আপনার পণ্য না পণ্যের আপনি?

published : ২ আগস্ট ২০১২

৯/১১ –র পরদিন জর্জ ডব্লিউ বুশ আতঙ্কিত, বিধ্বস্ত আমেরিকানদের উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছিলেন “Go back shopping”; অর্থাৎ মনোবলহীন, ভেঙে পড়া মানুষগুলোকে শান্ত করার জন্য “কেনাকাটা করতে যাওয়ার পরামর্শের চেয়ে ভালো পরামর্শ আর নেই! কারণ আমরা হলাম আগে ক্রেতা, পরে মানুষ। যতক্ষণ কেনাকাটা করতে পারব ততক্ষণ আমরা সবকিছু ভুলে থাকব।

আর যখন পারব না তখন গাড়ি ভাঙব, বিল্ডিং জ্বালাব, মানুষ মারব। এই যে ২০১১ তে লন্ডনে সাম্প্রতিককালের ভয়াবহতম দাঙ্গা হলো, বিক্ষোভ হলো, বিল্ডিং জ্বলল, মানুষ মরল–কেন? লন্ডনের ঐ মানুষগুলো কী হতদরিদ্র ছিল? তাদের খাওয়া-পরার সংস্থান ছিল না?

ছিল, কিন্তু সামর্থ্য ছিল না এই মুদ্রাস্ফীতির যুগে ইচ্ছেমতো পণ্যক্রয় এবং ভোগের ক্ষমতা। ৬-১০ অগাস্টে টটেনহামের ঐ দাঙ্গা কোনো ক্ষুধার্ত বা দরিদ্র মানুষের রুটি-রুজির সংগ্রাম নয়, ওটা ছিল অতৃপ্ত, ক্ষুব্ধ ক্রেতাদের রাগে ফেটে পড়া।*

আমাদের কী অবস্থা? চট্টগ্রামের এক বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া সহপাঠীর হাতে খুন হন। কারণ ‘বন্ধু’ জাহিদের উদ্দেশ্য ছিল কফিলউদ্দিনের দামি ল্যাপটপটি বাগানো।

সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটা আমরা জানি—একটা সামান্য মোবাইলের লোভ দেখিয়ে মাঝিকে হাত করেছিল কয়েক ‘বন্ধু', উদ্দেশ্য ছিল  যাতে তারা নৌকায় সহযাত্রী তরুণী দুই সহপাঠীকে নির্বিঘ্নে ভোগ করতে পারে।

আজকাল একটা ল্যাপটপ বা একটা মোবাইল সমান একটা জীবন। এদের কার-কার কেনার সামর্থ্য ছিল না? তুচ্ছ ঘটনায় আজকাল ‘বন্ধু’রা কুকুর লেলিয়ে দিচ্ছে। খুন-খারাবি আজকাল মারাত্মক কিছু তো না—স্রেফ বিনোদনের একটা উপায়মাত্র, যে এ্যাকশন-সিনেমাটা টিভিতে মাত্র দেখলাম সেটাকে বাস্তবে ‘এনজয়’ করার চেয়ে বেশি কিছু তো নয়!

মেয়েবন্ধুরাও আজকাল পণ্যের চেয়ে বেশি কি? নইলে কার ‘মালিকানায়’ সুন্দরী সহপাঠিনী থাকবে, কার হাত ধরে ঘুরবে–এ নিয়ে কেন রাস্তায় ভা্ঙচুর হবে? কেন দুই হলের ছেলেরা আগুন জ্বালাবে?

আমরা গার্মেন্টস-কারখানায় ভাঙচুরের ঘটনা পত্রিকায় পড়ি। এমন ঘটনাও ঘটে যেখানে ‘অমুককে চড় মেরেছে’ –এই গুজবে রাস্তায় বিক্ষোভ হয়।

শত সাধারণ মানুষের রক্ত-ঝরানো পয়সায় কেনা শখের গাড়িটা ভেঙে দু-টুকরো হয়। অথচ পরে আবিষ্কার হয় সেই গুজবটা নেহায়েত গুজবই ছিল, কিছু লোভী-পশুর ইন্ধনে সেই তুচ্ছ-পলকা ব্যাপারটাই দাঙ্গায় পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু গার্মেন্টস কর্মীদের মারপিটের পেছনে তো তাদের অশিক্ষা দায়ী, বস্তির কুঁড়েঘরে কোনোদিন মাথা সোজা করে না-ঢুকতে পারা থেকে জন্ম নেয়া বিবেকহীনতা আর নীচতা দায়ী; আমাদের সচ্ছল ঘরের ‘আলাল’দের কথায়-কথায় দা-বটি নিয়ে হানাহানির পেছনে দায়ীটা কী?

দায়ী কি পণ্যের প্রতি সীমাহীন আসক্তি নয়? আজকাল পণ্য ভোগে আনন্দ নেই, সারাক্ষণ কিনতে থাকায় আনন্দ। একটা শার্ট, একটা প্যান্ট, একটা কামিজ, একটা দুল হলেই চলবে কি? না, হরেক রং হতে হবে, হরেক সাইজ মিলতে হবে। পরতে না পারলেও, আলমারিতে জায়গা না থাকলেও ‘আমারও আছে’ –এই বলার সুযোগটা যেন থাকে, কিনতে পারার মোহ থেকে যেন ছিটকে না যাই! পকেটে পয়সা না থাকলে কী হবে? চুরি করব, ছিনতাই করব, দরকার হলে খুন করব—তবু দৌড়ে যেতে হবে, পিছিয়ে পড়লে চলবে কি করে?  

আজকাল কিন্তু কোনো জিনিস ব্যবহার করে আনন্দ পাওয়াটা, তৃপ্ত হওয়াটা মুখ্য ব্যাপার না। কিনতে পারছি, নিত্যনতুন পণ্য আমার পকেটে থাকছে—এই বোধটাই আসল।

আমার ছেলে বহু কষ্টসৃষ্টে আমাকে বুঝিয়ে রাজি করালো একটা ফোন কিনে দেবার জন্যে। রাজি করাতে কষ্ট হয়েছে কারণ আমাকে ২০ হাজার টাকা দিতে হবে।

দোকানে গিয়ে অবাক হলাম কারণ ফোনের দাম ৩৫ হাজার টাকা! তাহলে বাকি টাকা কোত্থেকে আসবে? সেটা ছেলে দিচ্ছে নিজের সঞ্চয় থেকে!

দোকানে দাঁড়িয়ে তাকে বহু বোঝালাম এত টাকা দিয়ে ফোন কেনার কোনো মানে হয় না! কিন্তু না, সে কিনলই।

তো এত শখ করে কেনা ফোনটা এখন কোথায়? সেটা এখন আমার পকেটে। না, জোর করে নেইনি; ১ বছরের মাথায় ছেলের কাছে আর ফোন ভালো লাগছে না। ওটা নাকি এখন “বেশি কমন” হয়ে গেছে। তাই নিজেই এসে আমাকে দিয়ে গেছে, “বাবা, তুমি ব্যবহার করো”।

আমার কষ্ট লাগে। ছেলেটা এক বছর ধরে রিক্সাভাড়া হাতখরচ বাঁচিয়ে, টিউশন করিয়ে এতগুলো টাকা দিয়ে ফোন কিনল; বছর ঘুরতেই তার আকর্ষণ শেষ?

এবং শুধু সে তো না, তার বয়সী প্রত্যেকের হাতেই এখন প্রায় অর্ধলক্ষ বা কাছাকাছি দামের সেট। এরপর আছে নিত্যনতুন মডেল বদল। শুধু ফোন তো না; ল্যাপটপ তো আছেই, এরপর আছে ট্যাব-নোট-রিডার আরও কত কী! সেক্ষেত্রেও প্রয়োজন পূরণের কোনো দরকার কি আছে? নইলে একটা ল্যাপটপ থাকতেও আলাদা একটা ই-বুক রিডার থাকতে হবে; ট্যাব কেন থাকতে হবে?

আমরা মিডিয়াকে দোষ দেই, পাশ্চাত্যকে দোষ দেই। বলি সমাজটা খারাপ, দেশটা জঘন্য। কিন্তু নিজের ভেতরের জানোয়ারটাকে লাগাম কি দিতে পারি?

রাস্তার কুকুরটা যেমন খেতে পারবে না জেনেও আস্তাকুঁড়ের সবগুলো আবর্জনাকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে একাকার করে, সবগুলোকে ঘেঁটে হল্লা পাকায় এবং তারপরও পছন্দসই হাড্ডিটা না পেয়ে হতাশ চোখে ঘুরে বেড়ায়; ভয় হয়—আমাদের অস্ত্র-হাতে ঘুরে-ফেরা ডিগ্রিধারী ছেলেমেয়েদের মধ্যেও সেই একই চোখ দেখতে পাই না তো?

বিশ্ববিদ্যালয়ে তো মারাত্মক ‘আন্দোলন’ হয় বাস-ভাড়া এক-টাকা বাড়ানো নিয়ে। সে কি রোমাঞ্চ একেকজনের! কিন্তু সেই আন্দোলনের কতটা সত্যিকারের মানবতা থেকে?

রাস্তায় খুনোখুনি করে এসে আমাদের ক্লান্ত ‘বীরেরা’ সিগ্রেট ধরালো; টাকায় আগে পাওয়া যেত দুইটা।

পুরো মাসে বাড়তি এক টাকা দিতে গিয়ে যেখানে জীবন-মরণ সমস্যা—সেখানে দুই মিনিটেই তো টাকাটা ধোঁয়ায় উড়িয়ে দিচ্ছি! তাহলে?

কাউকে দেয়ার মধ্যে কিছু আছে কী? বরং আমি ‘মিছিল করেছি, রগ কেটেছি’—এই বলাতেই তৃপ্তি। আমার টাকায় আমি সিগ্রেট কিনব, এসিড কিনব—কারণ তাতে তো আমার ভেতরের পশুটা মজা পাচ্ছে!

প্রতিদিন বাসে অফিস যাই। কখনও চোখে পড়ে ছেলেমেয়েরা বাদুরঝোলা হয়ে, কন্ডাকটরের চিৎকার হজম করে, ড্রাইভারের বংশ তুলে গালি দিয়ে—ভার্সিটি যাচ্ছে।

তাদের কি রাগ হয় পাশের গাড়িতে যাওয়া ‘সুখী-চেহারার’ পরিবারটিকে দেখে? ‘ও আরাম করে এসির বাতাসে ঘুমাচ্ছে, আর আমি ঘামের গন্ধে ভ্যাপসা গরমে কাঠফাটা রোদে ঝুলছি’ —এই বীভৎস হিংসা থেকেই কি তারা গাড়ি পোড়ায়? রিক্সা উল্টে স্কুলপড়ুয়া মেয়েকে ফেলে দেয়? আমার যেটা নেই সেটা কারো যেন না থাকে—এই বিভীষিকার নামই কি পণ্যাসক্তি?

আমি হয়তো ধনতন্ত্রে বিশ্বাসী; কারণ আমি জানি ভালো থাকতে-পরতে চাইলে পয়সা কামাতে হবে, প্রতিদিন ১৪ ঘন্টা খাটুনির পেছনে তো সেই স্বপ্নই দায়ী।

কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত লিপ্সার কাছে কি হার মেনেছি? হয়তো হ্যাঁ, না হলে এত বাড়তি খরচ কেন? কিন্তু ভেতরে তো এখনও রক্ত-লিপ্সা আসে নি, কিছু না-পাওয়ার হতাশা থেকে তো কাউকে মারতে ইচ্ছে হয় নি।

তাহলে আজকের তরুণদের ক্ষুধাটার উৎস কোথায়? সেটাকে নিবারণের উপায় জানা আছে কি? যে জন্তুর বসবাস মনের গহীনে তাকে লাগামই বা পরায় কিভাবে? কিশোর ছেলেমেয়ের বাবা-মা যারা, তাদের বোধহয় সবার মাথায়ই এই প্রশ্নটা ঘুরপাক খায়।


*ভূমিকার অংশটুকু জিগমান্ট বওম্যানের “The London Riots – on Consumerism coming Home to Roost” লেখা থেকে নেয়া (www.social-europe.eu/2011/08/the-london-riots-on-consumerism-coming-home-to-roost)। লিডস ইউনিভার্সিটির এমেরিটাস প্রফেসর বওম্যান- ইউরোপের সবচেয়ে প্রভাবশালী সোশ্যালজিস্টদের একজন।