প্রাচ্যের পদ্ধতিই বেশি কার্যকর-পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের সমীক্ষা

published : ২৮ জুলাই ২০১৫

সভ্যতার উৎসভূমি এশিয়া। ধর্ম দর্শন বিজ্ঞান প্রযুক্তি–সবকিছুরই শেকড় এশিয়ার মাটিতে গভীরভাবে প্রোথিত। ইসলাম বৌদ্ধ হিন্দু ও খ্রিষ্টান–পৃথিবীর এই মহান ধর্মগুলোর উৎসভূমি এই এশিয়া। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিসে এরিস্টটল ও প্লেটো যখন তাদের গণতন্ত্রের মতবাদে অভিজাত ও দাস শ্রেণীর মধ্যে বিভাজনের কথা বলেছেন, তখন এই বাংলায় মহামতি বুদ্ধ প্রচার করেছেন সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্বের বাণী। তিনি বলেছেন, জন্মসূত্রে কেউ ব্রাহ্মণ হয় না বা অচ্ছু্ত হয় না, কর্ম দ্বারাই সে ব্রাহ্মণ বা অচ্ছুতে রূপান্তরিত হয়।

গ্রিসে আইন বা গণতন্ত্র চর্চার ইতিহাস মাত্র আড়াই হাজার বছর। অথচ এই প্রাচ্যে আজ থেকে সাত হাজার বছর আগে হাম্মুরাবির শাসনামলে আইন ও বিধিমালা প্রণীত হয়েছিল। ইউরোপের অধিকাংশ ভাষারই জন্ম হয়েছে ফোরাত নদীর তীরে বিকশিত ব্যবিলনীয় সভ্যতায় প্রচলিত আরামাইক ভাষা থেকে। ইউরোপের বড় বড় শহরগুলোতে পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা মাত্র দেড়শ বছরের। আর মহেনজোদারো-হরপ্পার পয়ঃপ্রণালি ব্যবস্থা চার হাজার বছরের পুরনো। ঢাকার মসলিনের সমকক্ষ সুতার কাপড় এখনও পাশ্চাত্যের কোনো প্রযুক্তি তৈরি করতে পারে নি। বাংলায় আবিষ্কৃত দাবা খেলার চেয়ে বুদ্ধিদীপ্ত কোনো খেলা এখনও পাশ্চাত্যে আবিষ্কৃত হয় নি। সকল বিজ্ঞানের ভিত্তি অঙ্ক। আর অঙ্কের ভিত্তি হচ্ছে শূন্য। এই শূন্য আবিষ্কৃত হয় বাংলায়। বাংলা থেকে শূন্য আরবে এবং সেখান থেকে ইউরোপে যায়। বিজ্ঞানের রাজ্যে ঘটে বিপ্লব। তাই বলা যায়, পাশ্চাত্যের সকল জ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎসভূমি এশিয়া।

এশিয়া বিশ্বকে যত জ্ঞান ও প্রযুক্তি উপহার দিয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার মেডিটেশন। ব্রেন ও মনকে ধ্যানের স্তরে নিয়ে গিয়ে যে অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যায় প্রাচ্যের সাধকরা হাজার হাজার বছরের সাধনার মাধ্যমে তা মানুষকে দেখিয়ে গেছেন। সাধকদের দেখানো এই পথ থেকেই উদ্ভাবিত হয়েছে বিভিন্ন ধ্যান প্রক্রিয়া। দ্রাবিড় সভ্যতা আমাদেরকে দিয়েছে যোগধ্যান। মহামতি বুদ্ধ শিখিয়ে গেছেন বিপাসন ধ্যান পদ্ধতি। এই ধ্যান চীনে চেন নামে এবং জাপানে জেন নামে প্রচলিত হলো, যা আসলে বাংলা ধ্যান শব্দেরই ভাষাগত রূপান্তর। আউলিয়া-দরবেশগণ দিয়েছেন সুফি-মোরাকাবা। অর্থাৎ প্রাচ্যে প্রোথিত হয়েছে মেডিটেশনের এক দীর্ঘ, সমৃদ্ধ এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তি। ধ্যানের এই মৌল উৎসগুলো থেকেই বিকশিত হয়েছে পাশ্চাত্যের ও প্রাচ্যের বর্তমান সকল মেডিটেশন ও মন নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি।

