“কি বিছানা থেকে উঠবি? নাকি তোর বাবাকে ডাকব!” সাত সকালে পাশের বাসা থেকে ভেসে আসা চিৎকার শুনে ঠোঁটে মুচকি হাসি খেলে গেল। কল্পনায় দিব্যি দেখতে পারছিলাম কি হচ্ছে পাশের বাসায়। স্কুলে যাওয়ার জন্যে বাচ্চাকে ঘুম থেকে উঠানোর চেষ্টা। ক্লাস থ্রি-তে পড়া বাচ্চা ছেলেটার জন্যে একটু মায়াই লাগল। আবার বাচ্চার মায়ের অবস্থাটাও চিন্তা করা দরকার। এটা তার শেষ অস্ত্র।
এর আগে বার কয়েক বাবা-সোনা বলে বাচ্চাকে ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা করা হয়। সাধারণত কয়েকবারের চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এই হুংকার। আর এটা সবসময় খুব ভালো কাজ করে। ইয়ে, মানে আমার নিজের বেলাতেও দেখেছি। খুব ভালো কাজ করে।
তবে কোনো কোনো দিন বোধ হয় মা-ছেলের দু’জনেরই ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে যায়। সে দিনগুলিতে এক বিচিত্র দৃশ্য দেখা যায়। ছেলে শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে হাঁটছে। পাশে মা, হাতে নাস্তার প্লেট। স্কুলভ্যানে ওঠার আগে রাস্তায় নাস্তা সারার ব্যবস্থা। ছেলেটা অবশ্য প্রকাশ্যেই এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধাচরণ করে। অবুঝ বাচ্চা, নিজের ভালো বোঝে না ! একটু আগে ঘুম থেকে উঠলে কত সুবিধা।
আচ্ছা আমার কি অবস্থা? আমি কি নিজের ভালো বুঝি? হ্যাঁ, ঠিকই তো বলেছেন, একজন পূর্ণবয়স্ক স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে নিজের ভালো অবশ্যই আমার বোঝা উচিত। হয়তো বুঝিও। এই যেমন সকালে ঘুম থেকে ওঠার কথা হচ্ছিল। এটার কথাই ধরুন। আমি খুব বুঝি যে, সকাল সকাল ঘুম থকে উঠে ব্যায়াম, মেডিটেশন করে ঘর থেকে বের হলে সারাদিন চমৎকার ছন্দময়তায় কাটবে। কিন্তু সমস্যা হলো প্রায় প্রতিদিন সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, আমার অবস্থা পাশের বাসার সেই ছেলেটির মতোই। ঠিক সময়ে কীভাবে অফিস পৌঁছব, এই চিন্তায় সকালের নাস্তাটাও ঠিকমতো করা হয় না। মেডিটেশন তো দূরের কথা।
সারা সকালে একটু সুস্থির হয়ে চিন্তার সুযোগ পাওয়া যায় যখন বাথরুমে থাকি। অবশ্য অনেক জ্ঞানীর ক্ষেত্রেই নাকি এমন ঘটে বলে শোনা যায়। তা যাই হোক, নিজেকে জ্ঞানী দাবি করছি না। তবে বিশ্বাস করুন প্রায়দিনই বাথরুমে গিয়ে মনে পড়ে ঘুম থেকে উঠে শোকর আলহামদুলিল্লাহ বলা হয় নি। একটা চমৎকার নতুন দিন উপহার দেওয়ার জন্যে প্রভুকে ধন্যবাদও জানানো হয় নি এবং ঐ অবস্থায় কী করা উচিত তাও বুঝতে পারি না।
সদাচরণ, সুন্দর ব্যবহার, হাসিমুখে কথা বলা এসব যে কত গুরুত্বপূর্ণ তাও জানি। কিন্তু অফিসে যাবার তাড়া, এমন সময় যদি রিকশাওয়ালা উল্টা-পাল্টা ভাড়া চেয়ে বসে। রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় বলেন! রিকশাওয়ালার সাথে গলার রগ ফুলিয়ে ঝগড়া করে অফিসে আসি। অফিসে কাজ শুরুর আগে নিয়মমাফিক বস ও সহকর্মীদের ভুল ত্রুটি নিয়ে একটু আলোচনা করে নেই। কি বললেন, গীবত? না না গীবত হবে কেন? কেউ অন্যায় করবে, আমার সাথে অবিচার করবে, আর আমি তা বলতেও পারব না!
এর মাঝে হয়তো সঙ্ঘ থেকে কোনো কাজের অনুরোধ এসেছে। দায়িত্ব নেয়ার বদলে হয়তো অনেক সময় কাজ বা ব্যস্ততার অজুহাতে দায়িত্ব এড়িয়েছি। আসলেই তো ভাই ব্যস্ত। দেখেন না, সকালের নাস্তা করার সময়ও পাই না। এছাড়াও সবসময় কি এসব কাজের মুড থাকে?
এক নতুন বছরের প্রাক্কালে যদি পিছনের দিকে তাকাই তাহলে দেখি গত বছরটি মোটামুটি এমন অসংখ্য ভুলের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। যা সত্য সুন্দর বলে জেনেছি, বিশ্বাস করেছি তার অনেক কিছুই মানা হয় নি। হয়তোবা একারণেই গত এক বছরে যতটুকু এগিয়ে যাবার কথা ছিল, সম্ভব হয় নি।
যাই হোক ২০১৩ সাল। কোয়ান্টাম বর্ষ ২১। শপথের বছর, বিশ্বাসের আলোকে নিজেকে বদলানোর বছর। আমি যতটুকু বুঝেছি এই বদলানো শুরু করতে হবে ছোট ছোট বিষয়ের মধ্য দিয়ে। এই যেমন ধরুন সময়মতো ঘুম থেকে ওঠা, স্রষ্টাকে ধন্যবাদ জানানো। যাতে বাথরুমে গিয়ে আর আফসোস করতে হবে না। নিয়মিত দুবেলা মেডিটেশন। সারাদিনে সময় বের করে আধঘণ্টা ব্যায়াম চর্চা।
একটু হাসিমুখে কথা বলা। গীবত, কটু কথা ও গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকা। নিজের কাজগুলি আর একটু ভালবেসে দায়িত্ব নিয়ে করা। এগুলোই তো! খুব কি কঠিন হবে?
কোয়ান্টামে এসে শিখেছি, জীবন = সময় + কাজ। সময় তো ঠিকই চলে যাচ্ছে। কাজ কতটুকু করা হচ্ছে? আসলে আমাদের অবস্থা গল্পে পড়া সেই লোকটির মতো, যিনি পাহাড় থেকে বরফের চাঁই বাজারে নিয়ে এসেছিলেন বিক্রির উদ্দেশ্যে। দ্রুত গলতে থাকা বরফের চাঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘দয়া কর সেই ব্যক্তির প্রতি। যার মূলধন দ্রুত নিঃশেষ হইতেছে।‘
আমাদেরও একই অবস্থা। আমাদের সময় নামক মূলধন ক্রমাগত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। আর নষ্ট করার মতো সময় কোথায়? আজ এখন থেকেই শুরু করি। বদলাই নিজেকে, নিজের বিশ্বাসের আলোকে।