published : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
কোয়ান্টাম ফিজিক্স, নিউরো সায়েন্স এবং জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ শতকে বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের বিশ্বদৃষ্টিকেই পাল্টে দিয়েছে। যে বিজ্ঞান ছিল দীর্ঘদিন বস্তুকেন্দ্রিক, নিউটনিয়ান মেকানিক্সের নিগড়ে বন্দি, সে বিজ্ঞানই এখন হয়ে পড়েছে চেতনানির্ভর।
পাশ্চাত্যের পদার্থবিজ্ঞানের সর্বাধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি এখন এসে একাত্ম হয়েছে প্রাচ্যের সাধকদের বিশ্বদৃষ্টির সাথে, মন কেন্দ্রিক বিশ্ব দর্শনের সাথে।
বিজ্ঞানী নিউটন এবং ম্যাক্সওয়েলের সূত্র অনুসরণ করে পদার্থবিজ্ঞান উনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এক সুশৃঙ্খল বিশ্বদৃষ্টি উপস্থাপন করে। এই বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় সবকিছুই এক নিয়মের অধীন, সেখানে বিজ্ঞানীর কোনো ভূমিকা নেই। বিজ্ঞানী সেখানে একজন দর্শকমাত্র। আর পুরো প্রক্রিয়া হচ্ছে দর্শক-মন নিরপেক্ষ।
এ বিশ্বদৃষ্টিতে প্রথম ফাটল ধরান বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ১৯০৫ সালে তাঁর বিখ্যাত ‘থিওরি অব রিলেটিভিটি’ উপস্থাপন করে। এই নতুন তত্ত্বের মাধ্যমে বস্তুগত বাস্তবতা প্রতিষ্ঠায় দর্শকের আগমন ঘটে। বস্তুগত প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণকারী বিজ্ঞানীও এ প্রক্রিয়ায় সক্রিয় অংশগ্রহণকারীতে পরিণত হন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের উদ্ভব ঘটার সাথে সাথে দর্শকের ভূমিকা বস্তুগত ঘটনা বা মতবাদের ক্ষেত্রে আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বস্তুগত মতবাদ কাঠামোয় বা যে কোনো বিষয় ব্যাখ্যায় দর্শকের মন অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়। বৈজ্ঞানিক চিন্তায় এই আমূল পরিবর্তন কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানীদের বিস্ময়াবিষ্ট করে তোলে এবং তাঁরা মানবমন ও দর্শন সম্পর্কে গভীরভাবে অধ্যয়নে নিমগ্ন হন। বিজ্ঞানের ইতিহাসে কোনো যুগেই নেতৃস্থানীয় বিজ্ঞানীরা এত বিপুল সংখ্যায় তাঁদের বৈজ্ঞানিক গবেষণা-ফলাফলের দার্শনিক ও মানবিক মূল্যায়ন করে নিবন্ধ বা পুস্তক রচনা করেন নি।
কোয়ান্টাম ফিজিক্সের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ওয়ার্নার হেইজেনবার্গ তাঁর 'Philosophical Problems of Quantum Physics'-এ লেখেন যে, প্রকৃতির নিয়ম সংক্রান্ত গবেষণা এখন আর শুধু মৌল কণাসমূহ নিয়ে আলোচনা করে না। এখন তা আলোচনা করে এ কণাসমূহ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান নিয়ে অর্থাৎ আমাদের মনের বিষয়বস্তু নিয়ে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মূল সমীকরণ প্রস্তুতকারী বিজ্ঞানী এরউইন শ্রুডিঞ্জার ১৯৫৮ সালে 'Mind and Matter' নামে এক অসাধারণ গ্রন্থ রচনা করেন। তিনি বিজ্ঞানের এই নতুন তত্ত্বের আলোকে বিশ্বদর্শনের সাথে নিজেকে একাত্ম করেন। কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের মধ্যে শ্রুডিঞ্জারই প্রথম প্রাচ্যের দার্শনিক চিন্তাধারার সাথে সমমর্মিতা প্রকাশ করেন। এরপর থেকে আধুনিক বিজ্ঞানীরা এ ব্যাপারে প্রচুর গ্রন্থ রচনা করেছেন। এর মধ্যে পাশ্চাত্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় দুটি গ্রন্থ হচ্ছে ফ্রিটজিয়ফ কাপরা-এর 'The Tao of Physics' এবং গ্যারি জুকাভ-এর 'The Dancing Wu Li Masters.'
