মুখোমুখি

শিক্ষাবিদ, লেখক ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার।

 

এই এক বাজপাখি এসে নেমেছে মানুষের সংসারে, তার কালো পাখার ছায়া বিস্তার করে, নিষ্ঠুর ঠোঁটে তুলে নিচ্ছে মানুষের প্রাণ। সময় নেই, অসময় নেই, পাঁজিপুথি লগ্ন-অলগ্ন নেই, মঘা-অশ্লেষা-ত্র্যহস্পর্শ নেই, অনেক সময় কোনো আগাম জানান দেওয়া নেই, সে এসে দেহে থানা গেড়ে বসে। বলে, ‘আমি এলাম, তোমার দিনের হিসেব ছোটো করো, কাজকর্ম ছাঁটাই করো, তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ যদি কেউ বলে ‘কোথায় যাব তোমার সঙ্গে? এখনো যে আমার অনেক কাজ বাকি আছে, অনেক কিছু করার ছিল, নিজেকে নিয়ে, সন্তানদের নিয়ে, সন্তানের সন্তানদের নিয়ে অনেক স্বপ্ন’—সে বলে, ‘ভুলে যাও ওসব কথা। সময় নেই। প্রস্তুত হও।’

ওই বাজপাখিটির নাম ক্যান্সার।

বেশিরভাগ সময়ে সে শুধু মানুষটিকে ধ্বংস করে না, তার সংসারের ভিত নড়িয়ে দেয়, তার স্বজনেরা তাকে বিদায় দিয়ে নিজেদের ভাঙাচোরা অস্তিত্বকে আবার সটান খাড়া করতে পারে কিনা সন্দেহ। অনেক সংসার দুমড়ে-মুচড়ে যায়। কিন্তু আমি মানুষটির কথা ভাবি। সে কী ভাবে? সে কী বোঝে? সে নিজের অতীত-ভবিষ্যতের কী হিসেব করে, বর্তমানকে কোন্‌ চোখে দেখে? কী চায়, কী চায় না?

রবীন্দ্র-ভক্ত আমেরিকান-ইহুদি মনোবিজ্ঞানী ডা. এলিজাবেথ কুবলার রসের ‘অন ডেথ অ্যান্ড ডাইয়িং’ বইয়ে মৃত্যুপথযাত্রী রোগীদের (সবাই এই রোগের শিকার নয়) বিষয়ে পড়েছিলাম—নানা হাসপাতালে প্রায় চারশো এমন রোগীর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন তিনি—যে, অনেক রোগী যখন প্রথম শোনে একথা, ডাক্তার তার কাছে যখন সেই অমোঘ ভবিতব্যের কথা প্রথমে বলেন তখন সে একেবারেই বিশ্বাস করতে পারে না যে, বিষয়টা তার ক্ষেত্রে ঘটতে চলেছে। ‘এ হয় না, হতে পারে না! নিশ্চয়ই ডাক্তারের কোনো ভুল হয়েছে, নিশ্চয়ই দু-দিন পরেই জানা যাবে যে তার ওই সিদ্ধান্ত ভয়ানক ভ্রান্ত। তখন আবার যেমনটি ছিল সব ঠিক তেমনটি হয়ে যাবে, এই দুদিনের আতঙ্ক নিরুদ্দেশ হবে। আহ্‌! সেই দিনটা নিশ্চয়ই খুব কাছেপিঠেই অপেক্ষা করছে!’

