আজকে অন্তত একটা নতুন ভুল করুন!

আমাদের এক বন্ধুর এ নিয়ে তৃতীয়বারের মত সম্পর্ক ভেঙে গেল। প্রতিবার একই কারণে, “যেমনটা ভেবেছিল এ তেমন নয়” - সেজন্য! প্রথমবার আমরা তাকে বলেছিলাম, “দ্যাখ, ইন্টারনেটে সবাই বাড়িয়ে-টারিয়ে লেখে, বাস্তবে তেমন হয় না। অতএব এত আশা করিস না। তাছাড়া নিজের কথাটাই কি ঠিক করে লিখেছিস? বেঞ্চের উপর দাঁড়ালেও তো ৬ ফুট হবি না, অথচ ফেসবুকে তাই দিয়ে রেখেছিস!” কিন্তু কে শোনে কার কথা! সেই ‘মনের মানুষ’ খুঁজতে গিয়ে বারবার সে ধরা খেল! প্রথমবার তো কান্নাকাটি করে বেচারার অবস্থা খারাপ। কত হাজার শপথ নিল; তারপরও ঠিকই একমাস পর আবার প্রেমে পড়ল। এবার অবস্থা হলো আরও খারাপ: যে মেয়ে ফেসবুকে বলে ‘রাস্তার বাচ্চাদের’ দেখে চোখে পানি আসে সেই মেয়ে কিনা আমাদের বন্ধুকে রীতিমতো জানে মেরে ফেলার হুমকী দিল! আগেরবার তো শুধু সে কেঁদেছিল, দ্বিতীয়বারে এ ‘করুণ বাস্তবতা’ দেখে আমরা সবাই কাঁদলাম। কাজেই দুই মাস পর যখন দেখলাম আমাদের রোমিওর ভাবগতিক ভালো না, সবাই তাকে একেবারে একঘরে করে দিলাম। টানা তিনমাস যোগাযোগ বন্ধ থাকার পর সেদিন শুনলাম সে হাসপাতালে। এবার কী হলো? বাড়াবাড়ি রকমের ‘উৎসাহী’ বলে নাকি এ মেয়েটিও তাকে ছেড়ে গেছে! অবশ্য সে আত্মহত্যা করতে যায় নি, হাসপাতালে আছে ডেঙ্গুর জন্য। এবং যদিও অবাক হবার মতো কিছু না, তারপরও বলি, সে খুব দ্রুত সুস্থ হচ্ছে। কারণ হাসপাতালের বেডে শুয়ে সে তার ‘জীবনের ধ্রুবতারা’ খুঁজে পেয়েছে! ফোনে বলল, মেয়েটির ফেসবুকে নামও নাকি ‘তারা’। কী আর করব? ফোনটা রেখে বন্ধুর নম্বরটা মুছে দিলাম।

ঘটনাটা খুব সত্যি এবং খুব বাস্তব। বাস্তব, কারণ এই অভ্যাসটা আমাদের সব্বার আছে। একই বিশ্বাসঘাতকের উপর আমরা বার বার ভরসা করি। ব্যবসা করতে পারি না, তারপরও বাবার পেনশনের টাকা-ধারের টাকা শেয়ারে খাটাই। মাস ঘুরতে না ঘুরতে লস খাই। তবুও দেউলিয়া হয়ে পথে বসার আগ পর্যন্ত আমরা শেয়ার ছেড়ে উঠি না। একটু একটু করে মারা যাচ্ছি জেনেও প্রতি রাতে মদের গ্লাসটা ঠিকই হাতে থাকে। পদে পদে সবাই সতর্ক করার পরও পাড়ার বখাটে ছেলেটার মিষ্টি কথা কেন জানি বার বার শুনতে ইচ্ছে করে। প্রতিবার বহুত মানত করি—মিলাদ দেই, তারপরও যেই পরীক্ষাটা শেষ হয় সেই আমরা আবার পড়া জমাতে আরম্ভ করি। ঘুম থেকে উঠতে পারি না বলে প্রতিদিনই নামাজ বাদ পড়ে যায়। কিন্তু কোনোবারই কি আমরা ভুল থেকে কিছু শিখি?    

মহাভারতে আছে, যখন দৈব জানতে চাইল ‘মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য কী’? ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির তখন ঠিক উত্তরটি দিয়েছিলেন; যে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য হলো মানুষ কখনও শিখতে চায় না। একই ভুল বার বার করে। এজন্য সাধারণ মানুষ সারাজীবন একটা গন্ডিতেই বন্দী থেকে যায়। আর সফল মানুষরা যে ভুল করেন না তা না। কিন্তু তারা ভুল থেকে শেখেন। যিনি বুদ্ধিমান তিনি জানেন যে সীমালঙ্ঘনের পরিণতি খারাপ হয়, তাই তিনি দ্বিতীয়বার সতর্ক থাকেন। আর যে আহাম্মক, সে ভাবে এবার যেন অলৌকিকভাবে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই মরীচিকার আশায় সে বার বার বেলতলা যায়। এবং শুধু যায় যে তা না, খুব গর্বের সাথে সে স্বীকারও করে যে, ‘আমি ওমনই!’ এটা হয় মূলত দুই কারণে—প্রথমত, আমরা সবসময় মনে করি যে নিজেরা ভুলের উর্ধ্বে, আমরা কোনো দোষ করতে পারি না; আর  দ্বিতীয়ত, যখন আমাদের ভুলের মাশুল গুনতে হয় তখন অবচেতনে স্বীকার করলেও সচেতনে আমরা বার বার ভুলটাকে ঢাকতে চেষ্টা করি এবং ঐ একটা ভুলকে ধামাচাপা দিতে গিয়ে আরও বহু গন্ডগোল পাকিয়ে ফেলি। ফলে ‘আমি এরকমই’ -এই বৃ্ত্ত থেকে আমরা আর বেরুতে পারি না, একই দুর্দশায় বার বার আমরা নিপতিত হই।

কাজেই একটু চিন্তা করুন। নিজের সাথে নিজে কথা বলুন। যেখানে যেখানে ভুল বোঝাবুঝি বা সমস্যা হচ্ছে সেগুলোর কারণ খোঁজার চেষ্টা করুন। পরিস্থিতির দোহাই না দিয়ে নিজের ভুলটাকে চিহ্নিত করুন। এবং দেখে অবাক হবেন যে, যে স্বভাবটার জন্য বাসায় সমস্যা হচ্ছে, সেটাই আপনার অফিসেও ঝামেলা করছে।

আসলে ভুল করাটা কখনও দোষের না। কিন্তু ভুলের পুনরাবৃত্তি দোষের। যতক্ষণ না নিজের ভেতর থেকে অভ্যাসটাকে বদলাতে পারবেন ততক্ষণ আপনার দুর্দশা কেউ ঘোচাতে পারবে না, একই ভুলের বৃত্তে আপনি বারবার ঘুরপাক খাবেন। তাই একটা অনুরোধ—আজকের দিনে অন্তত নতুন একটা ভুল করুন!