয়। আম্মা কি বুঝত? বোধ হয়। তাই আমার রূঢ় স্বর, সবার সাথে দুর্ব্যবহার, আত্মীয় কাউকে দেখলেই মুখ-ঝামটা –এত কিছুর পরও দুধের সর-টা খাওয়াতেন; আর বলতেন আস্তে আস্তে চেহারা ভালো হয়ে যাবে!

যেদিন ঘর পালিয়েছিলাম- কেউ বোঝে নি। আম্মা বিছানায় পড়ে গেলেন। আব্বা ‘বেজাত’ বললেন। যারা ছিল সব ‘অবৈধ’ প্রেম আর চিঠিপত্রের সাক্ষী, সেই বোনেরাও কাঁদলো। সবাই ভাবলো কীরকম হতচ্ছাড়া মেয়ে, পরিবারের মুখে কালি দিয়ে ভেগে গেল! কেউ কি জানতো আমার বিয়ের অপেক্ষা করে করে আমার বোনগুলোর বয়স হচ্ছে? আমার পরীর মতন টুকটুকে তিন বোনের? যদি পালিয়ে না যেতাম- হত বিয়ে? আমার মতন কালো রং-থ্যাবড়া নাক আর মোটা গলার মেয়েকে করত বিয়ে? কোন ভালো বংশের জজ-ব্যারিস্টার?

আমার বাপের পয়সা নেই, আমাদের ভালো ঘর নেই, বংশে কোনো মন্ত্রী-মিনিস্টার নেই। পাড়ার ডিগ্রি ফেল ছেলেটাই যে আমার কাছে হিরো ছিল? কেউ কি বুঝেছে? মাস্তান ছিল কি? চালচুলো নেই, কিন্তু রাস্তায় শিষ তো বাজায়নি কখনও? আমার স্বামী কি এতই খারাপ যে আব্বা মসজিদের ইমাম ডেকে আমাকে ত্যাজ্য করলেন? ওর দোষ কী ছিল? ও চাকরি না পেয়ে টিউশনি করায় তা? নাকি আমার মতন খারাপ কারো প্রেমে সে পড়েছিল, তা? তারপর কত কথা! কত রটনা! কতজন আমাকে কবে কবে দেখেছে, কোথায় কোথায় দেখেছে! আব্বার মসজিদ যাওয়া, আম্মার দোকান যাওয়া বন্ধ হলো। আব্বা ভাবলেন আমি যেন মুখিয়ে ছিলাম কোনো ছেলের আশায়! এত বয়স আব্বার, এত তেজ- এতটুকু বুঝলেন না- মুখিয়ে থাকলে ডিগ্রি পাশ করতাম না। কলেজ পড়েই ভাগতাম।

আমরা কারো দিকে তাকাইনি। দুজন মিলেই থাকতাম। আমি জানতাম আমার ভাগ্যে গাড়ি-ঘোড়া নেই। কিন্তু খেতে বসে কেউ পাশে থাকত, রান্নার প্রশংসা করত –এই তো আমার রাজকন্যার ভাগ্য। আর কী চাই? কত দৌড়ে চাকরি পেয়েছি আমি জানি। স্বামীর ইন্সুরেন্সের কমিশনে সংসার চলে না। এরপরও আম্মার হাতে টাকা দিতে গেছিলাম একদিন। হাতের খুন্তি ছুঁড়ে মেরেছিলেন আমার দিকে। অভিশাপ দিলেন কোনদিন যেন সুখী না হই। আল্লাহ আম্মার দোয়া কবুল করলেন। সন্তানের জন্য হাহাকার করতে করতে একদিন শুনলাম আমার তরুণ স্বামী বুকের ব্যথায় মারা গেছেন। এতদিন ছিলাম কুৎসিত-কুলটা, এখন হলাম কুৎসিত-কুলটা-বিধবা।

চিৎকার করে কাঁদি। বই পড়ি। কুচিকুচি করে ছিঁড়ি। একটু ভালোবাসা পেলাম না বেশিদিন। শুধু এতটুকু চেয়েছিলাম। বেশি কিছু তো না! স্বামীর কথা ভাবি। সে কি এখনও ভালবাসে আমাকে? আড়াই হাত মাটির নিচে? জানতে ইচ্ছা হয় “হতভম্ব আমি যদি চিৎকার করে বলি - ভালবাস? চুপ করে থাকবে?নাকি সেখান থেকেই আমাকে বলবে ভালবাসি, ভালবাসি..”?