যখন সেটা ঘটে না, তখন তার খুব রাগ হয়। কার ওপর রাগ? যদি সে বিশ্বাস করে তা হলে ঈশ্বরের ওপর রাগ, না হলে বিশ্ববিধানের ওপর রাগ। সে ভাবে, ‘Why me?’ ‘এত লোক থাকতে আমাকে কেন?’ এই তীব্র অভিমান আর রাগ নিয়ে সে সংসারের থেকে সাময়িকভাবে মুখ ফিরিয়ে নেয়। তার পরে সে যে অবস্থায় নিজেকে নিয়ে যায়, ডা. রসের ভাষায় তার নাম ‘bargaining’, দরাদরি। ‘আচ্ছা, আমি যদি ডাক্তারের কথা শুনে ঠিকঠাক চলি তা হলে নিশ্চয়ই ওটা অত তাড়াতাড়ি ঘটবে না, কিংবা কে জানে, হয়তো রেহাই পেয়ে যেতেও পারি! দেখিই না একবার চেষ্টা করে!’ এই অলীক আশার সীমানাও যখন সে পার হয়ে যায়, ডাক্তার যখন আর কোনো আশা জোগাতে পারেন না, তখন তার মধ্যে এক প্রবল মানসিক হতাশা আসে, এক ভয়ংকর অন্ধকার অস্তিত্ব। সব শেষে এই অবস্থাকে অতিক্রম করে আসে আত্মসমর্পণের পর্ব—‘যা ঘটবার তা ঘটুক, আমি প্রস্তুত’। এখানে তার মনে কোনো পরকাল বা পরলোকের বিশ্বাস কাজ করে কিনা, ডা. রস তা নিয়ে বিশেষ ব্যস্ত হন নি, তিনি শুধু মরণান্তিক রোগীদের এই ‘শোকচক্র’ বা ‘গ্রিফ সাইক্‌ল’ নির্মাণ করেছেন, যা নামান্তরে ‘ডা. কুবলার রস্‌ মডেল’ নামে খ্যাত।

আমি এই বয়সে এরকম রোগী কিছু দেখেছি। তাদের মধ্যে এই চক্র কতটা কার্যকর ছিল তা ধারাবাহিকভাবে লক্ষ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় নি, সে সুযোগও ছিল না। কিন্তু আমি তাদের কারো কারো লড়াই করার সাহস দেখে অবাক হয়ে গেছি। তারা জানত মৃত্যু আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে, কিছুদিনের মধ্যেই লাফিয়ে পড়বে। কিন্তু তাকে এমনভাবে উপেক্ষা করেছে তারা, যে আমি প্রথমে বিশ্বাস করতে পারি নি। নিজের একলা মুহূর্তে তারা কী করেছে, বা একান্ত আত্মজনের সম্মুখে তারা কোনো দুর্বলতা দেখিয়েছে কিনা আমি জানি না, কিন্তু আমি তাদের যেভাবে দেখেছি, তাতে তাদের মাথা উঁচু করা অহংকার দেখে বিস্মিত হয়েছি। মনে হয়েছে, তারা ঘটনাটার সঙ্গে চমৎকার বোঝাপড়া করে নিয়েছে, আর তাদের কোনো উদ্বেগ নেই।

বোঝাপড়া, বোঝাপড়া। মৃত্যুর সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে। আমার ছাত্র প্রত্যয়কে দেখেছি, প্রত্যয় বন্দ্যোপাধ্যায়। যাদবপুরের ছাত্র, পরে রামপুরহাট কলেজের অধ্যাপক। মুম্বাইয়ে গিয়ে বুকের পিঠের হাড়-টাড় কাটিয়ে সে একটা ইস্পাতের খাঁচা পরে ফিরে এলো। কিন্তু তার নিরাময় হয় নি। শেষ যখন তার সঙ্গে দেখা হলো নীলরতন সরকার হাসপাতালে, তখনো সে ওয়ার্ডে ঘুরে ঘুরে অন্যান্য রোগীদের সঙ্গে হাসিঠাট্টা করছে, ফিরে এসে নিজের বেডে বসে, আমাদের সঙ্গে কত কথা, যেন কিছুই হয় নি, যেন জীবন যেমন চলছে তেমনই চলবে, তার চারদিকে কোনো কালো ছায়া নেই, কোনো ভয় বা সংকট নেই। ভয় পাওয়া যেন তার বিবেচনার বাইরে ছিল, তার অহংকারে বাধত।

