মেডিটেশন কি আয়ু বাড়ায়?

মেডিটেশনে আয়ু বাড়ে। জীবন সুন্দর হয়, আনন্দময় হয়। আমাদের সাধকরা মোরাকাবা বা ধ্যানের মাধ্যমে প্রবল মানসিক শক্তি ও প্রাণবন্ত জীবনের অধিকারী হয়েছেন। তাদের চেহারার ঔজ্জ্বল্য, ত্বকের লাবণ্য, মানসিক বিচক্ষণতা সাধারণ মানুষকে অভিভূত করত। এখনও সাধকদের বয়স বোঝা মুশকিল। আশি বছর বয়সেও তারা অনুভব করেন চল্লিশ বছরের প্রাণময়তা।

সাধকদের এই প্রাণবন্ত জীবনের ওপর আগে অলৌকিকত্ব আরোপ করা হতো। কিন্তু এখন বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, বৃদ্ধ বয়সেও যে কেউ মেডিটেশন করে দেহের অভ্যন্তরের সুপ্ত শক্তিকে জাগ্রত করতে পারেন, প্রাণবন্ত হতে পারেন। এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীদের এক চমৎকার সমীক্ষা প্রকাশিত হয়েছিল সাপ্তাহিক ‘নিউ সায়েনটিস্ট’ পত্রিকার ১৯৯০ সালের ২৮ এপ্রিল সংখ্যায়।

বিজ্ঞান বিষয়ক বস্তুনিষ্ঠ এই সাময়িকীর এই রিপোর্টে বলা হয় যে, যুক্তরাষ্ট্রের দু’দল বিজ্ঞানী দাবি করেছেন, ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন (Transcendental Meditation বা সংক্ষেপে TM) আপনার আয়ু বাড়াতে পারে এবং জীবনের মান উন্নত করতে পারে। বিজ্ঞানীরা বলেন, তারা দেখেছেন, বয়স্ক ব্যক্তিরা যদি শিথিলায়ন পদ্ধতি হিসেবে দিনে দু’বার ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন করেন, তাহলে প্রাণবন্ততা বাড়ার সাথে সাথে আয়ুও বাড়বে।

রিপোর্টে বলা হয় : আইওয়ার ফেয়ারফিল্ডের মহাঋষি বিশ্ববিদ্যালয়ের চার্লস আলেক্সান্ডার ও হাওয়ার্ড শ্যান্ডলার হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের সাথে নিয়ে ৭৩টি রিটায়ারমেন্ট হোম-এর বাসিন্দাদের ওপর গবেষণা পরিচালনা করেন। হোম-এর বাসিন্দাদের গড় বয়স ছিল ৮১ বছর। তারা বয়সের ওপর তিনটি শিথিলায়ন বা মেডিটেশন পদ্ধতির তুলনামূলক প্রভাব পর্যালোচনা করেন।

আলেক্সান্ডার ও তার সহযোগী গবেষকরা অপরিকল্পিতভাবে প্রত্যেক ব্যক্তিকে তিনটি পদ্ধতি থেকে একটি করে মেডিটেশন বা শিথিলায়ন পদ্ধতি শিক্ষা দেন। চতুর্থ গ্রুপকে কোনো শিথিলায়ন পদ্ধতি শেখানো হয় নি। অন্য তিনটি গ্রুপের সদস্যরা তাদের নিজ নিজ পদ্ধতিতে মেডিটেশন করতে থাকেন।

গবেষকরা তিন মাস পর এই চার গ্রুপের লোকদের অবস্থা জরিপ করেন। তারা দেখতে পান, ৪টি গ্রুপের মধ্যে যারা ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন করছিলেন, তাদেরই সবচেয়ে বেশি উন্নতি হয়েছে। গড়ে তাদের সিসটোলিক রক্তচাপ ১৪০ থেকে ১২৮-এ নেমে এসেছে। এটা প্রমাণিত সত্য যে, উচ্চ রক্তচাপ নেমে এলে হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমে যায়। আর হার্ট এটাক হচ্ছে মৃত্যুর একটি বড় ধরনের কারণ। মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষায় আরো দেখা গেছে যে, ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন গ্রুপের সদস্যরা অন্য গ্রুপের চেয়ে ভালোভাবে চিন্তা করতে পারছেন, তাদের স্মরণ শক্তিরও তুলনামূলক উন্নতি বেশি।

তিন বছর পর জরিপ চালিয়ে দেখা যায় যে, ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন গ্রুপের সবাই বেঁচে আছেন। অপর পক্ষে অন্য তিনটি গ্রুপের প্রতিটি গ্রুপ থেকেই বেশ কিছু সদস্য মারা গেছেন। রিটায়ারমেন্ট হোমের ৪৭৮ জন বাসিন্দার মধ্যে যাদের এই গবেষণার এই গবেষণার আওতায় আনা হয় নি, এই সময় তাদের মৃত্যুর হার ছিল শতকরা ৬২.৫ ভাগ।