ডারউইনের পর থেকে মানবীয় আচরণকে একটা জৈবিক প্রক্রিয়া হিসেবে ব্যাখ্যা করার প্রচুর চেষ্টা হয়েছে। আবার জৈবিক প্রক্রিয়াকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে শুধুমাত্র শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম হিসেবে। এদের বক্তব্যকে কার্ল সাগান 'The Dragons of Eden'-এ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন : “আমরা যাকে কখনো কখনো মন বলি তা হচ্ছে ব্রেন। আর এই ব্রেনের কার্যক্রম এর অঙ্গ ও শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রমের ফলাফল ছাড়া কিছুই নয়। এখানে মন বলে কিছু নেই।” আর মলিকুলার বায়োলজিস্ট ফ্রান্সিস ক্রিক তাঁর বই 'Of Molecules and Men'-এ লিখেছেন, “সকল প্রাণিবিদ্যাকে অবশ্যই পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিজ্ঞান দিয়েই ব্যাখ্যা করতে হবে”।
জীবন, প্রাণ, মনকে যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন, মন থেকে শুরু করে আবার মনেই ফিরে আসতে হয়। যেমন প্রথমত ধরুন, চিন্তা ও চেতনাসহ মানবমনকে কেন্দ্রীয় নার্ভাস সিস্টেমের তৎপরতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। যাকে আবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও শারীরবৃত্তীয় কার্যক্রম হিসেবে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, সকল স্তরের জৈবিক কর্মকাণ্ড পরমাণু বিজ্ঞানের আলোকে পুরোপুরি বোঝা যেতে পারে। কারণ প্রতিটি জৈবিক কার্যক্রম কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, হাইড্রোজেন ইত্যাদির পরমাণুর পারস্পরিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার আলোকে ব্যাখ্যা করা যেতে পারে। সর্বশেষে, পরমাণুবিজ্ঞানকে পুরোপুরি বুঝতে হলে কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর মাধ্যমে বুঝতে হবে। আর কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর সাথে মন হচ্ছে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দর্শকমনের ভিত্তি ছাড়া কোয়ান্টাম প্রক্রিয়াই হচ্ছে অসম্পূর্ণ।
বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিজ্ঞানী প্রফেসর সৈয়দ শফিউল্লাহ তাঁর ‘অস্তিত্বের অতলান্তে’ গ্রন্থে কোয়ান্টাম সূত্র প্রসঙ্গে সাব-এটমিক পার্টিকেলের স্পিন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে লিখেছেন, “পারমাণবিক কিংবা অব-পারমাণবিক পর্যায় অবশ্যি চক্ষুষ্মান জগতের স্পিনের সাথে তুলনা করলে বিপাকে পড়ার সম্ভাবনাই বেশি। বিশেষ করে নিজ অক্ষের চারপাশে আবর্তনের কথা উঠলেই দিক-নির্দেশনার কথা ওঠে। মনে আসে একটা রেফারেন্স অক্ষের। ইলেক্ট্রন স্পিনের দিক-নির্ণয়ের জন্যে বিদ্যুৎ কিংবা চুম্বকীয় ফিল্ডকে রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এই, রেফারেন্স ফিল্ডকে যে দিকেই বসাই না কেন, ইলেক্ট্রন স্পিন ঠিক ঠিক রেফারেন্স ফিল্ডের সাথে এ্যালাইন্ড হবে অর্থাৎ পাশাপাশি অবস্থান করবে। ব্যাপারটা খানিকটা এমন যে, ইলেক্ট্রন যেন আগে থেকেই বুঝতে পারছে নিরীক্ষণকারী কিভাবে তার নিয়ম তৈরি করতে যাচ্ছেন। আরেকভাবে বলা যায়, নিরীক্ষণকারীর মনই ঠিক করছে নিরীক্ষণের ফলাফল কী হবে। এক্ষেত্রে জড়বস্তুর ওপর মানব মনের কর্তৃত্বের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। এ তো গেল স্পিন সম্পর্কে বিশ্বজনীন অনিশ্চয়তার একটা গুরুত্বপূর্ণ গভীর দিক।