আমরা তার ওই ছবিটি ধরে রেখেছি।

ইদানীংকালের জনপ্রিয়তম বাঙালি লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা পড়েছি। হুমায়ূন সিঙ্গাপুরে না হংকং-এ গিয়েছিলেন তার ক্যান্সার-আক্রান্ত শাশুড়িকে দেখাতে। হঠাৎ কী খেয়াল হলো, নিজেকেও দেখিয়ে নিতে গেলেন। ব্যস্‌, স্বপ্নেও যা ভাবেন নি, ডাক্তার বললেন তাকেও ধরেছে ওই মারণ-রোগ, এবং এটা একেবারে চতুর্থ পর্যায়, তার হাতে আর বেশি সময় নেই। আমি তার উপস্থিত প্রতিক্রিয়ার কথা জানি না, তিনি এ নিয়ে কিছু লিখেছেন কিনা তাও আমার চোখে পড়ে নি। কিন্তু নিউ ইয়র্কের স্যানাটরিয়ামে তিনি মানুষের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কথা বলেছেন। এক সাংবাদিকের নির্বোধ, হয়তো কিছুটা হৃদয়হীন, প্রশ্ন—‘এখন আপনার কী ইচ্ছে করে?’ শুনে তিনি তাকে কী উত্তর দিয়েছিলেন জানি না, কিন্তু পরে এক আত্মজনের কাছে বলেছেন, ‘আমি তো ওকে বলতে পারি না যে, আমার এখন শুঁটকি মাছ দিয়ে কচুর শাক খেতে ইচ্ছে করছে!’

এই ইচ্ছেটাই মৃত্যুকে তুচ্ছ করে, মৃত্যুকে জয় করতে চায়।

সেদিন শোকসভায় গিয়ে শুনলাম স্নেহাষ্পদ করুণাসিন্ধু দাসের কথা। অত্যন্ত সুভদ্র, সজ্জন মানুষ ছিল সে, সংস্কৃতের মস্ত বড়ো পণ্ডিতও বটে। পাণ্ডিত্যের কোনো অহংকার একেবারেই ছিল না, তার ভাণ, ভনিতা বা পোশাক—কিছুই সে প্রদর্শন করতে চায় নি। নিজের যোগ্যতাতেই রবীন্দ্রভারতীর ছাত্রপ্রিয় অধ্যাপক, ডিন ও উপাচার্য হয়েছিল। অবসর নেওয়ার পর আইসিসিআর-এর আমন্ত্রণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতীতে গবেষক-অধ্যাপকের দায়িত্বও বহন করেছে সে।

হঠাৎই শুনলাম তাকেও ধরেছে ওই কালব্যাধি, এবং সে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। এ খবর শোনার পঞ্চম দিনেই শুনলাম তার মৃত্যুসংবাদ—যাব-যাব করে তাকে দেখতে যাওয়ার সুযোগই হলো না।

কিন্তু সে শুনেছি প্রায় শেষ দিন পর্যন্ত তার মোবাইলটি পাশে রেখেছে, ফোন ধরেছে, সংস্কৃতবিদ্যার দুরূহ বিষয়ে উজ্জ্বল আলোচনা করে জিজ্ঞাসুকে আলোকিত করেছে, যেমন আগেও দেখা গেছে—বিদ্যার আলোচনায় তার কণ্ঠস্বরে প্রবল উৎসাহ, তাতে ক্লান্তির কোনো ছাপ নেই।

