অন্যের ‘ভালো’তে বাস করা

এক বৃদ্ধ লোক থাকেন গভীর জঙ্গলে। কোনো আত্মীয়-পরিজন নেই, কোনো পিছুটান নেই; একা মানুষ নিজের মনে সাধনা করেন। এর মধ্যে একদিন জঙ্গলে ঝড় উঠল। ছোট্ট কুঠুরিতে শান্ত মনে বৃদ্ধ ঘুমিয়ে থাকলেন। দীর্ঘ জীবনে বহু ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়েছেন, আজকাল আর এতে বিচলিত হন না। পরদিন সকালে দেখলেন জানালায় একটা পাখি আটকে আছে। ঝড়ে পাখির একটা ডানা ভেঙে গেছে, ব্যথায় বেচারা কাতরাচ্ছে। দেখে বৃদ্ধের খুব মায়া হলো। সেবায়-মমতায় আস্তে আস্তে পাখিটি সুস্থ হতে লাগল। আদর-যত্নে একসময় পাখির ভাঙা ডানা জোড়া লাগল। আগে সে দাঁড়াতেও পারতো না, একটু একটু করে এখন পাখি লাফাতে পারে, অল্প দুরত্ব উড়েও যেতে পারে। বৃদ্ধও যেন পাখির সাথে সাথে একটু একটু করে উড়তে লাগলেন; তার দিন এখন শুরু হয় পাখির ডাকে, আগের সেই হাহাকার আর নেই। বৃদ্ধের বুক এখন কিসের এক আনন্দে পূর্ণ, সন্ধ্যায় আর তার বাইরে থাকতে ইচ্ছে করে না—পাখির মতো তার মনও সাক্ষাতের জন্যে ছটফট করতে থাকে। একটা অভিভাবকত্ব, আশ্রয় দেয়ার একটা অনুভূতি, কেউ একজন তার জন্যে অপেক্ষা করে আছে—এই উপলব্ধিতে বৃদ্ধের জীবনের শূণ্যতা এখন ভালবাসা আর খুশিতে টইটুম্বুর।

এর মধ্যে একদিন সকালে বৃদ্ধ দেখলেন পাখি আর তার ঘরে নেই। বসে আছে পাশের গাছের ডালে। কিন্তু অবাক বিস্ময়ে বৃদ্ধ দেখলেন তার শত ডাকেও পাখি আর ফেরত আসছে না, তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ কিচির-মিচির করে আদরের পাখি উড়ে চলে গেল। অধীর আগ্রহে সারাদিন বৃদ্ধ বসে থাকলেন, কিন্তু তার প্রাণের সঙ্গী আর ফেরত আসলো না। জঙ্গলের ঝড়ের মধ্যে যে পাখি একদিন কাছে এসেছিল, বৃদ্ধের জীবনে ঝড় তুলে সে আবার ফিরে গেল।

কাহলিল জিব্রানের ‘দ্য টেম্পেস্ট’ নামের এ গল্পটা পড়েছিলাম বহু আগে। এখনও মনে আছে, কারণ এই গল্পটা একটা বড় ধাক্কা দিয়েছিল। সেদিন বুঝতে পারলাম ‘ঝড়ের পাখি’ একসময় না একসময় উড়ে যাবেই। কাজেই যত বেশি প্রত্যাশা করব, প্রতিদান চাইব, ভবিষ্যতের সুখ-স্বপ্ন বুনব, বিচ্ছেদে ততটাই দুঃখ দেবে।

যেমন ধরুন, আমরা সবসময় হা-হুতাশ করি— ‘অমুক আমাকে বুঝল না’- ‘আমি ওর জন্যে এত করলাম’- ‘ও আমার সাথে এমন করতে পারল’! যে-কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে আমরা কিন্তু নিজের ভুলটা কখনও ধরি না। অন্যে আমার সাথে কত কী অবিচার করল এর ফিরিস্তি দিতে দিতেই আমাদের দিন শেষ হয়ে যায়, আল্লাহর কাছে নালিশ করতে করতে পাঁচ ওয়াক্ত পার হয়ে যায়, প্রার্থনা আর করা হয় না। এ ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি হয় প্রিয়জনের ক্ষেত্রে।  যেহেতু ভালবাসা বেশি, ঘনিষ্ঠতা বেশি তাই অভিমানও বেশি, কষ্টও বেশি। যেরকম, বিয়ের পর বহু স্ত্রীর অভিযোগ হলো স্বামী এখনও আমাকে বুঝল না, আরে, স্বামীর কী এক্স-রে চোখ আছে যে আপনার মনের কথা বুঝে ফেলবেন? আপনাকে তো মুখ ফুটে বলতে হবে।  আবার, স্বামীরা বলেন, ‘আমার বউ এখনও বুঝল না কখন চুপ করতে হবে’- তাহলে একদিন ঠান্ডা মাথায় তাকে বুঝিয়ে বললেই তো সমাধান হয়ে যায়! অথচ আমরা মোটেও তা করি না। দিনকে দিন আমাদের অভিমানের বোঝা বাড়তে থাকে এবং একদিন সেটা ঝগড়ায় প্রকাশ পায়। যেটা করা উচিত তা হলো, এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করা, তা না করে আমরা কী করি? দুই কান দিয়ে ঢুকিয়ে মুখ দিয়ে বের করি!

