একটা বছর যোগ হলো, নাকি বিয়োগ?

গেল বছরের কোন স্মৃতিটা সবচেয়ে বেশি আনন্দ দেয়? কোন সময়টায় মনে হয় যে, নাহ্, দারুণ একটা সময় কেটেছে, বেশ একটা কাজ করেছি? এই ৩৬৫ দিনে আপনার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা কোনটি?

একটা রিক্সাওয়ালাকে থাপ্পড় দিয়েছিলেন, মনে আছে? ঐ ঘটনাটা কি? নাকি যেবার বাড়তি টাকার লোভে একজন শিক্ষকের পেনশনের ফাইল আটকে দিয়েছিলেন—সেই ঘটনাটা? অথবা যেবার স্বামীর উপর রাগ করে কাজের মেয়েটাকে আচ্ছামতো পিটিয়েছিলেন–সেই স্মৃতিটা কি আনন্দ দেয়? সুন্দরী সহপাঠিনীর সাথে ইন্টারনেট-চ্যাটিংয়ে উদ্দাম হয়েছিলেন যখন-সেই সময়গুলো? প্রমোশন পাইয়ে দেয়ার নাম করে অধস্তন তরুণী সহকর্মীকে নিয়ে যখন স্ত্রীর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন? ব্যক্তিগত মনোমালিন্যের জের ধরে যেবার বসের কাছে সহকর্মীর নামে মিথ্যে নালিশ করেছিলেন? প্রতারণা করে হাতিয়ে নেয়া মানুষের কষ্টের সঞ্চয়ের টাকা যখন অবলীলায় নিজের লক্ষ টাকা দামের স্যুটের পকেটে ভরেছিলেন? দামি ফোনসেটটা কিনে দেয় নি বলে আপনার তর্কে-কটুবাক্যে যেবার বাবার চোখে পানি এসে গিয়েছিল, সেবার? পার্টি মিস হয়ে যাবে বলে যেবার অসুস্থ সন্তানকে কাজের লোকের হাতে রেখে সারাদিন বাইরে ছিলেন, সেই ঘটনাটা কি মনে পড়ে?

নাকি মনে পড়ে সেবারকার কথা যখন রাত জেগে হাড়ভাঙা খাটুনির পর তৈরি করা ফাইলটা দেখে বস ভীষণ প্রশংসা করেছিলেন? অথবা যেবার বন্ধুদের মুখ ভ্যাংচানি আর আড্ডার প্রলোভন অস্বীকার করে পড়ালেখা করে পেয়েছিলেন শতভাগ নম্বর–সেই ঘটনাটা? নাকি মনে পড়ে যেবার গাঁটের পয়সায় রিক্সাভাড়া দিয়ে কোনো স্বল্প-পরিচিতর কাছ থেকে মাটির ব্যাংক আনতে গিয়েছিলেন এবং জেনেছিলেন দানের বরকতে তার আর অপারেশন করাতে হয় নি? তখনকার সেই ভদ্রলোকের কথা কি মনে পড়ে—যিনি আপনাকে ধন্যবাদ দিয়েছিলেন তার থ্যালাসেমিক মেয়ের জন্যে এক ব্যাগ ব্লাড ডোনেট করেছিলেন বলে? যেবার ঘন্টার পর ঘন্টা চিৎকার শুনে-বকা হজম করেও বদমেজাজী-বৃদ্ধ বাবাকে খাবার বেড়ে খাইয়েছিলেন? শত-সহস্র অভিযোগ-অনুযোগে অতিষ্ট আপনি যখন মাথায় হাত বুলিয়েছিলেন আর ঘুমন্ত ছেলে বলেছিল ‘থ্যাংক ইউ মা-’ তখন? যা আপনার আছে সে কথা ভুলে গিয়ে যা নেই তাই নিয়ে কাছের মানুষটি নিত্য হাহাকার করে চলে, তবুও তার জন্যে যখন পরম মমতায় প্রিয় পদটি রান্না করেন–সেই মুহূর্তটি কি আনন্দ দেয়? অনেক দুঃসহ অতীত ভুলে যখন কাউকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন, নিঃস্বার্থভাবে সাহায্য করেছিলেন? বহু আরাধ্য একটি ছুটির দিন যখন না ঘুমিয়ে ‘করসেবা’ করেছিলেন–সেই সময়গুলো কি আনন্দ দেয় না?

অবশ্যই দেয়! ঐ মুহূর্তগুলোই আনন্দ দেয়। ঐ মুহূর্তগুলোই মনে দাগ কেটে রাখে, যখন সেজদায় বসে হাউমাউ করে কেঁদেছিলেন আল্লাহর কাছে অথবা মনের বাড়িতে অন্তর্গুরুর সামনে বসে ডুব দিয়েছিলেন নিজের ভেতরে। যখন বুঝেছিলেন যে-না, একা তো নন, কেউতো আছে যার কাছে আপনিই পৃথিবী-সমান-বড়। নিযুত-কোটি না-পাওয়ার ভিড়ে যখন বুঝেছিলেন অন্য অনেকের অভাব আপনার চেয়েও অনেক অনেক বেশি। আজও কি ভীষণ ভালো লাগে না সেদিনের কথা ভেবে যেদিন ঘুম থেকে উঠে বলেছিলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ, আরও একটা দিন পেয়েছি’? যেদিন অনুভব করেছিলেন—স্রষ্টার চেয়ে আপন আর কেউ নেই; তার কাছ থেকেই এসেছি, তার কাছেই যেতে হবে? অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে যেদিন বলেছিলেন- “অকৃতী অধম জেনেও তো তুমি কম করে কিছু দাও নি, যা দিয়েছো তারই অযোগ্য ভাবিয়া কেড়েও তো কিছু নাও নি”–সেদিনের কথা কি আজও খুব করে মনে পড়ে না?

কি, মনে পড়ছে স্মৃতিগুলো? ভালো স্মৃতি, খারাপ স্মৃতি? উচিত কাজ, অনুচিত কাজ? মনে হচ্ছে-‘ইশ্! ভুল করে ফেলেছি’? খারাপ লাগছে, ‘অনেকটা সময় নষ্ট করে ফেলেছি’–বলে? ভেতরটা কি শূন্য লাগছে—অর্জনের খাতায় গেল বছরটা ‘যোগ’ না হয়ে ‘বিয়োগ’ হয়েছে বলে?

আসলে সময় কখনও যোগ হয় না, যোগ হয় কাজ। অথচ দেখুন, অল্প যেটুকু সময় আছে তাও হা-হুতাশ করেই কেটে যায়! শ্রদ্ধেয় আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার বলেছিলেন না- “সবাই কেবল মৃত্যু নিয়ে দুঃখ করে, কিন্তু এমন আশ্চর্য জীবন যে সে পেয়েছিল সে কথা বলে না! ”তাই কোনোরকম না চাইতেই যে জীবনটা পেয়েছেন—তা যেন কাজে লাগে সে চেষ্টা করুন। আগামী বছর এই দিনটাতে হিসেব মেলাতে বসলে যেন কেবল ‘যোগের’ ঘরই পূর্ণ হয়, ‘বিয়োগ’ যেন না থাকে। হয়তো হিসেব মিলবে, হয়তো মিলবে না। কিন্তু পিছলে পড়ব-হোঁচট খাবো-হুমড়ি খাবো জেনেও চেষ্টাতো করতে হবে। তাইতো আমরা ‘মানুষ’, তাই না?

ভালো থাকা, ব্যস্ত থাকা, খুউব করে ভালবাসা—সবার নতুন বছর যেন এ-ই নিয়ে হয়, সেজন্যে শুভ কামনা।