বাবা-মা আমাকে বোঝে না

আমার বাবা-মা আমাকে বোঝে না, ভালবাসে না, আমার স্বাধীন বিকাশের পথে অন্তরায়, কঠিন নিয়ম-শৃঙ্খলার নিগড়ে বন্দি করে রেখেছে- বাবা-মাকে নিয়ে এরকম অভিযোগ আমরা অনেকেই করি। অনেক সময় তা সঙ্গতও। তারা হয়তো তাদের চিন্তাটা সন্তানের ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন বা নিজের অপূর্ণ স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখতে চাচ্ছেন তার চাওয়া বা পরিবর্তিত সময়ের কথা মাথায় না রেখে।

কিন্তু এই ক্ষোভের নিট রেজাল্ট কী? আরো ক্ষোভ, আরো ব্যর্থতা এবং আরো হতাশা। কাজেই ব্যাপারটাকে এভাবে দেখুন, বাবা-মা গ্রেটেস্ট হতে পারেন, কিন্তু আপনি হলেন লেটেস্ট। লেটেস্টের দায়িত্ব যেহেতু বেশি, তাই বাবা-মা যদি আপনাকে বুঝতে না পারেন, বোঝানোর দায়িত্ব আপনার। তাদেরকে বোঝাতে হবে সেই ভাষায় যা তারা বোঝেন। আর তা হলো শ্রদ্ধার ভাষা, মমতার ভাষা, ভালবাসার ভাষা- যে ভাষার কোনো জেনারেশন গ্যাপ নেই। আর যদি এমন হয় সমবয়সী বা মিডিয়ার চাকচিক্য দ্বারা প্রভাবিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে আপনার এ চাহিদা এবং যা দেয়ার সামর্থ্য তাদের নেই- তাহলে তাদের প্রজ্ঞাকে আপনার মেনে নেয়া উচিত।  

অনেককাল আগে এক গ্রামের মধ্যখানে ছিল বিশাল এক আমগাছ। একটি শিশু রোজ এসে সেই গাছের ডালে ঝুলে খেলা করতো। আম পেড়ে খেতো। দুপুরবেলা ক্লান্ত হয়ে সেই গাছের নিচেই খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতো। গাছও শিশুটির এই আনন্দে যোগ দিতো। কিন্তু একদিন সে এলো না। অপেক্ষা করে করে গাছ বুঝলো আজ আর সে আসবে না। এভাবে কেটে গেল অনেকদিন। হঠাৎ একদিন দেখে একটি বালক মন খারাপ করে বসে আছে গাছের গোড়ায়। সেই শিশু এখন বালক হয়েছে। গাছ জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে প্রিয় বন্ধু আমার? কেন তুমি এতদিন আসো নি? ছেলেটি বললো, আমি এখন বড় হয়েছি। গাছ নিয়ে খেলতে আর আমার ভালো লাগে না। আমার এখন খেলনা দরকার। কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই। গাছ বলল, আহা! কিন্তু বন্ধু টাকা তো আমার কাছে নেই। তুমি না হয় আমার সব আমগুলো পেড়ে নিয়ে যাও। এগুলো বিক্রি করলে নিশ্চয়ই কিছু টাকা পাবে। বালকটি তাই করল। কিন্তু এরপর আর সে এলো না। গাছ অপেক্ষা করছে।

অনেকদিন পর এক সুঠাম দেহের যুবক এল সেখানে। গাছ চিনতে পারল তাকে। খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, এসো বন্ধু আমরা আবার আগের মতো খেলি। রুক্ষস্বরে যুবকটি জবাব দিলো, না খেলার সময় আমার নেই। আমাকে এখন সংসারের জন্যে রুজি-রোজগার করতে হয়। আমার এখন একটা ঘর দরকার। গাছটি বলল, ও আচ্ছা, কিন্তু ঘরতো আমার নেই। তুমি বরং আমার ডালগুলো সব কেটে নিয়ে যাও। এগুলো দিয়েই বানাতে পারবে তোমার ঘর। যুবকটি তাই করল। যুবককে খুশি দেখে গাছের মনও আনন্দে নেচে উঠল।