একই কথা অন্য সব সম্পর্কের বেলায়ও সত্যি। আমরা এমন-এমন জিনিস প্রত্যাশা করি যেটা প্রিয়জনের স্বভাববিরুদ্ধ। প্রত্যেকবার আমরা ভাবি এবার হয়তো সে নিজের নিয়মের বাইরে গিয়ে আমার জন্যে ব্যতিক্রম কিছু করবে। সেটা কখনও হয় না; কারণ আপনি নিজে কি কোনোদিন নিজের অপছন্দের কাজটা করেছেন অপরকে খুশি করার জন্যে? আপনি বাবা হয়ে ভাবছেন, আজকে ছেলে নিজে বাসায় থেকে মেহমানদের আপ্যায়ন করবে। অথবা মা হয়ে আপনি চান, অসুস্থ হলে আপনার মেয়ে সবকিছু ফেলে আপনার সেবা করবে। কিন্তু এমনটা কি হয়? হয় না কিন্তু।  আবার ছেলেমেয়েও কিন্তু চায় আজকে বাবা-মা নিত্যদিনের মতো একই জিনিস নিয়ে বাড়ি মাথায় করবে না; একটা সকাল অন্তত চুপ থাকবে। হাঁ, করলে ভালো এবং করাটা উচিৎও। সেই কথাটা আপনাকে বুঝিয়ে বলতে তো হবে। সে মানল কিনা সেটা তার ব্যাপার।  আপনার কাজ হলো চিৎকার না করে, ঠান্ডা মাথায় বোঝানো এবং এক রাতে সে এক্কেবারে ‘চেঞ্জ’ হয়ে যাবে—এমনটা না ভাবা। আপনার ভালোর জন্যেই কিন্তু; না হলে, যত ওপরে উঠবেন নিচে পড়বার সময় তত বেশি ব্যথা পাবেন।

পৃথিবীতে সবচেয়ে সুখী মানুষ তারাই যারা অল্পে সন্তুষ্ট থাকে। এই যে বার বার বলা হচ্ছে শোকরগোজার হোন–এর কারণ তো এটাই। যা আছে তাতেই ভালো থাকতে হবে। আপনার যেমন আশা, ‘আমার ছেলেটা অমুকের মতো ভালো হলো না কেন’;  আপনার ছেলেও চাইতে পারে ‘আমার বাবা অমুক আংকেলের মতো হলো না কেন’! আপনি চান বৃদ্ধ হলে ছেলেমেয়ে আপনাকে পরম আহ্লাদে মাথায় তুলে রাখবে, কিন্তু আপনি কি তাই করেছেন? চাকরি-অনুষ্ঠান-সামাজিকতার অজুহাতে আপনি কি সন্তানকে কাজের লোকের হাতে ছেড়ে দেন নি? তখনও আপনার ইচ্ছেমাফিক সন্তান থাকবে, এখনও আপনার মতো করেই সবকিছু হবে—দুনিয়ায় এমন কি আদৌ হয়েছে? কাজেই চাহিদার উপর যত লাগাম দিতে পারবেন তত ভালো থাকতে পারবেন। আর না হলে চাওয়া-না পাওয়া-হতাশার বৃত্তে আপনি আটকে পরবেন। চাওয়াটা দোষের কিছু না। কিন্তু বারবার একই মানুষের কাছে একই জিনিস কেন চাইব? আর প্রত্যেকবারই না পেয়ে কষ্ট কেন পাব? এই আসক্তিটাই যত সমস্যার মূল।

‘ঝড়ের পাখি’র গল্পের শিক্ষাটা এখানেই। আমি যত্ন-আত্তি করলাম, মুখে তুলে খাইয়ে পর্যন্ত দিলাম, না চাইতে সব এনে হাজির করলাম আর সে আমাকে কিছুই দিল না? সুযোগ পেয়ে উড়ে চলে গেল? আসলে আরেকটা মানুষের শৃঙ্খলে নিজেকে কখনও আটকাবেন না। যদি সে পাশে থাকে, কৃতজ্ঞ থাকে, আমার ভালোকে প্রাধান্য দেয়—খুউব ভালো এবং সেটা যেন আপনার কাছে ‘অপ্রত্যাশিত পাওয়া’ হয়। তাইলে দেখবেন আপনি সুখী আছেন। আর যত নিজের চাওয়া পূরণ করার ভার অন্যের উপর চাপিয়ে দিবেন তত আপনার অহম বাড়বে; জানবেন, আপনি আসলে নিজের মতো করে সবকিছু চান এবং সেটা আর যাই হোক ভালবাসা না। কারণ ভালবাসা তো অন্যের ভালোতে বাস করা, তাই না?