গবেষক আলেক্সান্ডার বলেন, আয়ুবৃদ্ধির ক্ষেত্রে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশনের প্রভাব নিরূপণের ক্ষেত্রে এটিই ছিল প্রথম গবেষণা। ইতিপূর্বে এই মেডিটেশন পদ্ধতির উপর পরিচালিত অন্যান্য জরিপ ও গবেষণার সাথে এই ফলাফল অত্যন্ত সাযুজ্যপূর্ণ। অন্যান্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেক মনোদৈহিক প্রক্রিয়া, যেমন রক্তচাপ, দৃষ্টিশক্তি, কগনিটিভ ফাংশনিং, ডিয়াস হরমোন (DHEAS Hormone)-এর মাত্রা ইত্যাদির অবনতি ঘটতে থাকে। কিন্তু ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশনে এই প্রক্রিয়াগুলোর উল্লেখযোগ্য উন্নতি ঘটে। উল্লেখ্যযোগ্য যে, ডিয়াস হরমোন উৎপন্ন হয় এড্রিনাল গ্ল্যান্ডে। তারুণ্যে এই হরমোনের মাত্রা বেশি থাকে এবং বয়স বাড়ার সাথে সাথে এর মাত্রা কমতে থাকে।

রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, সাধারণভাবে ধারণা করা হয়, প্রতিটি মেডিটেশন ও শিথিলায়ন পদ্ধতি সমান কার্যকর। কিন্তু এই গবেষণা এই ধারণার প্রতি প্রত্যক্ষ চ্যালেঞ্জ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনেথ ইপলি পরিচালিত আরেকটি গবেষণা এই চ্যালেঞ্জকে আরও শক্তিশালী করেছে। কেনেথ উৎকণ্ঠা নিবারণে বিভিন্ন মেডিটেশন পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে ইতিপূর্বে পরিচালিত শতাধিক গবেষণা ও জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করেন। তিনি দেখতে পান যে, অন্য যে কোনো পদ্ধতির চেয়ে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন দ্বিগুণ কার্যকরভাবে উৎকণ্ঠা কমিয়ে আনে।

ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত ‘নিউ সায়েনটিস্ট’ বস্তুনিষ্ঠ গবেষণার ফলাফল প্রকাশের জন্যে বিজ্ঞানী মহলে সবচেয়ে সমাদৃত সাময়িকী। এতে প্রকাশিত এই রিপোর্ট থেকেই প্রমাণিত হয় মেডিটেশনের ব্যাপারে প্রাচ্যের পদ্ধতির শ্রেষ্ঠত্ব। উল্লেখযোগ্য যে, উপমহাদেশের বিশিষ্ট সাধক মহাঋষি মহেশযোগী ১৯৬০ সালে আমেরিকায় প্রথম ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন বা টিএম চালু করেন। চালু হওয়ার পর থেকেই হলিউডের তারকা থেকে শুরু করে পেন্টাগনের জেনারেলরাও এই টিএম-এর প্রতি ঝুঁকে পড়েন। সেই থেকে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশনই যুক্তরাষ্ট্রে এক নম্বর জনপ্রিয় মেডিটেশন পদ্ধতিতে পরিণত হয়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে অনেক মেডিটেশন পদ্ধতি চালু হয়, যেমন, ১৯৬৪ সালে সাইকোকেবারনেটিক, ১৯৬৬ সালে সিলভা মেথড ইত্যাদি। কিন্তু কার্যকারিতার দিক থেকে শতাধিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় ও গবেষণায় প্রচলিত অন্য সব মেথডের চেয়ে ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশন-এর শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কারণে সেখানে এখনো এই পদ্ধতিই শীর্ষস্থানে রয়েছে।

’৯০-এর দশকে এসে মহাঋষির ট্র্যান্সেন্ডেন্টাল মেডিটেশনের ধারণার ওপর কোয়ান্টাম ধারণা প্রভাব বিস্তার শুরু করেছে। মহাঋষির বিশিষ্ট শিষ্য ডা. দীপক চোপড়া, এমডি, আমেরিকায় এখন কোয়ান্টাম নিরাময়ের ধারণা প্রচার করছেন। কোয়ান্টাম হিলিং-এর উপরে এবং সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘ জীবনের উপরে তিনি এ পর্যন্ত চারটি গবেষণামূলক বই লিখেছেন, যা আমেরিকার চিকিৎসাজগতে এক নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত তার Ageless body, timeless mind’ বইটিকে তিনি অভিহিত করেছেন ‘বৃদ্ধ হওয়ার কোয়ান্টাম বিকল্প’ রূপে। এ বইটি ইতিমধ্যেই এক মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে এবং বেস্টসেলার তালিকায় রয়েছে।

কাজেই দেখা যাচ্ছে, মেডিটেশনের কার্যকারিতার পথে আপনার বয়স কোনো অন্তরায় নয়। ৬০, ৭০, ৮০—আপনার বয়স যা-ই হোক না কেন, আপনি মেডিটেশন শুরু করে নতুন প্রাণশক্তিতে উজ্জীবিত হতে পারেন।