খালি পকেটে কী সুখী হওয়া যায়?

না, যায় না! যারা বলেন-যায়, আমি জানি না তারা কেন বলেন। আমি কবি-সাহিত্যিক না; খুব উচ্চ পর্যায়ের সাধকও না। আমার কাছে টাকাটা অনেক বড়। আমি ভালো খেতে চাই, পরতে চাই, গাড়ি-বাড়ি করতে চাই, বাচ্চাকে ভালো স্কুলে দিতে চাই। কিন্তু পারি খুব কমই। কেন? আমার চাকরি খারাপ বলে? না। আমার কোম্পানিতে বেতন হয় না? না, তাও না। কারণটা বলছি—

খুব মেধাবী ছাত্র না হয়েও ভালো চাকরি পেয়েছি। চেষ্টায় ত্রুটি রাখি নি, অন্যদের চেয়ে প্রমোশনও হয়েছে আগে। তাই আমার বয়সী সবার চেয়ে অনেক-অনেক আগে পাঁচ অংকের বেতন পেয়েছি। আমার ছেলেও একটা, বউও একটা। তাই ‘সুখী পরিবার’ হতে সময় লাগে নি। ছয় মাসে একবার ঘুরতে যাওয়া, মাঝে সাঝে দাওয়াত দিয়ে আত্মীয়-বন্ধু খাওয়ানো, একটা জামা কিনতে গিয়ে দুইটা কিনে ফেলা–এর সবই ছিল জীবনে। কিন্তু এখন অবস্থাটা ক্রমশ খারাপ হচ্ছে।

বছর কয়েক আগে যখন গাড়ি কিনি সবাই ভয় পাইয়েছিল; বড়দা বলেছিল, হাতি পুষতে পারবি তো খোকন? কিন্তু নিজের সাহস ছিল, তাই ভাইকে অখুশী করে আর ব্যাংকে লোন করে সেই সময়ের সস্তা একটা গাড়ি কিনেছিলাম। ‘হাতি পোষা’র ধরণটা বুঝেছিলাম কিছুদিন পর। তেলের দাম বাড়ল হু-হু করে। সরকারের ভীষণ ‘অনুরোধে’ আর প্রশ্রয়ে দেশের আরও হাজার-মধ্যবিত্তের সাথে আমিও আমার ‘হাতি’টাকে সিএনজি করালাম। তাতে লাভ কী হলো? একটা সময় সিএনজির দাম বাড়ল। বিদ্যুত বাঁচাতে আর ট্রাফিক কমাতে স্টেশন সারাদিন বন্ধ থাকল। অস্বাভাবিক বেতন চাওয়ায় অনেক খুঁজে হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম; লাগবে না ড্রাইভার, আমি নিজেই চালাব। কিন্তু এখন কি অফিস করব, নাকি ৬ ঘন্টা সিএনজি স্টেশনে গাড়ি নিয়ে লাইনে দাঁড়াব? এমনও সময় গেছে যেদিন ভোর ৪ টার সময় স্টেশনে গিয়েছি গ্যাস নেয়ার জন্য।

গাড়ি না হয় বাসায় রেখে দিলাম, বাস হোক-রিক্সা হোক আমি চলতে পারব। আমার ছেলেরও দরকার নেই গাড়িতে চড়ে স্কুল যাওয়া-আসার, কষ্ট পেয়ে শিখুক। কিন্তু বাসা ভাড়া? আগে বাড়ত ২০০ টাকা করে। বড় রাস্তা থেকে ভেতরে হওয়ায় বাড়িওয়ালারও চাহিদা ছিল কম। কিন্তু এরপর কী হলো- ২০০৮’র ডিসেম্বরে, তারিখটাও মনে আছে- ২৭, নোটিস আসলো নতুন ভাড়া ২৫০০ টাকা বেশি! সাথে এও লেখা ছিল, “গ্রহণ না করলে বাসা ছেড়ে দিতে পারেন”। তারিখটা মনে আছে কেন জানেন? কারণ সেদিন সকালে আমার একটা ইনক্রিমেন্ট হয়েছিল; বেতন বেড়েছিল ৫০০০ টাকা। অনেক কিছু করব ভেবেছিলাম সেই বাড়তি টাকা দিয়ে। কিন্তু রাতে এই নোটিস পেয়ে বুঝলাম- বাড়তি টাকার অর্ধেকটাই চলে যাবে প্রতি মাসে বাসা ভাড়ার পেছনে।

তাহলে প্রতিবাদ করলাম না কেন? গলা উঁচু করলাম না কেন? কেন কাপুরুষের মতন মাথা হেঁট করে ঐ জালেমদের সাথেই হাসিমুখে নিত্য গল্পগুজব করছি? কারণ, সব জায়গায় একই অবস্থা। সহকর্মীদের তো দেখছিই- ৮০০ স্কয়ারফিটের বাসায় থাকছে ১৫,০০০ টাকা ভাড়া দিয়ে! ভাড়া নিয়ে কোনো কথাও বলতে পারছে না; কারণ অফিস-বাচ্চার স্কুল থেকে বাসাটা কাছে, অন্তত যাতায়াত খরচটা তো কমে। অস্বস্তি কি মাত্র এক জায়গায়?

