published : ১৪ জানুয়ারি ২০১৩
ভালোই আছি, বুঝলেন? আপনার এই কোয়ান্টাম কোর্স করার দরকার তো দেখি না! সদ্য পাওয়া চাকরির জোশ, বন্ধুদের নিয়ে হুটহাট ট্যুর, মাঝেসাঝে মার্কেট যাওয়া, ফোনে আর পিসিতে অষ্টপ্রহর পরিচিত-অপরিচিতদের সাথে চ্যাটিং, ‘আমার ভবিষ্যত অন্ধকার কেন’ এ নিয়ে বাবার সাথে সকাল বিকাল তর্ক, নাস্তা না করায় আর ঘর অগোছালো রাখায় মায়ের বকুনি-বিয়ে-শাদি নিয়ে সিরিয়াস না বলে বিশেষ একজনের ঝাড়ি আর এখনও বাজার করতে পারি না বলে সব্বার সামনে সেই জনেরই উপহাসের অট্টহাসি–জীবনে সবকিছুই তো আছে দেখি।
কী বললেন? এসব তো খুবই সাধারণ ‘মামুলি’ জীবন? তা ঠিক আছে; কিন্তু ‘ভালো’ থাকতে গেলে এর চেয়ে বেশি কী করা যেত? হ্যাঁ, ভালো থাকতে গিয়েই তো সব ছেড়েছি। গভীর রাতের পার্টিতেও কখনও লাল-পানির বোতল নিয়ে মত্ত হই নি। এক-আধ চুমুক তো দিয়েইছি–তা সবাই দেয়। তাছাড়া আর কোনো বদভ্যাস ছিল? চিঠি চালাচালি বা এসএমএসে মাতামাতি না হয় করেছি কয়েক তরুণীর সাথে। একটু-আধটু ঘনিষ্ঠও হয়েছি কখনও-সখনও। কিন্তু বাকিদের মতন রাত তো কাটাই নি এখনও।
হা-হা-হা-এটাকে বলছেন ‘পা-পিছলানো’? কোন যুগে আছেন আপনি? শুনুন, যাকে ঘরে তুলব বলে কথা দিয়েছি সে কিন্তু এসব কিছু ভালোমতই জানে। এও জানে আজকের যুগে আমার মতন ‘সাধুপুরুষ’ আর পাবে না। আচ্ছা এ না হয় শরীরী প্রসঙ্গ; অন্যান্য বেলায় কি আমার কোনো কমতি ছিল? কই যেসব সহপাঠী হলে-হলে গিয়ে বিরোধী দল বা লীগকে ‘পিটিয়ে তক্তা’ বানায় তারাই যখন পরদিন সকালে বোল পাল্টে “দরিদ্র কিন্তু মেধাবী” কারো অপারেশনের জন্যে চাঁদা তুলে—কই তাদের সাথে কখনও মিশেছি? কক্ষণও না! ফুটপাতে শিষ বাজিয়েছি বলেও মনে পরে না। বরং যেসব বন্ধুরা বাজিয়েছে বা অস্ত্র হাতে টহল দিয়েছে তাদেরও ঘাটাই নি কখনও। কী দরকার বলুন? যে যা করে করুক, আমার ভালো থাকা নিয়ে কথা। তাই আরেক দিকে তাকিয়ে থেকেছি।
দেখুন, মুখ খারাপ করবেন না! ‘কাপুরুষ’ মানে কী? আমার কথায় মনে হলো আমি কাপুরুষ? রাস্তায় চোখের সামনে অ্যাক্সিডেন্ট দেখেও কিছু করি না বলে একথা বললেন? হাঁ? না, বাসে কোনো জানোয়ার কোনো মেয়ের গায়ে সুযোগ বুঝে হাত দিচ্ছে দেখেও কিছু বলি নি। মাত্র ফাইভ পড়ুয়া ছেলেটা আজকাল পাড়ার মাস্তানদের সাথে মিশছে একথাও পাশের বাড়ির আংকেলকে বলি নি। বাবার উপর রাগ যখন মা কাজের ছেলেটার উপর ঝাড়ে তখনও চুপ থেকেছি। তা এতে অন্যায় কি আছে? কেই বা করে এসব? আমার কী দরকার বাসের আঘাতে রাস্তায় পড়ে থাকা লোকটাকে হাসপাতালে নেয়ার? আমার অফিসে দেরি হয়ে যাবে না? কে মেয়েদের গায়ে হাত দিচ্ছে তা তো সবাই চেয়ে চেয়ে দেখছে–আমি কেন আওয়াজ তুলে ‘হিরো’ সাজতে যাব? কে কোথায় মারপিট করছে তা আমি দেখার কে? তাছাড়া বলবটা কি? “দোস্ত, চাপাতি দিয়ে মানুষ মারবি না”? ওরা কি তা জানে না ভাবছেন?
