published : ১ সেপ্টেম্বর ২০১৫
খুব বিরক্ত লাগত। সকালে স্ত্রীর চিল্লাপাল্লায় ঘুম থেকে উঠতে। গোসল করতে, শেভ করতে। রুটি-আলুভাজি খেতে খেতে বকেয়া বিলের কথা শুনতে। বাচ্চাকে স্কুলে নামিয়ে দিতে। বসের ঝাড়ি খেতে, পাশের টেবিলের হামবড়া সাহেবের ছুটির প্ল্যান শুনতে। কোনোদিন রেস্টুরেন্টে গেলেও বিরক্ত লাগত। বাচ্চাদের ন্যাকামো অসহ্য লাগত। স্ত্রীর নারিকেল তেল বা ট্যালকম পাউডারের গন্ধে গা জ্বালা করত। প্রতিদিন সকালে একই চেহারা দেখতে অসহ্য লাগত। আমার সাথে মুখ বেঁকিয়ে কথা বলে যখন ওয়েটারের সাথে হাসত, তখন মনে হতো টেবিলের প্লেট ছুঁড়ে ভেঙে ফেলি। সব দেনা-পাওনা আমার সাথে আর আহ্লাদি ফেসবুকের বন্ধুদের সাথে। কীসের বন্ধু-কলেজফ্রেন্ড আমিও বুঝি! আমার কালি পড়া চোখ, মেদবহুল পেট, খিটখিটে মেজাজ, বাড়তি খরচ—সবকিছুর মূলে ঐ মানুষটা। যাকে দেখলে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে, গলা ফাটিয়ে বলতে মন চায়, ‘মাফ করো আমাকে! মুক্তি দাও!’
অনেক দিন আগে ওকে ভালোবেসেছিলাম। মোবাইল যুগের আগে। মাথা ভরা চুল ছিল তখন। স্ত্রীর সাজগোজ সুন্দর ছিল তখন। ওর হাতে গরম মসলা বা ডিটারজেন্টের গন্ধ ছিল না তখন। এখন ভালবাসা নেই। একসাথে থেকে অভ্যাস হয়ে গেছে—তাই সয়ে যাই। কেউ আগে মুখ ফুটে বলি না, ‘আর ভাল্লাগে না’। সে বলে না, ‘তোমার ভাইদের-ভাইয়ের বউদের আদেখলাপনা ভাল্লাগে না’। অথবা ‘বাচ্চার জন্মদিনে অনুষ্ঠান করতে ভাল্লাগে না’। কী ভাল্লাগে তাইলে? নিশ্চয়ই মেয়ের বাংলার টিচারকে। নাইলে উনার কোচিংয়েই কেবল দিয়ে আসা-নিতে যাওয়া কেন? এত নেলপালিশ-লিপস্টিক কিসের? কেন মেয়ের ক্লাসমেটের বাপ আমার স্ত্রীর ফেসবুকে থাকবে? কেন তার সাথেই মেয়ের স্কুলের পিকনিক প্ল্যান করতে হবে?
আমার আগে লাগত খুব। রাগ দেখাতাম। ভাঙচুর করতাম। পরে দেখি, এ যেন পাগলকে সাঁকো নাড়াতে মানা! যত গলা চড়াচ্ছি, তত সে আমার সামনেই এসএমএস পাঠাচ্ছে! একদিন ঘর থেকে বের হয়ে গেল। বিকেলে শ্বশুর এসে বলল, আমার দুর্ব্যবহারই নাকি তার মেয়েকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে। আমার দুর্ব্যবহার? আমার? তার মেয়ের কোনো দোষ নেই? সিঁড়ি দিয়ে নামতে গেলে অন্য ফ্ল্যাটের লোকজন হাসাহাসি করে। করবে না? ঠিকে বুয়া যখন আছে বাসায়, তখন পুরা এলাকার কাছে তো আমার সংসারের কিছু গোপন নেই। আমাদের ঝগড়া, স্ত্রীর পরকীয়া, মেয়ের মুখ-ঝামটা সবই তো চায়ের দোকানের আড্ডার বিষয়।
অবশ্য কিছু তো এখনও গোপনই আছে। আমার সাম্প্রতিক বান্ধবীর কথা কি কেউ জানে? পাগল একটা মেয়ে সে! এমনভাবে আমার খোঁজ নেয় যেন আমি তার বহুদিনের আপন কেউ! কখনো অফিস থেকে বেরিয়ে ওর সাথে সংসদ ভবন যাই। আমাকে মুখে তুলে ফুচকা খাইয়ে দেয়। এমন আদর-যত্ন করার আর কেউ কি আছে আমার? ওরও সংসারে আমার মতনই দুরবস্থা। ওর স্বামীর ঢাকার বাইরে চাকরি। ওর সন্দেহ আরেকটা সংসার আছে স্বামীর। তাই আমরা দুজন দুঃখ ভাগাভাগি করে নেই।