বাজার পরিস্থিতি তো সীমা ছাড়িয়েছে বহু আগেই। মাংস তো আজকাল খাওয়া হয় কালেভদ্রে, বড় মাছও হাজার টাকার নিচে নেই। আচ্ছা, মাছ/ মাংস বাদ দিলাম; ও না হয় কেবল অনুষ্ঠানে খেলেও চলে। কিন্তু ডিম? এক ডজন ডিম ১০০ টাকা! এও কী সম্ভব? আমরা কী আমাদের ছেলেমেয়েদের প্লেটে একটা করে ডিমও দিতে পারব না?

গুঁড়াদুধ নাকি ‘বিলাসী পণ্য’! তাই এর উপর বাড়তি ভ্যাট দিতে সরকার বাধ্য! যাক্, তাও মানলাম। আমাদের বাচ্চারা ছানা-পড়া মিল্কভিটাই খাবে দিনের পর দিন- ফ্রিজে রেখে রেখে। আর আমরা না হয় নিরামিষই খাবো। কিন্ত তাও কিনতে পারছি কই? এক কেজি পটল ৮০ টাকায় কিনলাম সেদিন। লেবুর হালি ৪০–

এ বিক্রি হচ্ছে। আর চালের দাম? কমতে কী দেখেছি আজ পর্যন্ত একবারও? কেবল সবজি আর চাল কিনে খেতেও যদি জানে টান পরে তবে আমরা যাব কোথায়?

একটা মাত্র হিসেব দেই—এই গত জানুয়ারি থেকে এই জানুয়ারি পর্যন্ত সংসারে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ এবং এগুলো হলো সেরকম খরচ যা বাদ দেয়া যায় না। ছেলের জামা বা খেলনায় আমি লাগাম টানতে পারি, কিন্তু তার স্কুল-টিউশন-বইখাতা? বাসাভাড়া-গ্যাস-বিদ্যুত বিল কীভাবে কমাব?

মাছ-মাংস না হয় খেলাম না, লেবু/ টমাটো বাদ দিলাম; কিন্তু সয়াবিন তেল? এগুলো তো না হলেই না। অথচ এখানটাতেই আটকে গেছি।

ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা এখন প্রবল। চাকরিতে বেতন কি বাড়ে নি? বেড়েছে। ভালোই বেড়েছে। একটা ল্যাপটপ পেয়েছি গেল মাসের আগের মাসে। পূজা আর ছুটিছাটায় বোনাস পাই আগের চেয়ে দ্বিগুণ। কিন্তু এগুলো সবই এসেছে অমানুষিক চাপ আর ব্যস্ততার বিনিময়ে। আমি তো ব্যক্তির হিসেব দিলাম, কোম্পানির খরচও কি আরও বেশি হারে বাড়ে নি? খরচ কমাতে গেল বছরও আমাদের অফিসে গড়ে প্রতি মাসে দু/ তিনজন কর্মী ছাঁটাই হয়েছে। একসাথে জয়েন করা আমার ১০ বছরের কলিগ আজ নেই। তার কাজটা এখন আমিই করি, সেজন্যই এত বেতন-বোনাসের ছড়াছড়ি। তবে হ্যা, কাজ করলেও দুজনের বেতন কিন্তু পাচ্ছি না। এখনও কোনো দাবিদাওয়া থাকলে বহু চিন্তাভাবনা করে বসকে আবদার করতে হয়। কারণ দেশের পরিস্থিতি ভীষণ খারাপ। আমি হয়তো চুপচাপ কাজ করি বলেই এখনও টিকে আছি। যদি কাল আমারও চাকরি চলে যায়? আরও খারাপ কোথাও গিয়ে যে পড়ব না তার গ্যারান্টি কি আছে?

