published : ২৫ মার্চ ২০২৪
একজন সাহাবী মা আয়েশাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, নবীজীর (স) চরিত্র কেমন ছিল? আয়েশা (রা) উত্তর দিলেন, তুমি কি কোরআন পড়ো নি? হযরত মুহাম্মদ (স) ছিলেন কোরআনের শিক্ষারই ফলিত রূপ।
মানবতার মুক্তির সনদ পবিত্র কোরআন। আপনি যত কোরআন অনুসরণ করবেন ইহকাল ও পরকাল দুই জীবনেই আপনি সফল ও সম্মানিত হবেন। নবীজীকে (স) অনুসরণের মাধ্যমে আপনি কোরআনের শিক্ষা অনুধাবন করতে পারবেন। আর যত তাকে ভালবাসবেন তত সহজ হবে তার জীবনাদর্শ অনুসরণ।
একজন ব্যক্তি ততক্ষণ প্রকৃত মুমিন নয় যতক্ষণ না সে নবীজীকে (স) তার নিজের জীবন, পিতামাতা ও সন্তানাদির চেয়ে বেশি ভালবাসছেন।
বোখারী শরীফের একটি হাদীস হলো, একবার হযরত ওমর ফারুক (রা) নবীজীকে (স) বললেন, ‘হে আল্লাহর রসুল! আপনি আমার কাছে সবকিছুর চেয়ে বেশি প্রিয়, কেবল আমার জীবন ছাড়া।’ নবীজী (স) বললেন, তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ তুমি আমাকে নিজের চেয়েও বেশি ভালবাসছ’।
ওমর (রা) তৎক্ষণাৎ বললেন, ‘খোদার কসম! এখন থেকে আপনি আমার জীবনের চেয়ে বেশি প্রিয়।’
রসুল (স) বললেন, ওমর! এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হলো।’
নবীজী (স) ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি আমাকে ভালবাসল, সে জান্নাতে আমার সঙ্গে অবস্থান করবে। (তিরমিজী)
এক সাহাবী নবীজীকে (স) যখন বললেন, ‘আমি বেশি কিছু আমল করতে পারি না, তবে আল্লাহতায়ালা ও তাঁর রসুলকে (স) ভালবাসি’, তখন নবীজী (স) বলেছিলেন, ‘তুমি তার সঙ্গী হবে, যাকে তুমি ভালবাস। অর্থাৎ, তুমি যেহেতু আল্লাহ ও তাঁর রসুলকে ভালবাসার আমল করেছ, সুতরাং তুমি আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে। আল্লাহতায়ালা তোমাকে জান্নাত দান করবেন’।
বোখারী শরীফের একটি হাদীসে আছে, ‘আল্লাহ সব নবীকেই একটি বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। তা-হলো, তাদের একটি দোয়া অবশ্যই কবুল করা হবে। সব নবীই প্রয়োজন মোতাবেক একেকটি জিনিস চেয়ে নিয়েছেন এবং তারা সবাই পার্থিব জিনিস চেয়েছেন। কিন্তু আমি এ সুযোগ পৃথিবীতে গ্রহণ করি নি। রোজ হাশরে আমি আমার প্রাপ্য আদায় করব এবং তা হবে আমার উম্মতের নাজাতের জন্যে সুপারিশ করা।’
হাশরের ময়দানে মহানবীর (স) সুপারিশ পেতে হলে তার শিক্ষা মেনে পৃথিবীতে পথ চলতে হবে। আল্লাহর নির্দেশ পালন করার সাথে অনুসরণ করতে হবে নবীজীবন।
সূরা আহজাবের ২১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ ও মহাবিচার দিবস সম্পর্কে যারা সচেতন এবং আল্লাহকে যারা বেশি বেশি স্মরণ করে, নিশ্চয়ই তাদের জন্যে আল্লাহর রসুলের মধ্যেই রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’।
আসলে কাউকে আপনি যত গভীরভাবে অনুসরণ করবেন, ভালবাসবেন তত তার গুণাবলী আপনার মধ্যে আসবে। নবীজী (স) সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ রোল মডেল। অর্থাৎ, অনুসরণীয় ব্যক্তি। তাকে ভালবাসার মধ্য দিয়েই আপনি নিজেকে তার গুণে গুণান্বিত করতে পারেন।
সৃষ্টির প্রতি করুণার প্রতীক ছিলেন তিনি। মানুষকে ভালবাসতেন ধর্ম-বর্ণ, জাত-পাত নির্বিশেষে। তার ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয় নি তাকে কষ্ট দেয়া প্রতিপক্ষও।
বদরের যুদ্ধের একটি ঘটনা। যুদ্ধবন্দি আব্বাসকে বেঁধে রাখা হয়েছে। নবীজী (স) রাতে ঘুমাতে পারছেন না। তাকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, আব্বাস তো কাঁদছে!
তায়েফবাসীকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে গেলে তারা তো তার বাণী গ্রহণ করলই না, উল্টো তাকে পাথর মেরে নির্মমভাবে আহত-রক্তাক্ত করল। এত বেশি রক্ত ঝরল যে রক্তে জুতা ভরে গেল। তখন পাহাড়ের ফেরেশতারা তাকে বললেন, হে আল্লাহর রসুল! আপনি অনুমতি দিন, আমরা ওদেরকে দুই পাহাড়ের মধ্যে পিষে দেবো। নবীজী (স) ফরিয়াদ করলেন, হে আল্লাহ! ওদের যদি তুমি ধ্বংস করে দাও তাহলে তোমার বাণী আমি কার কাছে পৌঁছাব?
