published : ৪ ডিসেম্বর ২০১২
শর্তটা ছিল এরকম: সকালবেলা চা-নাস্তা নিয়ে ওর সাথে হাঙ্গামা করা যাবে না আর বিনিময়ে আমি টিভি দেখতে পারব আমার পছন্দে। ভালোই চলল কিছুদিন। বলতে যদিও ভয়-ভয় লাগছে, তবু বলি আমার বেগমের রান্নার হাতটা বেশি সুবিধার না ! তাদের অঞ্চলের আবার দুইটি ব্যাপার—তাদের মেয়েরা খুব ‘সোন্দর’ আর ‘রন্ধন’ খুব ঝাল। তো আমি তো প্রথমটাতেই কাত, পরের পৃষ্ঠায় আর গেলাম কই! তাছাড়া মন্ত্র পড়ার আগে তো দিব্যি দুটো পদ রান্না হতো। আমার জন্যে এক পদ আর সেটাতেই দেড় কেজি মরিচ গুলে তাদের জন্য আরেকটা পদ। কিন্তু সেই প্রেমিক ভাগ্য আর স্বামীর বেলায় জুটলো কই !
এখন সকাল-সকাল যদি নিজের উৎসাহেও মাংস-চচ্চড়ি রান্না করে টেবিলে দেয় তবু ভাই আমার পাউরুটি-কলাই ভালো! বলি, জিহ্বাতে কি শিরা-ধমনী নেই নাকি! যে রান্নার গন্ধে পাড়া প্রতিবেশী পর্যন্ত চোখের পানি ফেলে আর খকখকিয়ে কাশে সেখানে আমার বউ তাই খায় তিনবেলা, কাঁচা মরিচের সালাদের সাথে! আমার সকল মিটিং-মিছিল-প্রতিরোধের পর অবশেষে সে আয়ত্ত করলো সুস্থ-স্বাভাবিক মানুষের কম-ঝাল রান্না, আর সাথে সাথে দুটো কথাও শুনিয়ে দিল: আমার নাকি ঘাস-পাতা খেলেই চলত! এখন আমি না হয় আমার শান্তিচুক্তির বাইরে এক পা-ও যাই না, কিন্তু তাবত দুনিয়ার শান্তিপ্রিয় অসহায়ের মতন আমার উপরও কি অন্যায়টা চাপিয়ে দেয়া হলো না? নইলে কেন আজকাল টিভির রিমোটটা তার হাতে থাকছে?
সমস্ত অশান্তির মূল ঐ ‘রাশি’। ভাই তোমার কি দরকার অত্যাচারী শাশুড়ির সাথে থাকার? এতই কষ্ট যখন কপালে তখন যাও না অন্য কারো কাছে, একজন ভালোমানুষ ‘আ’শেক’ তো আছেই! মাঝখান দিয়ে আমার বউ দেখি চোখের পানি ফেলে। আমি মাঝে একদিন আমার ভাইয়ের শেয়ারে লস্ খাওয়ার কথা শুনে কষ্ট-মষ্ট নিয়ে ঘরে ফিরলাম; তা ঘরে দেখি আমার চেয়েও আরেকজন বেশি শোকাক্রান্ত! তা কী বৃত্তান্ত? আজ নাকি ‘দুষ্টু’ আর ‘রাজা’র বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু হয় নি! আমি তো হতবাক্! মানুষ সর্বস্ব লুটিয়ে রাস্তায় নেমেছে, মিসরে দাঙ্গায় প্রানহানি ঘটছে, বোমা ফাটছে, কোরিয়ার প্রধান মারা যাচ্ছে, তেলের দাম বাড়ছে, আমেরিকায় নির্বাচন হচ্ছে—সে খেয়াল কি আছে? খালি আলফা বাংলার অগ্নিপরীক্ষাই পরীক্ষা? জীবনের বাস্তবতার যে পরীক্ষা তার প্রস্তুতির কী হবে?