জানি বলবেন, রিস্ক নিতে। আমার বন্ধুবান্ধবরাও নিয়েছিল ‘রিস্ক’। একজন ৬ মাস ধরে চাকরি পাচ্ছে না। যে ১০,০০০ টাকা বেশি পেয়েছে তার অফিস নারায়ণগঞ্জ, পরিবারের সাথে দেখা হয় মাসে একবার। একজন মাল্টিন্যাশনালে জয়েন করেছে: লক্ষ টাকা বেতন, একটা গাড়ি পাচ্ছে। কিন্তু চাকরিটা তার কন্ট্র্যাক্টের। ঠিক ৮ মাসের মাথায় কোম্পানি যদি পিরিয়ড-এক্সটেন্ড না করে বলে ‘খোদাহাফেজ’, ব্যস্ শেষ! এরপর? যদি একা হতাম, নিতাম ‘রিস্ক’- ঢুকতাম একটা মাল্টিন্যাশনালে। কিন্তু নিজের জন্য না হলেও ছেলেটার জন্য তো আট মাস পরের কথা এখনই ভাবতে হবে। সামনে ছেলেকে একটা মোবাইল দিতে হবে, একটা ভালো কম্পিউটারও। এখন তো পরিবেশ ভালো না, চাওয়ার কিছুই যদি পূরণ করতে না পারি–ছেলে কি আর বাবার কথা শুনবে? ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে না তো?

ছেলের পড়ালেখার জন্য এখন থেকেই একটা সেভিংস একাউন্ট মেইন্টেইন করছি। সেটার টাকা মাসে মাসে গুনতে হচ্ছে। একটা ফ্ল্যাটের জন্য টাকা জমানো শুরু করেছি আজ দশ বছর। কোম্পানির দেয়া ৩০% ফান্ডের পরও পুরোটা কি জোগাড় করতে পেরেছি? ডাউনপেমেন্টের জন্য গাড়িটা বিক্রি করতে হয়েছে। তবু তো ফ্ল্যাটটা হাতে পাওয়ার আগ পর্যন্ত সবসময় আতঙ্কে আছি কারণ বাড়তি আর কোনো খরচই সামাল দিতে পারব না। স্ত্রীর সাথে যে একটামাত্র জয়েন্ট একাউন্ট তারও যদি বড়সড় একটা পরিমাণ হতো তো আলাদা কথা; তা আর হলো কই? সময়ে-অসময়ে সেটাতেই তো হাত পড়ে।   

তাহলে ভালো থাকব কীভাবে? মূল্যস্ফীতির এই যুগে যেখানে সর্বত্র ত্রাহি মধুসূদন দশা সেখানে সামনে এগোনোর স্বপ্ন দেখব কীভাবে? বসের ঝাড়ি, দোকানদারের ভ্রুকূটি, পাওনাদারের ভৎসনা, বাড়িওয়ালার ধমকের পর স্ত্রীর দুটো কথা বা ছেলের একটা আবদারও যখন অসহ্য মনে হয়, সবকিছু ছেড়েছুড়ে পালাতে ইচ্ছে করে, তখন স্বস্তি-নিরাপত্তা পাব কোথায়?–এই প্রশ্ন অন্য সব্বার মতন আমারও আছে।

কিন্তু অন্যদের তুলনায় তিক্ততা আমার জীবনে কম। সারাদিনের ক্লান্তির পর খাবার টেবিলে চিৎকার-চেঁচামেচি না করার ধৈর্য আমি পেয়েছি হয়তো মেডিটেশন করি বলেই। “সবকিছু ছেড়েছুড়ে পালানোর ইচ্ছে” করলেও এখনও মুখে হাসি থাকে হয়তো প্রতি সকালে ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়ে দিন শুরু করি বলেই। হাজারো অভাবের মধ্যেও দান করি, পরিচিত-অপরিচিতদের মাটির ব্যাংক দেই। এই দানের বরকতেই হয়তো আমার পরিবারে রোগবালাই কম, জিনিসপত্র ভাঙচুর বা বিকল হওয়ার ঘটনাও কম। ছেলেটা যখন বাইরে থাকে, স্ত্রী যখন চাকরিতে বেরোয় তখন মনে একটা শান্তি পাই, ভরসা পাই–তা হয়তো এই দানের বরকতেই।

বাইরের কোনো কিছুই যখন নিরাপত্তা দিতে পারছে না তখন স্রষ্টায় বিশ্বাস করি বলেই তো আজও তৃপ্তি নিয়ে ঘুমাতে পারি। এতশত অভাব-অভিযোগ-ব্যর্থতার পরও, খালি পকেটেও সুখী হওয়ার স্বপ্ন যে দেখতে পারি তা তো সকল বিপদের যিনি ত্রাণকর্তা, সকল সমস্যার ভরসাস্থল তাঁর কাছে আশ্রয় পেয়েছি বলেই। তাই আমি যে ভীষণ সুখী তা বলব না, কিন্তু গর্বভরে বলতে পারি অন্য অনেকের চেয়েও আমি ভালো আছি।