উপহার নাকি অনাচার!

published : ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭

বিয়ে, জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকীসহ বছরে শ’খানেক দিবসে অঘোষিত বাধ্যতামূলক হয়ে দাঁড়িয়েছে উপহার দেওয়া। মধ্যবিত্ত মানুষের প্রতি মাসে সাংসারিক খরচ সামলে উপহার দেওয়া আনন্দের বদলে বিড়ম্বনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর উপহার দেওয়ার পরেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। কার উপহারটি কেমন হলো এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার সীমা থাকে না সামাজিক অনুষ্ঠান-পরবর্তী পারিবারিক সম্মিলনে। অনেক সময় দেখা যায়, একই আইটেম অনেক হয়ে যায়। যা পরবর্তীতে অন্যের অনুষ্ঠানে দেওয়ার জন্য জমিয়ে রাখা হয়। এ ধারাবাহিকতায় পরিচিত কারো বিয়ে কিংবা জন্মদিনে আপনি যে উপহার দিয়ে এলেন অল্প সময়ের ব্যবধানে সেই উপহারটি আপনার কোনো অনুষ্ঠানেই ফেরত এসেছে অন্য একজনের হয়ে— এমনটি মাঝে মাঝেই ঘটে।

সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার বাধ্যবাধকতা এখন অনাচারের আরেক নাম হয়ে উঠেছে। তাই অনেকে ব্যক্তিগতভাবে আবার অনেকে সাংগঠনিকভাবে সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার প্রথাকে বন্ধ করতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী ফজলুস সিদ্দিক বলেন, প্রতি মাসেই কোনো না কোনো অনুষ্ঠান থাকে। উপহার দিলে তার ওপরে নাম লেখা হয় এবং অনুষ্ঠান বাড়িতে যে দিল তার নামে তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়। অনুষ্ঠান শেষে সবাই মিলে গিফট খুলতে বসে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। কার সামর্থ্য কেমন আর কে কী দিল? এ সমালোচনার হাত থেকে মুক্তি পেতে উপহার কিনতে গেলে দামের কথা মাথায় রাখতে হয়। কিন্তু প্রতি মাসে বাসা ভাড়া, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা এবং অন্যান্য খরচ সামলে দামি উপহার দিতে গিয়ে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হয়ে যায়। কষ্ট হলেও সামাজিকতা রক্ষায় উপহার দিতে হয়।

মানুষ মনের খুশিতে যদি কাউকে কিছু দেয় সেটা হয় উপহার। কিন্তু উপহার যখন দায়ে পড়ে দিতে হয় তখন সেখানে খুশির জায়গায় ভর করে বিরক্তি। দোয়া-আশীর্বাদের বদলে উপহার পরিণত হয়েছে একটি ব্যবসায়। অনেকেই হিসাব করেন খরচ কত হলো আর উপহার উঠল কত টাকার। তাই এ ধরনের মানসিকতা পরিবর্তন করতে অনেকেই দাওয়াত পত্রে ‘উপহার আনা নিষেধ’ উল্লেখ করে দেন।

সরকারি কর্মকর্তা ফরিদুর রহমান তার ছেলের বিয়ের দাওয়াত পত্রে উপহার যেন কেউ না আনে এটা নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন। এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার পরিবারে বেশ কয়েক বছর ধরেই কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিলে অতিথিদের গিফট না আনার অনুরোধ জানাই। কয়েক বছর আগে উপহার নিয়ে এক তিক্ত অভিজ্ঞতার পর আমি এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

আমরা একজনের বিয়েতে ক্রোকারিজের কিছু সামগ্রী উপহার দিয়েছিলাম। উপহারের প্যাকেটের ভিতরে একটা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে দিয়েছিলাম। বছরখানেক পরে আমাদের একটা অনুষ্ঠানের দাওয়াতে তারা উপহার নিয়ে আসে। উপহারের প্যাকেট খোলার পরে দেখি আমরা যে শুভেচ্ছা কার্ডটা দিয়েছিলাম সেটা এর ভিতরে। অর্থাৎ তারা আমাদের উপহারটা খুলেও দেখেনি। নিজেরা যেসব উপহার পেয়েছে সেগুলোই এখন সবার বাড়িতে উপহার হিসেবে অনুষ্ঠানে যাওয়ার সময় নিয়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে আমাদের অনুষ্ঠানে কাউকে গিফট নিয়ে আসতে বারণ করি।

এই অনাচারের কারণে সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়া প্রথা বন্ধ করতে সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন। তারা সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়া এবং নেওয়ার পরিবর্তন আনতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের কয়েক লাখ সদস্য তাদের পারিবারিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়ার বিষয়টি বয়কট করেছে। তাদের সদস্যদের কোনো অনুষ্ঠানে এখন উপহার প্রথার প্রচলন নেই। এটি এখন সামাজিক আন্দোলনের অংশ হয়ে উঠছে। এর মধ্য দিয়েই উপহারের নামে সামাজিক অনাচারটি বন্ধ হবে বলে মনে করেন সংগঠনটির কর্মীরা। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের পরিচালক মিসেস সুরাইয়া রহমান বলেন, সামাজিক চক্ষুলজ্জার কারণে মানুষকে উপহার দিতে হয়। মধ্যবিত্ত পরিবারে প্রতি মাসের খরচ সামলে এটা একটা বিরাট চাপে পরিণত হয়েছে। তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, উপহার দেবও না, নেবও না। মানুষ খরচ বাঁচিয়ে উপহার দেয়। অথচ এর পরেই সেই উপহার নিয়ে শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা।   কেউ এমনিতে কাউকে উপহার দিতে পারে কিন্তু সামাজিক অনুষ্ঠানে উপহার দেওয়া শুধুই লোক দেখানো সামাজিকতা।  এটা বন্ধ করা উচিত।

[লেখক জয়শ্রী ভাদুড়ি, সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন]