সমীকরণ

খুব কাছের এক আপুর ছেলে হলো সেদিন। উনার সাফল্যের উদাহরণ শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। অল্পবয়সে বড় চাকরি পেয়েছেন বলে মিষ্টি খেয়েছি। উনার হাসিখুশি ভীনদেশি বরকে হিংসে করেছি। বড় ফ্ল্যাটে উঠলে তার গৃহপ্রবেশের দাওয়াতে হৈ-হল্লা করেছি। ছুটিছাটায় দেশবিদেশ ঘুরে এলে মুগ্ধ হয়ে তার গল্প শুনেছি। জানতে চেয়েছি, এমন কোনো চাওয়া কি আছে যা পূর্ণ হয় নি? আমি তো দেখি স্বপ্নের জীবন আপনার! আমার সুন্দর আপু তার সুন্দর হাসি দিয়ে বললেন, চাওয়া খুব কম তো তাই হিসেব রাখি নি! 

কিসে চাওয়া কম হয়–এটা আমার জানা নেই। জানলে ভালো হতো। পরামর্শের জন্যে অন্যরা আসে। আসলে পরামর্শ চায় কি? বেশিরভাগ চায় যেন তার সিদ্ধান্তটাই আমি আমার মুখে বলি! তারা গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, খ্যাতি চায়! বড় ঘরে বিয়ে করতে চায়, পুত্র-কন্যা চায়। পেতে চায়, ছাড় দিতে চায় না। একজনকে পায়, তারপর মনে হয় আরেকজন হলে ভালো হতো। নতুন পাওয়া খেলনার মতন বাচ্চাকে নিয়ে খেলেধূলে আবেদন ফুরিয়ে যায়, একবছর পর বাচ্চা হাতবদল হয় গৃহকর্মীর কাছে। হাতেগোনা এক-দুজনকে দেখি অনেক হিসেব করে বাচ্চা নিতে যান; জানতে চান সময়টা ঠিক কি না! আমার ভালো লাগে! কয়টা বাচ্চাই আসে যত্ন থেকে, ভালবাসা থেকে? আমার নানী বলতেন, হয়ে যায় রে! আমার যেমন ছয়টা হয়ে গেছে, আমার মা’র হয়েছিল এগারটা! ভালবেসে তো চাই নি। হয়ে গেল! তারপর একটু একটু করে ভালবাসতে শিখলাম। নানুর কথা শুনে আম্মা বিরক্ত হতেন আর বলতেন ‘কীসব হতচ্ছাড়া কথাবার্তা! নাতনীর সাথে কি এসব বলে!’ আমার কুটিল মন এতে খুশি হতো, কারণ আমি ওভাবে আসি নি। আজমির শরীফে মানত করা হয়েছিল, তবেই না এসেছি!
 
তবে আমার কৌশলী মন ভড়কে যেত আরেকটা কথা ভেবে! যার সাথে বাচ্চা হবে, তার জন্যেও কি মানত করতে হয়েছিল? না কি সে-ও কেবলই ‘হয়ে যায়’? তাই কি নানু বদরাগী জাঁদরেল নানার সাথে বাধ্য হয়ে থেকেছিলেন? ফেলে দিতে পারেন নি বলে? তবে আম্মা কেন আব্বার জন্যে এখনও শুঁটকি রান্না করেন? বাসার সবাই নাক কুঁচকে থাকত–আমাদের জন্যে হতো আলাদা পদ। আব্বা তো উচ্চবাচ্য করতেন না! তবে আম্মার এই বাড়তি কষ্টের কারণ কী? আমার সরল আব্বা ছোট ভাইটাকেও সময়মতন কখনও ধমক দিতে পারেন নি! তাই কি আম্মা আব্বার হয়ে লড়তেন? এর নাম কি প্রেম? চৌত্রিশ বছর পরও কি ভালবাসা টেকে? নাকি অভ্যেস?