আরেক দিকে দেখা যায়, সাব-পারমাণবিক জগতে স্পিন একটি ধ্রুব বাস্তবতা। এই স্পিনের কারণেই পরমাণুদের মৌলগত ভিত্তিতে এত সমাহার, রাসায়নিক বন্ধনের অন্যতম উৎসের উদ্বোধন এবং তার থেকে জীবনের উৎসব।”
মনের বস্তুকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা সম্পর্কে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী নিউরোসায়েন্টিস্ট স্যার জন একলস-এর বক্তব্যও এক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। নিউরো সায়েন্স বিকশিত হয়েছে গত ৩০ বছরে। গবেষণার মূল প্রতিপাদ্য মানব মস্তিষ্ক বা ব্রেন। ব্রেন-এর কার্যক্রম সম্পর্কে বিজ্ঞান অনেক কিছুই জেনেছে। তারপরও ব্রেন সম্পর্কিত জ্ঞান এখনো রয়েছে একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে। বিজ্ঞানী একলস প্যারাসাইকোলজিস্টদের সম্মেলনে ‘মন বস্তুকে প্রভাবিত করতে পারে কি না’ এ প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমরা যখন চিন্তা করি, তখন প্রতিটি চিন্তার সাথে সাথে ব্রেন নিউরনে অবস্থিত কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেনের পরমাণু স্থান পরিবর্তন করে। কার্বন, হাইড্রোজেন ইত্যাদির পরমাণু হচ্ছে বস্তু আর চিন্তা হচ্ছে বস্তু অস্তিত্ববিবর্জিত।”
বিশ্বদৃষ্টি পরিবর্তনে বিজ্ঞানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হচ্ছে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং। এ বিজ্ঞানের মূল কথা হচ্ছে, জীবকোষের মূল কেন্দ্র ডিএনএ-আরএনএ এবং সেখানে সংরক্ষিত তথ্যভাণ্ডার সকল প্রাণকে নিয়ন্ত্রণ করে। আর এ তথ্যভাণ্ডারে পরিবর্তন এনে প্রাণের বিকাশকে প্রভাবিত করা যায়। এ বাস্তবতা বস্তুর ওপর চেতনা ও তথ্যের কর্তৃত্বকেই নতুন সত্যরূপে প্রতিষ্ঠিত করে।
মন ও চেতনার ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গির সার-সংক্ষেপ নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী ইউজিন উইগনার তাঁর 'Remarks on the Mind-Body Question' নিবন্ধে চমৎকারভাবে বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, অধিকাংশ পদার্থ বিজ্ঞানীই এ সত্যকে মেনে নিয়েছেন যে, চিন্তা অর্থাৎ মনই হচ্ছে মূল। ‘চেতনার উল্লেখ ছাড়া কোয়ান্টাম মেকানিক্স-এর নিয়মকে পুরোপুরি সঙ্গতিপূর্ণভাবে গঠন করা সম্ভব নয়।’ ("It is not possible to formulate the laws of Quantum Mechanics in a fully consistent way without reference to the consciousness.")
নিবন্ধের উপসংহারে বিজ্ঞানী উইগনার বলেছেন, ‘বিশ্বের বৈজ্ঞানিক গবেষণা শেষ পর্যন্ত চেতনাকে চূড়ান্ত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে’ ('Scientific study of the world led to the content of consciousness as an ultimate reality.') আর এভাবেই আধুনিক বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ এসে একাত্ম হয়েছে প্রাচ্যের প্রাচীন সাধকদের মনকেন্দ্রিক বিশ্ব দর্শনের সাথে। আর আধুনিক মানুষ নতুনভাবে ব্রতী হয়েছে চেতনার শক্তিকে, মনের অসীম ক্ষমতাকে মানবতার কল্যাণে ব্যবহারের।
কোয়ান্টাম মেথড মনের এই অসীম শক্তিকে ব্যবহারের সবচেয়ে সহজ ও পরীক্ষিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।