মাঝে মাঝে অবাক লাগে। কীভাবে বেঁচে আছি আমি? মাসে কোন নতুন জামা নেই, প্লেটে ভালো খাবার নেই, বিছানায় নতুন চাদর নেই। কয়েকটা ছাত্র পড়াই- কেউ টাকা দেয়, কেউ দেয় না। আমি কখনও চাই না। তোমরা যারা আমাকে নিয়ে খারাপ কথা বল তোমাদের ছেলেমেয়েদের আমি ফ্রি-তে পড়াই। আমার শেখানো ন্যারেশন-সাফিক্স-প্রিফিক্স পড়ে একদিন তোমাদের সন্তানেরা সমাজের বড় কেউ হবে। সমাজের প্রতি এই আমার মধুর প্রতিশোধ। না, প্রতিশোধ ঠিক না। এও এক ভালবাসা। আল্লাহ আমাকে একটা সন্তান দেন নি, কিন্তু ষোল-সতেরটা দিয়েছেন। প্রতিবছর নতুন-নতুন। স্কুলের ক্যান্টিনে মামা কখনও চায়ের পয়সা নেন না- তার মেয়েকে ফ্রি-তে পড়াই বলে! ফ্রি-তে পড়াই কি? ওদের সালাম-হাসিটাই যে গুরু-দক্ষিণা! ওরা যে কখনও চেহারা নিয়ে কটাক্ষ করে না! কখনও জানতে চায় না আমি কেন বিধবা, আমার পঙ্গু বাবা কেন মেয়ের-টা খেয়ে পরেও মেয়ের সাথে কথা বলেন না!

হঠাৎ একদিন বসন্ত আসে। ফাল্গুন লাগে। মন বিদ্রোহ করে। স্কুলের এ্যাডমিন স্যারের লাজুক হাসি বার বার দেখতে ইচ্ছে হয়। বিপত্মীক ভদ্রলোক। কেমন আছি জানতে চান। আজকাল আমিও চুলে সিঁথি কাটি, ওড়নাটায় মাড় লাগাই। ক্ষয়ে যাওয়া জুতাটা তুলে নতুন একটা স্যান্ডেল পায়ে দেই। শুক্রবার দিন গায়ে হলুদ ঘষি। কী লাভ? আবারও ভুল করবো না তো? পালিয়ে গিয়ে একবার ভুল করেছিলাম। আব্বার পায়ে না ধরে ভুল করেছিলাম। সন্তান হওয়ার জন্য ভালো ডাক্তার না দেখিয়ে ভুল করেছিলাম। ব্যাংকে সঞ্চয় না করে ভুল করেছিলাম। এবার কি ভাগ্য মুখ তুলে তাকাবে? এই বত্রিশ বছরের কুৎসিত-কুলটা-বিধবা মহিলার দিকে?

নাকি একাই থাকবো? স্মৃতি নিয়ে? একদিন বুড়ো হব। চশমার ফাঁকে উলের কাঁটা বুনে কাটবে সময়? “সাদা চুল, ন্যাড়া দাঁত আর আয়নায় ভ্যাংচানো ছায়াকে তখনও বলবো আমি রাজ্যচ্যুত রাজ্ঞীদের ভাষা। জানিস্, আমারও ছিল এক আশ্চর্য ভালবাসা। তোর কি ক্ষমতা আছে মিথ্যে করে দিবি সে পাওয়াকে?”