একদিন ওকে সাহস করে বলেছিলাম আমার সাথে আবার নতুন করে শুরু করবে কিনা? সবকিছু ছেড়ে দিয়ে? ডিভোর্স করা তো এখন পানির মতন সহজ। সে আঁতকে উঠেছিল! বলেছিল, বিয়ে ছাড়াই যখন সবকিছু করতে পারছি, তখন নতুন ঝামেলার কী দরকার? তাছাড়া দু-ঘরের ছেলেমেয়ের কথাও তো ভাবতে হবে। তা অবশ্য ঠিক। নতুন ঝামেলার কী দরকার! সবকিছু আগের মতনই চলুক। কিন্তু আগের মতন চলাতেই তো আমার যত সমস্যা।
এই স্থির হতে চাওয়া—এসব বয়সের দোষ নাকি? সাতচল্লিশ চলছে। নতুন কাউকে জানার সময় আর আছে কি? না থাকুক। মাঝে মাঝে ঐসব ভীমরতি বাদ দিলে বেশ আনন্দেই তো আছি। অনুতাপ তো নেই। আমি কি চেষ্টা করি নি? বহু কষ্ট করেছি। তারপরও কখনও শুনি নাই ‘থ্যাংক-ইউ’। যেদিন ভুল স্বীকার করতে চেয়েছি, সেদিনও ফেরত পেয়েছি চোখ রাঙানি আর গালিগালাজ। আমার কিসের ঠেকা এসব শুনবার? এখনো আমার টাকায় সংসার চলে। দিব না আর খরচ। চলো নিজে নিজে। সবাই যখন নিজের তালে আছে, আমিও আমার সুখটুকু বুঝে নেই। স্ত্রীর যেমন সুযোগ আছে আমি বাসায় আসলে দরজা বন্ধ করে টিভি চালানোর, আমারও সুযোগ আছে যে-কারো সাথে নিউমার্কেট যাওয়ার। ভালো থাকাটাই তো আসল।
কিন্তু আমার কী যেন হয় মাঝে মাঝে। আমার ক্লাস এইটের মেয়েটার ব্যাপারে জানতে ইচ্ছা হয়। মনে হয় বলি, সবকিছুর জন্য সে আমাকেই দায়ী করে কিনা! নাইলে গেল কবছরে একদিনও ভালো করে কথা বলল না কেন? শুক্রবার দুপুরে একসাথে খেতে ইচ্ছা হয়। যখন খুব মাথাব্যথা করে তখন ইচ্ছা করে কেউ মাথায় হাত রাখুক। আশ্চর্যের বিষয়, তখন কেন জানি ঘুরেফিরে স্ত্রীর কথাই মনে হয়। আমাদের প্রথম বাসা ভাড়ার কথা, মার্কেটে বাসন কিনতে যাওয়ার কথা, স্ত্রীর ভালো খিচুরি রান্নার কথা, মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করার কথা মনে হয়। কীভাবে সব পাল্টে গেল! বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায়? নাকি সাত বছর? নাকি দশ?
সেদিন একটা কথা শুনলাম, যে সম্পর্ক ভাঙা যায় না তার মাঝে দেয়াল তুলতে হয় না। খুব এলোমেলো করে দিয়েছে কথাটা। এসব কথা বলা সহজ। কিন্তু একা একা কি দেয়াল ভাঙা যায়? ভাঙলে পরেও যদি আবার সেই বিরক্তির ঘোরে পরে যাই? আবার সেই অসহ্য লাগা? সেই একই চেহারা, একই নাস্তা, একই পছন্দ/ অপছন্দ? এখন তো খুব ভালো লাগে অপেক্ষা করতে—কখন অফিস ছুটি হবে আর কখন তার সাথে দেখা হবে। যার-যার সংসারকে ফাঁকি দিয়ে দেখা করা—এই রোমাঞ্চ তো ব-হু বছর অনুভব করি নি। বাসায় ফেরার আগে ঐটুকু সময়ই তো আমার ভালো লাগে। আবার নতুন করে শুরু করতে গিয়ে যদি সেইটুকুও হারাই? তখন?