উপদেশ দিবেন না, প্লিজ !

published : ৩০ আগস্ট ২০১৫

বার্নার্ড শ নাকি বলেছিলেন, “যে কিছু করতে পারে সে তা করে, আর যে কিছু পারে না সে শিক্ষকতা করে”! তা কথাটা কতটুকু সত্য জানি না, তবে বোধহয় শিক্ষকতা না বলে শ উপদেশ-দানকারীদের বোঝাতে চেয়েছিলেন।

কেন না? রমযানের সময় আধুনিক ঢাকার ডিজিটাল ফ্লাই-ওভারে তিন ঘন্টা বাসে আটকে আছি। ইফতারে সবাই মুড়ি-পুড়ি ভাগ করে খাচ্ছে। এমন সময় আওয়াজ উঠল ভাজা-পোড়া খেলে শরীর ফুলে যায় কিনা- এই তর্ক। সবার কথার তীর ধাওয়া করল আমার পাশে বসা স্থূলকায় যুবকটির দিকে। ‘আপনি কি বরাবরই এমন মোটা’, ‘আপনার পরিবারের সবাই কি খাওয়াদাওয়া বেশি করে’, ‘আপনার যে ডায়াবেটিস হতে পারে তা কি জানেন’, ‘ডাক্তার দেখিয়েছেন কি’, ‘গরুর মাংস এখনও খান’—ইত্যাদি ইত্যাদি প্রশ্নে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে আমার সহযাত্রী বোধকরি দু-একটা আগের স্টপেজেই নেমে গেলেন!

বিধির কী পরিহাস! সে যাওয়ার পর নিশানা হলাম আমি, এবার প্রসঙ্গ আমার কি ‘পিলে রোগ আছে, নাকি আমি এমনিতেই এমন শুকনা’!! মিনমিন করে কয়েকবার বলতে নিয়েছিলাম ‘বাদ দিন’; কিন্তু যে লোকগুলো খাবার ভাগ করে ইফতার করালো তাদের সাথে গলা উঁচু করতে পাকস্থলি সায় দিচ্ছিল না। শেষমেষ উপায়ান্তর না পেয়ে ‘শুকনা লোকের সন্তান ধারণে কতরকম জটিলতা’—এই তর্কের সূচনালগ্নেই আমি নেমে পড়লাম। বলি, তাদের ঘরে বাপ-ভাই নেই নাকি!

উপদেশ কি কেবল গাড়ির লোকেরা দেয়? বাড়ির লোক কম কিসে! এক পিচ্চি থাকত একই পাড়ায়, ভারি চশমার ভারে কি ভালো রোলের জোরে—তার নাক বরাবরই দেখি উচা। তার মায়ের কাজই ছিল মেয়ের গুনগান পাড়ায় করে বেরানো। আমার মায়ের ‘এক আকাশের নিচে’র সাথী তিনি, একসাথে সন্ধ্যায় টিভি দেখেন। আমাকে নিরীহ গোবেচারা পেয়ে প্রতি অনুষ্ঠানের ব্রেকে চলত আমাকে নিয়ে তাদের উপদেশ।

একদিন রাস্তায় সেই গুণবতী পিচ্চির সাথে দেখা, সে বলে কিনা আম্মা নাকি ওকে দায়িত্ব দিয়েছে বুঝিয়ে শুনিয়ে পড়ালেখায় আমার মন ফেরানোর! সৈয়দ বংশের ছেলে আমি, নাইলে সেদিনই সেই পিচ্চির একটা দফারফা করে দিতাম! আরেকদিন মাস্টারনি আমাকে দেখে বলে আমি কি লেখাপড়া থেকে ভয়ে পালিয়ে বেরাই, নাকি শ্বশুরের অনেক পয়সা দেখে কিছু কামানোর টেনশন নেই! সেদিন কিন্তু কিছু একটা হয়ে যেত, আমার ভবিষ্যত শ্বশুরকে নিয়ে অপমান! কিন্তু সৈয়দ বংশের একটা নাম আছে না; অর্ধেক বয়সের মাস্টারনিদের নাইলে ঠিকই সাইজ করে দিতাম!

সাইজ খালি করতে পারতাম না দ্বিগুণ বয়সের মাস্টারদের! বাবার অসুখ, চাচার এসে প্রথম কথা—আরো আগে ডাক্তার দেখাইনি কেন, এত গাফলতি ইত্যাদি ইত্যাদি! আরে আমার আব্বাকে নিয়ে কি তার মাথাব্যাথা বেশি? যদি বুঝতাম তো আমরা আগেই নিয়ে যেতাম! যেটা হয়ে গেছে সেটা নিয়ে উপদেশ দেয়ার কি আছে। চাকরির প্রসঙ্গ আসলে পড়ালেখা করোনাই কেন, বিসিএস দিচ্ছ না কেন- হেন তেন! এই উপদেশ শুনতে শুনতে আমরা ক্লান্ত, কিন্তু দেনেওয়ালাদের চাপার কোনো বিশ্রাম নেই।

সবচেয়ে বিরক্ত লাগে স্পর্শকাতর কোনো বিষয় নিয়ে যখন উপদেশের ছলে গীবত চলে। ওমুকের মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না—অতএব এটা করো সেটা করো; ওমুকের একটা অসুখ—সে কেন এটা করে নাই, আরেক ডাক্তারকে দেখায় নাই; ওমুকের সংসারে ঝগড়া চলে বা ওমুকের সন্তান নেই—অতএব সে কেন স্বামী বশে আনতে আবজাব কিছু করে নাই। আরো কত কী! বলি, এই উপদেশ দিয়ে কী লাভ? কারো উপকার তো হচ্ছেই না, উল্টা মানুষের মনে কষ্ট দেয়ার গুনাহ। আমি নিজেও যে এর ব্যাতিক্রম তা না! কিন্তু আজকাল চেষ্টা করি না-চাইতে উপদেশ না দেবার।

যারা সাহায্য চাইতে আসে তাদের কথা আলাদা। একটা তথ্য দিতে পারলে কী একটা পথ দেখিয়ে দিলে তাতে যদি কারো উপকার হয় তো আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু যেচে-পরে কে উপদেশ শুনতে চায়?

কোরআন পড়তে পড়তে দেখলাম বেশ কয়েকবার বলা হয়েছে, “অসার কথাবার্তা” থেকে বিরত থাকার। খুব মনে ধরেছে এই কথাটা। যখনই সুযোগ পাই এই আয়াতটা সেই পিচ্চিকে শোনাই। সে তার নাকটা আরো উচু করে বলে ‘তুমি যা-তা’! আরো একটা বিষয় বলে রাখি, সেই মাস্টারনি কিন্তু এখন আমার ঘরণী! তার আর কোনো উপদেশ শুনি আর না-শুনি, একটা ঠিকই মান্য করেছিলাম। সে বলেছিল, “চলো, দুজনের বেতনে সংসার চালানো শুরু করি। এমনিতেই বয়স বেশি, তারপর পয়সাওয়ালা শ্বশুরের আশায় আশায় তোমার বয়স বাড়ছে বই কমছে না!” এরপরও কি একটা দফারফা না করে পারি? সৈয়দ বংশের ছেলে আমি!