আগে দর্শনধারী, তারপরে গুণবিচারি

published : ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫

কথাটা সবক্ষেত্রে সঠিক না। দর্শনের মূল্য মুহূর্তে, কিন্তু গুনের কদর সারাজীবন। নিজের বিয়ের অনুষ্ঠানে খেতে বসেছি। গরমে পাগড়ি নেই মাথায়, এদিকে সবাই স্যুট পরা। শ্বশুরপক্ষের এক আত্মীয়া জোরে জোরে জিজ্ঞেস করছেন ‘পাত্র কেডা?’ আমার খালা-শ্বাশুড়ি উত্তর দিলেন ‘ঐযে মাঝের কালো পোলাডা’! এই শুনে আস্ত খাসি আর গলা দিয়ে নামেনি। পরে বউ শুনে তো হেসেই খুন। বললো, ‘কেউ কালো-মোটা বললে কী আসে যায়! আমি তো আর বলিনি’। আমি চেঁচিয়ে উঠলাম, ‘মোটা তো কেউ বলেনি!’ তার মানে কী! ‘আর কী কী আমাকে বিয়ের প্রথম দিন শুনতে হবে!’ তবে আসল কথা হলো বউ তো আর বলেনি, অন্যের কাছে কালা হলেই কী, আর ধলা হলেই কী!

চেহারা নিয়ে এ্‌ই কটাক্ষ আসলে ভালো না। সেটা মানুষকে নিয়েই হোক, আর গরুকে নিয়েই হোক। আমার মনে আছে আমার চাচা গরু নিয়ে হাঁটতেন আর সবাইকে বলতেন, চামড়াটা দেখেছ? আমার মাথার টাকের চেয়েও তেলতেলে! গরু এতে খুশি হত কিনা বোঝা যায়নি, কিন্তু অন্য গরুর মালিকের অখুশিটা বেজায় স্পষ্ট দেখা যেত। আর স্লিম গরু নিয়ে হাটতে গেলে সবাই জানতে চায় ‘খাসি কত দিয়ে নিলেন?’ এতে কী আত্মতৃপ্তি বুঝিনা। কিন্তু আরেকজনকে নিচু দেখিয়ে বা নিচু ভাবিয়ে কি নিজের দানটা রক্ষা হয়?

গরু জবাই করেই কাহিনী শেষ না! রাতে খেতে বসে মেহমানদের সাথে চলে রাজ্যের গীবত। অমুক সাহেবের লক্ষ টাকার গরুর চাইতে আরেকজনের গরুটা বোধহয় বেশি ভালো। অতএব উনি ‘জিতেছেন’! তাছাড়া রাতে দাম কমে যায় তাই রাতে কেনা ভালো, এক হাটে বড়লোকরা যায় তাই দাম বেশি- আরও কত কী! ঢাকায় এসে প্রথম কদিন চলে কেবল খাসি-গরুর ফিরিস্তি। অমুক ভাবির রান্নাটা বেশি স্বাদু কারণ উনার গরুটা ‘কচি’ ছিলো। এজন্যই আমার বউ বলে ছেলেরা যখন মেয়ে দেখতে আসে তখন নাকি মেয়েদের নিজেদের ‘গরু-গরু’ লাগে!

আজকাল বড়বড় অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের গ্যারেজে দশ-বিশটা গরু বাঁধা থাকে। বড় গরুটা কোন সাহেবের তা সব্বাই জেনে ফেলে। কেউ কেউ কায়দা করে নিজের গরুটা একটু দূরে গিয়ে বাঁধেন- এতে বোধ করি হীনমন্ন্যতা একটু কমে! তারপর চলে গরুর সাথে মোবাইলে ছবি তোলা এবং তা ফেসবুকে পোস্ট করার প্রতিযোগিতা। যার যত ‘লাইক’ তার গরু বোধ হয় আল্লাহর কাছে তত প্রিয়! প্রায় এক-দু মাস আগ থেকেই চলে বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা। ধার করেও বড় গরু কিনেন অনেকে। ভালো একটা দশাশই গরু না দিলে কি মান-ইজ্জত থাকে? এখনও আমাদের গ্রামে মোড়ল সাহেবের গরু দেখতে যাওয়ার জন্য ঈদের আগের দিন সময় আলাদা করা থাকে! কোরবানিকে আমরা রীতিমত প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছি বিলাসিতা এবং সামাজিক ক্ষমতা প্রকাশের প্রথা হিসেবে। এত চুলচেরা বিশ্লেষণ কেন? গরু কেনা কী নিজেদের খাওয়ার স্বাদের জন্য? আমি যদি ছোট গরু জবাই দেই তাতে লজ্জা পাওয়াটা কি ধর্ম বা ঈমানের খেলাপ নয়? কিন্তু না, আমরা কেবল বাইরেটা নিয়েই সন্তুষ্ট। এই কোরবানি কি আল্লাহ কবুল করবেন? আমি যখন দাম বলে দিচ্ছি বা অন্যেরটা জানতে চাচ্ছি তখনই তো নিঃস্বার্থ দানের শর্ত ভেঙে ফেলছি। অতএব উচিত হলো কারো দাম জানবোও না, কাউকে দাম বলবোও না।

একটা গল্প পড়েছিলাম: বহুদিন প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার পর এক মহিলা প্রেমিকের থেকে সাড়া পেলেন। আনন্দে উনি তখন দিশেহারা। আহলাদে আটখানা হয়ে উনি দিগ্বিদিক শূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছেন প্রেমিকের সাথে দেখা করতে। এর মধ্যে পথে এক লোকের চিৎকারে তার সম্বিত ফিরলো। কী বিষয়? ভুলে সামনে দিয়ে পথ অতিক্রম করেছেন, তাই নামায ছেড়ে উঠে লোকটি চেঁচামেচি করছেন মহিলা তার নামায ভেঙে দিয়েছেন বলে। তো সব শুনেটুনে মহিলা বললেন, দেখুন, সামান্য এক পুরুষের ডাকে সাড়া দিতে আমার দুনিয়ার চারপাশ খেয়াল নেই! আর আপনি মহামহিম ঈশ্বরের সামনে দাড়িয়েছেন অথচ আমার মত নগন্য এক মহিলার কারণে আপনার মনোযোগ বিঘ্নিত হচ্ছে! এ কেমন প্রেম আপনার?

তো দোয়া করি চারপাশের সবাইকে খুশি করতে গিয়ে আসলে যাকে খুশি করার কথা তাকেই যেন ভুলে না যাই। আল্লাহ আমাদের সবার কোরবানি কবুল করুন।