নিজের বিয়ে নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগেছি অনেকদিন। কাউকেই পছন্দ হতো না! আমাকেই চায় তো? নাকি চায় এই সাদা চামড়া আর সচ্ছল পরিবার? আম্মার চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রস্তাব আনা পাত্রদের সাথে দুবারের বেশি তিনবার কথা বলতে পারি নি! তাহলে বুঝব কি করে ভালবাসবে কি না? আব্বার কাছে সবাইকেই ভালো লাগত আর আম্মার জন্যে কেউই যথেষ্ট ছিল না! তাহলে সিদ্ধান্ত কে দেবে? আমার অন্তর্গুরু? কাউন্সেলর কেউ? আত্মীয়রা? বন্ধু-বন্ধুর জামাই? আর দিলেই কি আমি মেনে নেব? হাজারটা যুক্তি আসে, সন্দেহ হয়! একদিকে হৃদয় যায়, অন্যদিকে মস্তিষ্ক! 

হ্যাঁ, একজনের কথা মনে ধরেছিল। কারণও ছিল। তার সাথে তার বরের যদি অণু পরিমাণও মিল থাকত তাহলেও আমরা তাদের সুখ দেখে এত অবাক হতাম না! তারা একসাথে রইলেন কীভাবে? উনি বলতেন, ভালবাসা বলতে আসলে কী চাও? এর মানে কি জীবন দিয়ে দেয়া? পরিবারের সাথে ঝগড়া করে বাসার সামনে রাস্তায় এসে মারামারি করা? দামি গিফট আর ফোনে প্রেমালাপ? আসলে ভালবাসা হলো খুব ছোট ছোট ত্যাগ। স্বামী ভালবাসে কি না তা বুঝতে পারবে কবছর পর, যখন বিছানায় শোয়া অফিস ফেরত ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত স্বামীকে বলতে উনি গজগজ করতে করতে হলেও ফ্যানটা একটু কমিয়ে দেবেন! যিনি অনেক বাজারের মধ্যেও মনে রেখে একটু ডাঁটা শাক নিয়ে আসবেন কারণ চিংড়ি দিয়ে ডাঁটার ঝোল উনার স্ত্রীর পছন্দ! অসুস্থ হলে যিনি বিরক্ত হবেন, তবুও বেরোনোর সময় ঠিকই ছেলেকে বলে যাবেন যেন আওয়াজ না করে, কারণ মা ঘুমাচ্ছে! যিনি এটা বছরখানেক পর করবেন তিনিই তো ভালবাসেন।
তাহলে সুখের কি কোনো সমীকরণ আছে? যে সমীকরণের বাম পাশে চাওয়া-পাওয়া বসিয়ে দিলে ডানে চলে আসবে কোন মানুষটি সঠিক? নাকি স্রেফ জুয়া? ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেয়া? এটা এখন বোঝার উপায় কী? বোঝার উপায় হলো নিজের অনুভূতির উপর বিশ্বাস আর সাধ্যমত চেষ্টা করে যাওয়া!

যত সহজে বলতে পারছি বিষয়টা তত সহজ না জানি। কিন্তু তবুও বলতে পারি, কারণ একদিন বিয়ের এই সিদ্ধান্তহীনতা থেকেই কোর্সে এসেছিলাম। সবার কথা আর নিজের অশান্ত মনের দোটানা দূর করতে পেরেছিলাম মেডিটেশন করেছি বলেই। সবার সব কথাই শুনেছি, কিন্তু শেষমেষ মন যা বলেছে তাতেই সায় দিয়েছি।

জানতে চাইবেন, আমি তাহলে কেমন আছি? সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলাম কি না? জি-বাংলার নাটকের মতন হাসি-খুশিতে উপচে পড়ছি? নাকি বাসায় ঝগড়া করে লিখতে বসেছি? সেটা না-হয় আপনাদের কল্পনার উপরই থাক। 

আসলে লিখতে বসেছি ৩৭৫ কোর্স উপলক্ষে। আমার অনেক জরুরি সময়ে এই কোর্স থেকেই দিক নির্দেশনা পেয়েছিলাম। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সঙ্ঘের সঙ্গ ছাড়ি নি। আজ মনটা আনন্দে ভরে উঠে যে আমার পর আরও ৭৫টা ব্যাচে অনেকে অংশ নিয়েছেন। আমার মতন অনেকেই হয়ত আছেন আরও কোনও বড় সমস্যা-সন্দেহ নিয়ে। খালি এতটুকু বলতে পারি, আমরা ভালো আছি, আমাদের সাথে আসুন আপনিও ভালো থাকবেন।