বিশ শতক মেডিটেশন চর্চার ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী শতক। শতকের প্রথমভাগেই জেন মেডিটেশন ও সুফি মেডিটেশন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ডি টি সুজুকি, লবসাং রাম্পা, হজরত এনায়েত খান প্রমুখ সাধক এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে এসে যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে এক বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন। তিব্বতীয় সাধক দালাই লামার নেতৃত্বে বিপাসন ধ্যান অর্থাৎ জেন, মহাঋষি মহেশ যোগীর টিএম এবং হজরত জালালুদ্দীন রুমির বিশ্বজনীন প্রেমের মেডিটেশন জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করে। ৬০-এর দশকে প্রাচ্যের এই পদ্ধতিগুলো জনপ্রিয়তা পেতে শুরু করার কয়েক বছরের মধ্যে পাশ্চাত্যের উদ্যোক্তারাও আত্ম-উন্নয়ন ও প্রশান্তির জন্যে ধ্যান পদ্ধতি চালু করেন। ১৯৬৪ সালে সাইকো কেবারনেটিক্স, ১৯৬৬ সালে সিলভা মেথড, ১৯৬৮ সালে ইএসটিসহ প্রায় অর্ধশত পদ্ধতি চালু হয়। তবে ৬০ ও ৭০-এর দশকে মেডিটেশন-এর কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ী লোকের অভাব ছিল না। ফলে গবেষণা হয়েছে প্রচুর। গবেষণার প্রতিটি ফল ছিল মেডিটেশনের পক্ষে।

প্রাচ্যের ধ্যান পদ্ধতির প্রতি এই সার্বজনীন আগ্রহের কারণ হচ্ছে এর কার্যকারিতা। ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নিউসায়েন্টিস্ট পত্রিকার ১৯৯০ সালের ২৮ এপ্রিল সংখ্যায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টে বলা হয়, বয়স্কদের ক্ষেত্রে জীবনের মান ও আয়ু বাড়াতে প্রাচ্য পদ্ধতির মেডিটেশনই বেশি কার্যকরী। যুক্তরাষ্ট্রের দুদল বিজ্ঞানী ৭৩টি রিটায়ারমেন্ট হোমের বাসিন্দাদের ওপর এক গবেষণা চালান যাদের বয়স ছিল গড়ে ৮১ বছর। দৈব নির্বাচনের মাধ্যমে বাসিন্দাদের মোট চারটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। তিনটি গ্রুপকে শেখানো হয় তিনটি পৃথক পৃথক শিথিলায়ন বা মেডিটেশন পদ্ধতি। যার একটি ছিল টিএম বা প্রাচ্য মেডিটেশন পদ্ধতি। ৪র্থ গ্রুপকে কোনো মেডিটেশন পদ্ধতি শেখানো হলো না।

তিন মাস পর গবেষকরা এই চার গ্রুপের লোকদের অবস্থা জরিপ করলেন। দেখা গেল, যে গ্রুপটি টিএম চর্চা করছিলেন তাদের উন্নতিই সবচেয়ে বেশি। তাদের সিস্টোলিক ব্লাড প্রেশার ১৪০ থেকে নেমে এসেছে ১২৮-এ। যার মানে তাদের হৃদরোগের ঝুঁকি এখন কম। মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায়ও দেখা গেল অন্যান্য গ্রুপের লোকদের তুলনায় তাদের চিন্তাশক্তি ও স্মৃতিশক্ত–দুটোই বেড়েছে।

তিন বছর পর আবারও জরিপ চালিয়ে দেখা গেল বাকি প্রতিটি গ্রুপ থেকে কেউ না কেউ মারা গেলেও টিএম গ্রুপের সবাই বেঁচে আছেন। আরও উল্লেখ্য যে, রিটায়ারমেন্ট হোমের যে ৪৭৮ জনকে এ গবেষণার আওতায় আনা হয় নি তাদের মৃত্যুর হার ছিলো ৬২.৫%। অর্থাৎ এ গবেষণার ফলাফল আয়ু বাড়াতে মেডিটেশনের কার্যকারিতাকে তুলে ধরার পাশাপাশি প্রমাণ করেছে প্রাচ্য পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্বকে। গবেষকদলের নেতা প্রফেসর চার্লস আলেকজান্ডার মন্তব্য করেছেন, ‘সব মেডিটেশন পদ্ধতিই সমানভাবে কার্যকর- প্রচলিত এ ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেছে এ গবেষণার ফলাফল।’ এ চ্যালেঞ্জই আরও জোরদার হয়েছে স্টানফোর্ড ইউনিভার্সিটির কেনেথ ইপলির আরেকটি গবেষণা থেকে। কেনেথ ইপলি উদ্বেগ উৎকণ্ঠার ওপর ১০০টিরও বেশি মেডিটেশন পদ্ধতির প্রভাব পরীক্ষা করেন। তিনি দেখেন, উৎকণ্ঠা নিবারণে টিএম কাজ করে অন্যান্য পদ্ধতির চেয়েও দ্বিগুণ কার্যকরীভাবে।

পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীদের শতাধিক সমীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ধ্যানের ক্ষেত্রে প্রাচ্যের মেডিটেশন পদ্ধতিই শ্রেষ্ঠ। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়, স্টানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৬০টি বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত গবেষণায় একই ফল পাওয়া গেছে যে, পাশ্চাত্যের পদ্ধতিগুলোর চেয়ে প্রাচ্যের পদ্ধতি কমপক্ষে দ্বিগুণ কার্যকরী। অবশ্য এর কারণ হতে পারে যে, পাশ্চাত্য মন-নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে এক ধরনের সুপ্ত যান্ত্রিকতা রয়েছে যা মনের পরিপূর্ণ তন্ময়তায় নিমগ্ন হওয়ার পথে অন্তরায় হিসেবে কাজ করে। পক্ষান্তরে প্রাচ্যের পদ্ধতিগুলো এ ধরনের যান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত হওয়ায় মনকে সহজেই মগ্ন চৈতন্যে নিয়ে যায়।

আমেরিকান জার্নাল অফ ক্লিনিকেল হিপনোসিসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ডের ড. আকিরা ওতানি প্রাচ্যের মেডিটেশন পদ্ধতির ব্রেনওয়েভ এবং নিউরোফিজিওলজিক্যাল প্রভাবের ওপর পরিচালিত গবেষণা রিপোর্টগুলোর মেটা এনালাইসিস করে বলেছেন, নিরাময়ের ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য পদ্ধতির চেয়ে প্রাচ্যধারার মেডিটেশন পদ্ধতি বেশি কার্যকর।   

আর মেডিটেশনের সকল প্রাচ্য ধারার সফল উত্তরসূরি কোয়ান্টাম মেথড। যোগ, বিপাসন ও মোরাকাবার নির্যাসে সমৃদ্ধ কোয়ান্টাম মেথড সকল ধর্মের সকল মানুষের উপযোগী একমাত্র পরীক্ষিত পূর্ণাঙ্গ মেডিটেশন পদ্ধতি। এক যুগের নীরব গবেষণায় সীমিত প্রয়োগেই এর সাফল্য সীমাবদ্ধ নয়; বরং এর কার্যকারিতার প্রথম প্রমাণ হিসেবে বলা যায় ১৯৯৩ সালের ১ জানুয়ারি পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে ৪ শতাধিক শ্রোতা আধঘণ্টার শিথিলায়ন ক্যাসেট শুনে শুধু প্রশান্তিই নয়, অনেকে হলের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে নাক ডাকতে শুরু করেন।

২ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় বক্স আইটেম করে ছাপা হয় একটি রিপোর্ট ‘আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাক ডাকা প্রশান্তি। এতে বলা হয়, পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনে গতকাল (শুক্রবার) বিকেলে ভার্সিটির ছাত্র, শিক্ষক, সরকারি অফিসার ও উৎসুক তরুণেরা উৎকণ্ঠা নিবারণের সভা শুনিতে গিয়া মহাজাতকের প্রশান্তকরণ ক্যাসেটের সুরময় অনুনাদে দুই দুইবার আচ্ছন্ন তন্দ্রায় নাক ডাকিতে শুরু করেন। ত্রিশ মিনিটে কয়েক ঘণ্টা ঘুমের প্রশান্তি লাভের পদ্ধতিটিকে জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম কেবল উৎকণ্ঠা নয়, ৪০ ভাগ শারীরিক জরামুক্তির সংগ্রাম হিসাবে মূল্য দিয়া বলিয়াছেন, আত্মবিশ্বাস ও প্রশান্তি মানুষকে অজস্র রোগ কষ্ট হইতে মুক্তি দিতে পারে।

কোয়ান্টাম মেথড কোর্স আকারে আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় ৭ জানুয়ারি ১৯৯৩ সালে। ৪ দিন মোট ৪০ ঘণ্টার কোর্স। তারপর টানা ৩২ বছর। একজন প্রশিক্ষকের এককভাবে ক্লাস নিয়ে ৫০০ এর অধিক কোর্স সম্পন্ন করার মতো অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটেছে এরই মধ্যে। একই সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ৫০০-এর অধিক বার।

অনুশীলনে সহজ, কার্যকারিতায় অনন্য আর শাশ্বত জীবন চেতনার সাথে সম্পৃক্ত হওয়ায় লাখো মানুষের জীবনে এসেছে মৌলিক পরিবর্তন। এ পরিবর্তন মানসিক, শারীরিক, পেশাগত, পারিবারিক ও আত্মিক। শুরুটা দেশে হলেও এ পরিবর্তন ও সাফল্যের উচ্ছ্বাস অতিক্রম করেছে সকল ভৌগলিক সীমা।