হুম্, কবিতা নাকি এটা? আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের? “মানুষের সাফল্য সবটুকু করতে পারায় নয়, সাধ্যমতো করতে পারায়”! ভালোই বলেছেন। শুনুন, শুনুন, এত ছোট করে দেখবেন না। এতটা স্বার্থপরও আমি না। আমারও খারাপ লাগে যখন রাত এগারোটায় বাবলুকে বলি চা বানিয়ে দিতে; ভাবি আজ বারো বছরের বাবলু বাসায় কাজ না করলে হয়তো স্কুলে যেত। দুর্ঘটনায় একটা হাত হারানো মালোর-মাকে যখন দেখি অফিসের পাশের রাস্তাটা ঝাড়ু দিচ্ছে তখনও খারাপ লাগে। মসজিদের ইমাম সাহেব যখন বলেন ইসলামকে ব্যঙ্গ করে যারা ইউটিউবে ভিডিও ছাড়ে তাদের “লাশ ফেলে দেয়া হলো জিহাদ”–তখন এই ধ্বংসাত্মক প্ররোচনা শুনে খারাপ লাগে। ছুটির দিনে যখন টিভির সামনে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটাই তখনও খারাপ লাগে, হতাশ লাগে ভেবে যে জীবনে কিছুই করা হলো না।
উঁহু, অন্যদের খারাপ লাগে না, খারাপ লাগে নিজেকে—ভীষণ বিরক্ত লাগে। কিছু তো করতে ইচ্ছে হয় যাতে নিজেকে বড় মনে করতে পারি। অন্যদের জন্যে কিছু করতে ইচ্ছে হয়, নিজের মাথা ঠান্ডা রাখতে ইচ্ছে হয়। হঠাৎ হঠাৎ যখন ঘুম না আসায় অথবা মসজিদে বসে খুতবা শুনতে শুনতে মনে হয় বয়স তো পঁচিশ হলো, গর্ব করে বলার মতন কিছু কি করেছি? আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে মেধাবী যে ছেলেটা একটা স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের হয়ে বিভিন্ন কাজ করছে তাকে কি কেবল তার ভালো রেজাল্টের জন্যে হিংসা করি? নাকি ওর নিঃস্বার্থ ভালোকাজগুলো আর ওর চোখেমুখে সবসময় দেখতে পাওয়া আনন্দটাও এই হিংসার পেছনে দায়ী? মায়ের যে ফুপাতো ভাই বিলেতের মাল্টিন্যাশনালে লোভনীয় চাকরি ছেড়ে ইউ.এন-এ জয়েন করেছিলেন মানুষের জন্যে কিছু করবেন বলে-সেই বড় মামাকেও তো্ পাড়ার আর-সব কিশোরের মত একটা সময় আদর্শ মেনেছিলাম। কিন্তু কিছুই কি করতে পেরেছি?
আফসোস হয় বুঝলেন। কিন্তু জীবনে কী করতে হবে–এই শিক্ষাটা কি কেউ দিয়েছে? মা বলেছে অমুক-তমুকের সাথে মিশবি না। বাবা বলেছে সিগাারেট খাবি না। বোন বলেছে রাস্তায় বসে আড্ডা দিবি না। সবই তো করলাম তাহলে আজ আফসোস হয় কেন? সবচেয়ে বড় আফসোস হয় যখন ভাবি আমি আমার বাবার মতন হয়ে যাচ্ছি না তো! আমার ভালোমানুষ বাবার মতন যার একমাত্র চিন্তা মেয়েকে ভালো ঘরে বিয়ে দেয়া আর আমার ছেলেমেয়ের মুখ দেখে হজ্জে যাওয়া! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্স্ট ক্লাস পাওয়া আমার মেধাবী বাবাও কি ‘ভালোমানুষ’ থাকতে থাকতে বুড়ো হয়ে গেলেন?
ঠিক বলেছেন, আব্বার না হয় বয়স হয়েছে, আমার তো এখনও বাকি। শুরু করব আবার? আত্মবিশ্বাস আসবে? ঠিক বলছেন তো? ভালো কাজ করার সুযোগ পাব? তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে পারব? খোলসের ভেতর গুটিয়ে থাকা মেরুদন্ডহীন কাছিমের মতন জীবনটা পার করতে হবে না বলছেন?
আপনি ভাই খুব খারাপ লোক! কীরকম আমার ভেতরের সব কথা বের করে নিলেন! দেখি আপনাদের প্রোগ্রামগুলোতে যাব অবশ্যই। হা হা হা- আমাদের মতন তরুনদের দরকার, না? ভালো সময়েই কথা হলো তাহলে। সামনের পঁচিশ বছরে অনেক কিছু করতে পারব, না? আব্বার মতন কথা বলছেন দেখি! হ্যাঁ হ্যাঁ, শুনব নিশ্চয়ই-কী কবিতা বলবেন শুনি? মাশাল্লাহ্, শুধু এই লাইনগুলোর জন্যে আপনাকে একদিন খাওয়াব নে। মাথায় রয়ে গেল তো–সারাদিন ধরে বিড়বিড় করতে থাকব, “নক্ষত্র যে বেগে ছুটিছে আকাশে তারও চেয়ে আগে চলে আসে যদিও সময়, পঁচিশ বছর তবু কই শেষ হয়!”
আচ্ছা, গেলাম আজ। আসছি কিন্তু আপনাদের কোর্সে; দেখব আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো পাই কিনা। আর যদি না পাই, এক হাত হয়ে যাবে কিন্তু আপনার সাথে। মনে থাকে যেন! ভালো থাকবেন...