কেটে গেল আবারও অনেকদিন। নিঃসঙ্গ গাছটি এখনও অপেক্ষা করে প্রিয় বন্ধুকে দেখার আশায়। অনেকবছর পর এক মধ্যবয়সী পুরুষ এসে দাঁড়াল গাছের নিচে। বললো সংসারের ধকল সামলাতে সামলাতে আমি ক্লান্ত। মনটাকে চাঙ্গা করার জন্যে আমি এখন সমুদ্রে বেরিয়ে পড়তে চাই। কিন্তু আমার যে কোনো নৌকা নেই। গাছ বললো, ভাবনা কি বন্ধু। আমার কাণ্ডখানা নিয়ে যাও। এটা দিয়েই নৌকা বানাতে পারবে তুমি। প্রাচীন গাছের বিশাল কাণ্ড ঠেলায় চাপিয়ে চলে গেল সে মধ্যবয়সী পুরুষ।

অনেক অনেক বছর পর লাঠিতে ভর করে ধীর পায়ে গাছের সেই জায়গায় এসে দাঁড়ালো বয়সের ভারে নুয়ে পড়া এক বৃদ্ধ। গাছটি আজ আর নেই। মৃতপ্রায় শেকড়ের একটা ঢিবি ছাড়া গাছের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। তবুও সে বলে উঠল, এসেছ বন্ধু! কিন্তু তোমাকে দেবার মতো আমার যে আর কিছু নেই। ফল নেই, ডাল নেই, কাণ্ড নেই। কী দিয়ে তোমাকে আমি সেবা করব বলো? বৃদ্ধ বললো, ওসব দিয়ে আজ আর আমার কোনো কাজ নেই। আমি এখন বৃদ্ধ অবসন্ন। বিশ্রামের একটু জায়গাই এখন আমার চাওয়া। গাছ বললো, বন্ধু বুড়ো গাছের মরা শেকড়ের চেয়ে ভালো বিশ্র্রামের জায়গা আর কী হতে পারে? এস, ঠেস দিয়ে বসো। সব ভাবনা ভুলে নিশ্চিন্তে আরাম কর।

বৃদ্ধ তাই করল। অনেকদিন পর হাসল নিঃসঙ্গ গাছ। কাঁদলও। তবে এ কান্না আনন্দের। হারানো প্রিয়জনকে কাছে ফিরে পাবার খুশিতে।
এই শিশু থেকে বৃদ্ধে পরিণত হওয়া মানুষটিকে কি আপনার নিষ্ঠুর মনে হচ্ছে? অকৃতজ্ঞ মনে হচ্ছে? তাহলে মনে করে দেখুন তো আপনার মাকে কি আপনি কখনো ধন্যবাদ দিয়েছেন আপনাকে ধারণ, লালন এবং পালনের খুঁটিনাটি কাজগুলো বছরের পর বছর ধরে অম্লান বদনে করে যাবার জন্যে? বাবাকে কি কখনো থ্যাংকস জানিয়েছেন কষ্টার্জিত উপার্জনে আপনাকে আজকের অবস্থান গড়ে দেয়ার জন্যে? শাসনের আড়ালে স্নেহপূর্ণ মন নিয়ে আপনাকে সঠিক পথে নির্দেশিত করার জন্যে? হয়তো আপনি মনে করতে পারবেন না। কারণ মা-বাবা আমাদের জন্যে যা কিছু করেন আমরা ধরে নিই যে, এটা তো তাদের দায়িত্ব। কিন্তু ভেবে দেখুন, এর যে কোনো একটি ক্ষেত্রেও যদি তারা দায়িত্বটি পালন না করতেন, কী অবস্থা হতো আপনার! কত অসহায় হয়ে পড়তেন আপনি!