নতুন সহস্রাব্দের জীবনযাপনের বিজ্ঞান কোয়ান্টাম

সুস্থ, সুন্দর ও সার্থক জীবনের জন্যে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ জীবনদৃষ্টি। সমকালীন মানুষের মূল সমস্যা এখানেই। সকল চিন্তা একদেশদর্শিতার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। একজন একাউন্টেন্ট মনে করেন হিসাববিজ্ঞান দিয়েই তিনি সকল সমস্যার সমাধান করবেন, প্রকৌশলী মনে করেন তার প্রযুক্তি-জ্ঞানই জীবনের সমস্যার সমাধান করবে। চিকিৎসক মনে করেন ওষুধ খেলে বা অপারেশন করলেই শরীরের সমস্যা দূর হয়ে যাবে। আমলা মনে করেন সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি তারই হাতে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বিশেষ কোনো বিষয়ে ডক্টরেট করে মনে করেন পৃথিবীর সকল জ্ঞান তার আয়ত্তে চলে এসেছে। একজন আলেম, পুরোহিত মনে করেন ধর্মাচারই সব সমস্যার সমাধান করবে। একজন তরুণ বা তরুণী মনে করে বহুজাতিক কোম্পানির একটা চাকরি পেলে জীবনের সকল সমস্যা দূর হয়ে যাবে। কিন্তু সার্থক ও পরিতৃপ্ত জীবন আর এই ভাবনাগুলোর মধ্যে ব্যবধান এক সমুদ্রের। সাধারণ মানুষ এই ব্যবধান অতিক্রম করতে না পারার কারণেই রোগ, শোক ও হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অথচ সবকিছু মিলিয়েই হচ্ছে জীবন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সুস্থ জীবনের এক চমৎকার সংজ্ঞা দিয়ে বলেছে, ‘শারীরিক রোগব্যাধি বা অক্ষমতার অনুপস্থিতিই সুস্বাস্থ্য নয়। সুস্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও আত্মিক সুখ ও প্রাণ-প্রাচুর্য।’ অর্থাৎ শুধু পুষ্টিকর খাবার আর ওষুধই একজন মানুষকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী করতে পারে না। অথবা সারাক্ষণ মুভি দেখলে বা টিভির সামনে বসে থাকলেই মানসিক সুখ অর্জিত হয় না। আবার পরিবারের বা চারপাশের মানুষ অশান্তিতে থাকলেও মানুষ সুখী হতে পারে না। তেমনি বৈষয়িক সাফল্য এলো কিন্তু আত্মিক শূন্যতা যদি থাকে তাহলেও জীবন পরিতৃপ্ত হয় না। অর্থাৎ জীবনের কোনো প্রয়োজনকে বাদ দিয়ে নয়, জীবনের সবগুলো প্রয়োজন সুন্দরভাবে পূরণ করতে পারলেই একজন মানুষ সুখী হতে পারে।

কোয়ান্টাম এ কথাই বলে যে, জীবনকে দেখতে হবে পরিপূর্ণরূপে। সঠিক জীবনদৃষ্টি ও জীবনযাপনের বিজ্ঞানকে আয়ত্ত করেই একজন মানুষ সুখী জীবনের পথে অগ্রসর হতে পারে। অমর কথাশিল্পী লিও টলস্টয় যা খুব সুন্দরভাবে বলেছেন- `Most important of all the sciences one can and must have to learn is the science of living, so as to do the least evil and the greatest possible good.'

কোয়ান্টাম হচ্ছে সেই Science of Living যা বলে দেয় জীবনটাকে কীভাবে সুন্দর করা যায়, ভুল থেকে কীভাবে দূরে থাকা যায়, পাপ কত কম করা যায়, আর ভালো বা কল্যাণ কত বেশি করা যায়। তাই আমরা কোয়ান্টামকে বলি জীবনযাপনের বিজ্ঞান, জীবন আচরণের বিজ্ঞান। এ আলোয় আমরা আলোকিত হচ্ছি, আলোকিত করছি সাধারণ মানুষকে। পরিবর্তিত করছি নিজেদের ও অন্যদের জীবনকে।

সুস্থ জীবনের জন্যে প্রথম প্রয়োজন প্রশান্তি। যা নির্ভর করে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। সঠিক জীবনদৃষ্টির অভাব বা অবিদ্যাই মানুষের সকল দুঃখের কারণ। কোয়ান্টাম এ অবিদ্যার অন্ধকার থেকে একজন মানুষকে মুক্ত করে। প্রতিক্রিয়াশীল দৃষ্টিভঙ্গি দূর করে তাকে সঠিক কর্মমুখী বা প্রো-একটিভ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। সে হয়ে ওঠে শোকরগোজার। প্রতিটি সমস্যাকে গ্রহণ করে চ্যালেঞ্জ হিসেবে। আত্মবিশ্বাস ও প্রজ্ঞার যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে সমস্যাকে রূপান্তরিত করে  নতুন সম্ভাবনায়। দৃষ্টিভঙ্গি বদলে সে তার জীবনকেই বদলে দেয়।

দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো শরীর। স্বাস্থ্য যদি ঠিক না থাকে তাহলে অর্থ, বিত্ত, সবকিছুই অর্থহীন। হেনরি ফোর্ড আমেরিকার তার সময়ের সবচেয়ে বড় ধনকুবের ছিলেন। একজন সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, গত ৬ মাসে আপনার জীবনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা কী? তিনি বলেছিলেন, ‘কয়েকদিন আগে আমি একটি ডিমের এক-চতুর্থাংশ খেয়ে তা হজম করতে পেরেছিলাম। এটাই আমার গত ৬ মাসের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা।’ ব্যবসার কোটি কোটি টাকা মুনাফার চেয়ে একটি ডিম খেয়ে হজম করতে পারাই তার ৬ মাসের স্মৃতিতে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এ থেকেই সুস্থতার গুরুত্ব আমরা সহজেই বুঝতে পারি। শরীরের ব্যাপারে কোয়ান্টাম যে পূর্ণাঙ্গ ধারণা দিয়েছে তা আমাদের ঐতিহ্যের নির্যাসে প্রণীত ও আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানের আলোকে পরীক্ষিত।

তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রাচুর্য। প্রাচুর্য মানে অভাবমুক্তির অনুভূতি; যুক্তিসঙ্গত প্রতিটি চাওয়াকে সহজ স্বতঃস্ফূর্ত পাওয়ায় পরিণত করার সামর্থ্য। প্রাচুর্যের কোয়ান্টাম পঞ্চসূত্র অনুসরণ করে হাজার হাজার গ্রাজুয়েট এখন এগিয়ে যাচ্ছেন স্বতঃস্ফূর্ত প্রাচুর্যের পথে।

চতুর্থ হচ্ছে পরিবার। পরিবার আমাদের সুখের মূল আকর। পরিবারভিত্তিক জীবনযাপনের মানসিকতা ইউরোপ আমেরিকাতে নেই বলেই সেখানে এত অনাচার, এত অশান্তি। যারাই পরিবারকে তুচ্ছ ভেবেছেন, পরিবারের বাইরে আনন্দ খুঁজতে গিয়েছেন, তারা পরিণামে প্রতারিত হয়েছেন, ভুল করেছেন, অশান্তিতে ভুগেছেন। কোয়ান্টাম চেতনার সাফল্য হচ্ছে পরিবারকে সুখী পরিবারে রূপান্তরিত করা। অন্য কোনো চেতনাই আমাদের দেশে এভাবে পারিবারিক রূপ পায় নি।

পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো আত্মিক। মানুষ জন্মগতভাবেই উপাসনা করতে চায়, প্রার্থনা করতে চায়। চায় উচ্চতর কারো কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে। এক অসীম ও পরম সত্তায় বিশ্বাস স্থাপনের আকুতি মানুষ তার জেনেটিক ব্লুপ্রিন্টেই বহন করছে। তাইতো সবকিছু পাওয়ার পরও কোথায় যেন একটা অপূর্ণতা থেকে যায়। এ অপূর্ণতা এবং অতৃপ্তির কারণেই ৭০ বছর পর সোভিয়েত ইউনিয়নে কমিউনিজমের বিনাশ ঘটেছে।

১৯৬৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে মহা ধুমধামে বিপ্লবের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছিল। যা নিয়ে টাইম ম্যাগাজিন একটি কভার স্টোরি করল- 50 Years of Soviet Union।  তাতে বলা হয়, সোভিয়েত ইউনিয়নে সবচেয়ে শ্রদ্ধার জায়গা হলো লেনিনের মাজার। সবসময় লোকজন সেখানে যায়। এক বৃদ্ধা এসেছেন তার মেয়ে এবং মেয়ের জামাইকে নিয়ে। এক সাংবাদিক তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেছিলেন যে, লেনিনের আশীর্বাদ নিতে এসেছি। তার আশীর্বাদ পাওয়া গেলে আমার মেয়ে আর জামাতার জীবনটা সুখের হবে, সুন্দর হবে। ৪৮ বছর বয়স্ক এ মহিলার জন্ম হয়েছে বিপ্লব পরবর্তী এমন এক সোভিয়েত ইউনিয়নে যেখানে নাস্তিক্যবাদ ছিল রাষ্ট্রীয় ধর্ম। তারপরও তার মাথা থেকে সমর্পণের চিন্তা দূর করা যায় নি।  যখন আর কাউকেই পান নি তখন লেনিনকেই দেবতা ভেবে তার মাজারে নিয়ে এসেছেন মেয়ে আর জামাতাকে। এটাই মানবীয় প্রকৃতি। আত্মিক শূন্যতা সে কোনো না কোনোভাবে পূরণ করবে।

কোয়ান্টামে এই আত্মিক শূন্যতা পূরণের চমৎকার ব্যবস্থা রয়েছে। কোয়ান্টাম প্রত্যেকের ধর্মবিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করে। প্রত্যেককে উৎসাহিত করে আন্তরিকভাবে নিজ নিজ ধর্ম পালনে। কারণ সত্যিকারের ধর্ম পালনের মাধ্যমেই একজন মানুষ নিজেকে অনন্য মানুষে রূপান্তরিত করতে পারে। আর ধ্যানের মাঝেই সে নিজেকে পুরোপুরি সমর্পিত করতে পারে পরম সত্তার কাছে। লাভ করতে পারে সীমাহীন আত্মিক প্রশান্তি।

তাই নিঃসংশয়ে বলা যায়, কোয়ান্টাম মানবিক চেতনা শাশ্বত ধর্মীয় বীজ থেকে অঙ্কুরিত, আধুনিক বৈজ্ঞানিক নির্যাসে লালিত। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে কোয়ান্টামের দিক-নির্দেশনা ধর্মসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত ও যুক্তিসম্মত। সুখী ও প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর সুস্থ মানুষের সবটুকু প্রয়োজন পূরণের প্রক্রিয়াই রয়েছে কোয়ান্টামে। তাই কোয়ান্টামই হচ্ছে নতুন সহস্রাব্দে আধুনিক মানুষের জীবনযাপনের বিজ্ঞান, যা দিয়ে সে তার মেধাকে বিকশিত করবে, জীবনের অঙ্ক মেলাবে, জীবনকে ভরিয়ে তুলবে প্রশান্তি ও প্রাচুর্যে।