এমনটাই ছিল মানুষের জন্যে নবীজীর (স) ভালবাসা। আর উম্মতের পরকালীন মুক্তির জন্যে তার ব্যাকুলতা ছিল অসামান্য। ইবনে হিব্বান বর্ণিত হাদীসমতে, প্রতিদিন প্রত্যেক নামাজের পর উম্মতের গুনাহের জন্যে ক্ষমাপ্রার্থনা করতেন তিনি।
জাবের বিন আবদুল্লাহ ও আবু হুরায়রা (রা) বর্ণিত, ‘আমার ও লোকদের উদাহরণ এমন লোকের মতো, যে আগুন জ্বালালো, তখন কীট-পতঙ্গসমূহ আগুনে পড়তে লাগলো। সে সেগুলোকে আগুন থেকে ফিরানোর চেষ্টা করল। আমিও তোমাদের কোমর ধরে আগুন থেকে বাঁচাবার চেষ্টা করছি। কিন্তু তোমরা আমার সামনেই পতিত হচ্ছ!
নবীজী (স) আপনাকে ‘ভাই’ বলে সম্বোধন করেছেন!
নবীজী (স) শুধু নিজ সময়ের উম্মত ও সাহাবীদেরই ভালবাসতেন না, অনাগত উম্মতদের প্রতিও তার ভালবাসা ছিল তীব্র।
আনাস (রা) থেকে বর্ণিত, রসুল (স) বলেন, ‘আমার ভাইদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে ইচ্ছা করছে!’
সাহাবীরা বললেন, আমরা কি আপনার ভাই নই? রসুল (স) বললেন, ‘তোমরা তো আমার সাহাবী! আমার ভাই হলো তারা যারা আমাকে না দেখেও আমার ওপর ঈমান আনবে।’ (মুসনাদে আহমাদ)
যে মানুষটা আমাদের এতটা ভালবেসেছেন তাকে ভাল না বাসলে কাকে ভালবাসবেন!
আলোকোজ্জ্বল নতুন সভ্যতার ভিত্তি ছিল তার জীবনাচার। তার জীবন ছিল তার বাণীরই মূর্ত প্রতীক। তার পুরো জীবনীতে রয়েছে মানবজাতির জন্যে শিক্ষণীয় বিষয়। এই মানুষটাকে চিনতে হলে তাই পড়তে হবে তার জীবনী। কারণ তাকে নিয়ে যত অপপ্রচার তা মূলত তার জীবনাচার না জানার কারণেই।
দরুদ পড়া নবীজীর (স) প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন। আল্লাহ তাঁর রসুলের প্রতি দরুদ পাঠের নির্দেশ দিয়ে কোরআনুল কারিমে বলেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতারা রসুলের ওপর দরুদ পড়েন। হে ঈমানদারগণ! তোমরাও তার প্রতি দরুদ পড়ো’। (সূরা আহজাব-৫৬)
মানুষের সামনে-পেছনে কিছু ফেরেশতা নিযুক্ত থাকেন। কেউ দরুদ পড়লে তারা তা সংগ্রহ করে নবীজীর (স) রওজা মোবারকে নিয়ে গিয়ে সেই ব্যক্তি ও তার বাবার নাম উল্লেখ করে বলেন, ইয়া রসুলুল্লাহ! অমুক আপনাকে দরুদ প্রেরণ করেছেন।
নবীজী (স) বলেছেন, ‘যে আমার প্রতি একবার দরুদ পড়বে, আল্লাহ তাকে ১০ বার রহমত করবেন, তার ১০টি গুনাহ মাফ করে দেবেন আর তার মর্যাদা ১০ গুণ বাড়িয়ে দেবেন’। (নাসাঈ)
মেশকাত শরীফের একটি হাদীস হলো, ৪০টি হাদীসের জ্ঞান যে আত্মস্থ ও সংরক্ষণ করবে, মহাবিচার দিবসে একজন জ্ঞানী হিসেবে তার পুনরুত্থান হবে এবং আমি [নবীজী (স)] তার শাফায়াতকারী হবো।
রমজানে তাই হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী বই পুরোটা একবার পড়ে ফেলুন। এরপর সেখান থেকে নোট করে নিন আপনার জন্য প্রয়োজনীয় ৪০টি হাদীস। বাছাইকৃত হাদীসগুলো প্রতিদিনই কিছু কিছু পড়ুন। তাহলে সেগুলো আপনার আত্মস্থ হয়ে যাবে, জীবনে প্রয়োগ করতে পারবেন আপনি।
বিদায় হজে নবীজীর (স) আহ্বান, হে মানুষ! তোমরা যারা এখানে হাজির আছ, আমার বাণী সবার কাছে পৌঁছে দিও। যার কাছে বাণী পৌঁছাবে, হতে পারে সে তোমার চেয়েও এ বাণীর উত্তম সংরক্ষক ও প্রচারক।
তাই আসুন এবারের রমজানে হাদীস শরীফ বাংলা মর্মবাণী বিতরণের মাধ্যমে নবীপ্রেমে আপ্লুত হই, সামাজিকায়ন ঘটাই নবীপ্রেমের। ৪০টি বা সাধ্যমতো সংখ্যক হাদীস মর্মবাণী বিতরণ করি আল্লাহর সন্তুষ্টি, মৃত মা-বাবার আত্মার মাগফেরাত কিংবা নিজের বিশেষ কোনো নিয়তে।
নবীজী (স) যদি শেষ বিচারের দিন আমাদের জিজ্ঞেস করেন, তুমি এত কিছু করেছ, এত বই পড়েছ, আমার হাদীস কি পড়েছ, মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছ? সেদিন আমরা তৃপ্তিভরে বলতে পারব, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমরা তা করেছি!