আর ধৈর্যও আছে মাশাল্লাহ! সাড়ে সাতটা থেকে রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত নন-স্টপ টিভিটা ছাড়া থাকে। সাত পাকে বাঁধা, কেয়া পাতার নৌকা, জলসাঘর আরও কত কী! আমি তো আজ পর্যন্ত পার্থক্যটা বুঝলাম না! তোমার উপরই যত অত্যাচার! এটা কেমন হলো? সবেতেই যদি তুমি এত ঝামেলায় জড়াও তবে কী এমন ভালো মানুষটা হলে? এর সাথে আমার পিচ্চিটার কার্টুনছবির কোনো পার্থক্য তো দেখি না! কোনো লজিকের বালাই আছে কী!
আমার রাগের কারন কোনো টিভি অনুষ্ঠান না। বিনোদন মাত্রই অবাস্তবতা আর কল্পনার মিশেল। আমিও কি সিনেমা দেখি না? কিন্তু আমার বেলায় সিনেমা শেষ হয় দেড় ঘন্টায়, বড়জোর পরের দু/ তিনদিন তার কথা মাথায় থাকে। কিন্তু প্রত্যেকটা দিন কীভাবে কেউ কাটায় একটা নাটক নিয়ে–এ আমার ধারনার বাইরে! রাগ হয়, মাঝে মাঝে চেঁচাই। রাতের খবরের থেকে ‘বালিকাবধূ’ বেশি জরুরি হলো? তাতে আমার বধূ মন খারাপ করে, কিছু না বলে উঠে যায় কিন্তু আমার আশ্চর্য লাগে এত কিসের টান? একবার মাথা গরম করায় বেশ কিছুদিন জী-আলফা বন্ধ থাকল; পরে আমার সাময়িক সত্যবাদী বংশধরটি বলে দিল তার মা দুপুরের পুনঃপ্রচারটা দেখে। এখন কী বলি? এতো পাঁচ বছরের ছেলেটার পোকেমন না যে বলব, এসব দেখলে রাতে ঘুম হবে না, ব্রেন শার্প হবে না! যার ব্রেন যথেষ্ট শার্প তাকে কী বলে থামাব?
এও কী একরকম পালিয়ে থাকা না? দেশে কি হচ্ছে তার চিন্তা নেই, সমাজের খবর নেই, খালি সমস্ত চিন্তা-ভাবনার কেন্দ্রবিন্দু হলো একটা সিরিয়ালের নায়ক-নায়িকা। যারা বয়স্ক তাদের কিছু নাই বললাম। তারা বলবেন পালিয়ে থাকার জন্যেই তো এতগুলো বছর পার করলাম; কিন্তু যাদের জীবন মধ্যগগনে তারা কী পালিয়ে পালিয়েই বাকিটা পার করবেন? কি জানি! মাঝে মাঝে মনে হয় বৃথাই বলছি। ওসব পরকীয়ার আকর্ষণ আমার আন্তরিক কথার চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। কিন্তু তবুও বলি, এ আসক্তি তো মাদকের মতন। সিরিয়ালের নায়িকার মতন বাঁকা কাজল আর ঝোলা জামা পর্যন্ত অনুকরন ঠিক আছে, কিন্তু ঐ নায়িকার নায়কের চিন্তায় সমস্ত দিন কাটালে কি হবে? কার শাশুড়িকাকে মেরে ফেলছে –এই ভাবনার তো কোনো ফলাফল নেই। বরং এই ভাবতে গিয়ে নিজের শাশুড়ির চাউনিতেও ষড়যন্ত্রের গন্ধ আসে! তাই ভালো হয় এর থেকে বেরুলে।
বউ, লেখাটা পড়ছ বলে বলছি, জী-আলফা আর স্টার-জলসার সময়টাকে একটু একটু করে কমাও। কথা বলা আর সময় কাটানোর ইচ্ছাটা কি কেবল আমাদের বাপ-বেটার এক তরফা? তাছাড়া ঐ সময়টায় কিছু রান্না করলেও তো পার। ঝাল বলে যতই লাফাই পুরো বাটিটা সাবাড় না করে উঠেছি কখনও? তাই প্লিজ স্বামীর কথা শুনো এবং জীবনের বড় বড় দিকে মনোযোগ দাও। আফটার অল, স্বামীর প্রতি আনুগত্যের এই একমাত্র ভালো শিক্ষাটা তো তোমার সিরিয়ালের নায়িকারা দেয়, নাকি?