আমার কাছে এই হার-মানতে না-চাওয়ার গল্পগুলো যখন এসে পৌঁছায় তখন আমি দু-হাত তুলে নাচতে থাকি। শ্রদ্ধেয় অশোক মিত্রের কাছে শুনেছি, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মৃত্যুশয্যায় শেষ লগ্নে তার পাশে এসে বসেছিলেন আজীবন বন্ধু দিলীপকুমার রায়। দিলীপকুমার বন্ধুর দশা দেখে ব্যথিত হয়ে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যেই হয়তো বলছিলেন, ‘ধূর্জটি, এই সময়ে তুমি একটু ঈশ্বরের নাম করো।’ তাতে ধূর্জটিপ্রসাদ নাকি সেই অর্ধচেতনার মধ্যে হাতের বুড়ো আঙুল তুলে দিলীপকুমারকে তিন বার বলেছিলেন, ‘ঈশ্বর নাই, ঈশ্বর নাই, ঈশ্বর নাই।’

আমরা অনেকে তার কথা মানব কি মানব না, সেটা অন্য কথা। কিন্তু মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে এই সাহসী উচ্চারণটির জন্যে আমি প্রতীক্ষা করি।

কিংবা আমার মাস্টারমশাই, অধ্যাপক অরুণকুমার বসু। সুখের বিষয়, তিনি এখনো আমাদের মধ্যে আছেন, সজীব এবং মানসিকভাবে সচ্ছল। গলা ভেঙে আসছিল তার অনেকদিন, তবু পড়ানোয় ক্ষান্তি দেন নি। রোগটির চরিত্র সম্বন্ধে তার কোনো সন্দেহ হয়ে থাকলে তিনি আত্মজনের কাছে তা দীর্ঘদিন গোপন করেছিলেন, অনেকেই যেমন করে। তার পরে তা জানাজানি হলো, চিকিৎসা শুরু হলো। রেডিয়েশন দিয়ে।

আমি এ ধরনের মানুষের মুখোমুখি হতে একটু ভয় পাই—কী বলব তাকে, যে কথায় সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করব তা নিশ্চয়ই আড়ষ্ট আর কৃত্রিম শোনাবে।

কিন্তু তার সঙ্গে একদিন দেখা হয়ে গেল। আশ্চর্য ব্যাপার, চারটে রেডিয়েশন দেওয়ার পর, একদিনের রেডিয়েশন মুলতুবি রেখে তিনি এসেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার পিএইচ-ডি কমিটির একটি মিটিংয়ে, তার এক গবেষক ছাত্রীকে শেষ বাঁকটা পার করে দিতে।

আমি খুব অবাক হয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম।

দেখামাত্র অনর্গল কথা শুরু করে দিলেন। গলার স্বর বশে নেই, কিন্তু তা তাকে দমিয়ে দিতে পারছে না। অথচ এই অরুণদাই একসময় দক্ষিণীতে তিন বছর রবীন্দ্রসংগীত শিখেছিলেন। কথার মধ্যে কোনো বিশ্রাম নেন নি, কখনো হাত ধরে, কখনো টেবিল ঠুকে, আগেকার মতোই অন্তরঙ্গ কথা নির্মাণ করছিলেন এককালের ছাত্রকে পেয়ে। রেডিয়েশনের ফলে মুখের স্বাদ একেবারেই চলে গেছে, যা খান তা যেন কাগজের মতো লাগে। নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিচিত্র অভিজ্ঞতা, নিজের লেখাপড়ার সংকট—কিন্তু সমস্ত কথাই বলছেন যেন ইয়ার্কির মতো করে, যেন ব্যাপারটায় ভীষণ মজা পাচ্ছেন তিনি, এবং আমাদেরও সেই মজাটার মজাই তিনি দিতে চাইছিলেন তার দাপুটে কথাবার্তায়।

ওঠবার সময় মুচকি হেসে রবীন্দ্রনাথের গানের প্যারোডি করে বললেন, ‘ক্যান্সারে যবে মন কেড়ে লয়’—

না, ক্যান্সার তার মন কেড়ে নিতে পারে নি।

ওই শিক্ষাটুকুও তার কাছে আমার নেওয়ার ছিল।