published : ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১১
পাশ্চাত্য বিশ্বের এক নম্বর ঘাতক ব্যাধি হৃদরোগ। হৃদরোগের মূল কারণ স্ট্রেস বা মানসিক চাপ এবং অসম খাবার ও অতিভোজন। হার্ট অ্যাটাকের সূচনা হয় হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী করোনারি ধমনীর দেয়ালে হলুদ চর্বির স্তর জমে-জমে এক সময় রক্ত চলাচল কমে এলে, এতে হার্টের জন্যে প্রয়োজনীয় রক্তের সরবরাহ কমে যায়। ঘটে অ্যানজাইনা অ্যাটাক। পঙ্গুত্ব বা মৃত্যু যেন তখন খুব কাছাকাছি ঘোরাঘুরি করতে থাকে। প্রচলিত চিকিৎসাবিজ্ঞানে ধমনীর এই চর্বি পরিষ্কার করার জন্যে শক্তিশালী ওষুধ, অ্যানজিওপ্লাস্টি এবং বাইপাস সার্জারি করা হয়। ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা বাদ দিলেও একশ্রেণীর ডাক্তারের বিশ্বাস হচ্ছে, ধমনীতে চর্বির স্তর একবার জমা শুরু হলে আর নিস্তার নেই। যত কিছুই করা হোক না কেন, চর্বি জমবেই। তাই বাইপাস সার্জারিই উত্তম। কিন্ত বাইপাস সার্জারিতে খরচ অনেক এবং তা-ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ামুক্ত নয়। সার্জারির পর একজন মানুষের জীবনীশক্তি কার্যত অর্ধেকে এসে দাঁড়ায়।
হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসাপদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু এতদিন পর্যন্ত রোগীদের এছাড়া কোনো বিকল্প উপায় ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ওষুধ ও অস্ত্রোপচার ছাড়াই কম অর্থব্যয়ে হৃদরোগীরা পুরোপুরি নিরাময় লাভ করছেন। হৃদরোগ নিরাময়ে এ সফল পদ্ধতির প্রবর্তক হচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়ার বিজ্ঞানী ডা. ডিন অরনিশ।
১৯৮৭ সালে প্রবর্তনের পর থেকে তার এই পদ্ধতি এত সফল হয়েছে যে, সর্বমহলেই এটি এখন গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। ফলে এটি এখন আর বিকল্প পদ্ধতি হিসেবে নেই, এটি এখন অন্তর্ভুক্ত হয়েছে হৃদরোগ চিকিৎসার মূল ধারায়। মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, নিরামিষ খাবার এবং গ্রুপ আলোচনা হচ্ছে এই পদ্ধতির ভিত্তি।
ক্যালিফোর্নিয়ার প্রিভেন্টিভ মেডিসিন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা ডা. ডিন অরনিশ-এর এই পদ্ধতি যে কতখানি সফল হয়েছে, তার প্রমাণ হচ্ছে, ওনিউজউইকহ সাময়িকীর ১৯৯৫ সালের ২৪ জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত ওগোয়িং মেইনসিট্রমহ রিপোর্টটি। রিপোর্টে বলা হয় :
জীবনধারণ পদ্ধতি পরিবর্তনের মাধ্যমে হৃদরোগকে শুধু প্রতিরোধ করা যায় না, নিরাময়ও করা যায়। ডা. অরনিশের এই পরিসংখ্যান ভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হওয়ার পর ওমাহার মিউচ্যুয়াল ইনস্যুরেন্স কোম্পানি ২ বছর আগে স্বাস্থ্য বীমার পলিসিধারী কয়েক শত হৃদরোগীকে অরনিশের কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। এদের মধ্যে ২ শত রোগী ১৫ হাজার ডলারের অ্যানজিওপ্লাস্টি বা ৪০ হাজার ডলারের বাইপাস সার্জারির জন্যে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরিবর্তে ৫ হাজার ডলারের এই জীবনধারা পরিবর্তন পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করেন। সারাবছরের এই কর্মসূচিতে রয়েছে মেডিটেশন, ব্যায়াম, নিরামিষ খাবার ও গ্রুপ আলোচনা।
নিরীক্ষার শুরুতে সমালোচকরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন যে, রোগীরা জীবনযাত্রা পরিবর্তনমূলক এই কর্মসূচি কয়েকদিন পরেই পরিত্যাগ করবে এবং অরনিশের ফি-র ওপর আবার হাসপাতালের বিলও কোম্পানির ঘাড়ে চাপবে। কিন্তু দেখা গেল যে, ৯৫ ভাগ রোগীই অরনিশের কর্মসূচিতে নিজেদের সম্পৃক্ত করে ফেলেছেন। ২০০ রোগীর মধ্যে ১৯০ জন এক বছরের এই কর্মসূচি অনুসরণ করেন। এর মধ্যে ১৮৯ জন সুস্থ হয়ে যান। মাত্র ১ জনের অপারেশন করার প্রয়োজন হয়। মিউচ্যুয়াল বীমা কোম্পানি হিসেব করে দেখেছেন যে, ইতিমধ্যেই তারা প্রতি ডলারে সাড়ে ৬ ডলার বাঁচিয়েছে। আর যেহেতু হৃদরোগীদের অপারেশন-পরবর্তী বছরগুলোয় বার বার অপারেশন প্রয়োজন হয়, তাই কোম্পানি মনে করে যে, অরনিশের কর্মসূচি তাদের ডলার প্রতি ২০ ডলার বাঁচাতে সাহায্য করবে। এই সাফল্য দেখে আরো ১৫টি বীমা কোম্পানি অরনিশের কার্যসূচি গ্রহণ করার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে বিশেষজ্ঞদের পাঠানো হচ্ছে ক্যালিফোর্নিয়ার সাওসালিটোতে। তারা এখন জানতে চাইছে এই কর্মসূচি কিভাবে রোগীর ওপর প্রয়োগ করতে হবে। নেবেরেস্কার ৫০ বছর বয়স্ক পুলিস ফ্রাঙ্ক সেবরন অরনিশের কর্মসূচিতে যোগদান করে। এর আগে তার অ্যানজিওপ্লাস্টি করা হয়েছে এবং তাকে প্রতি মাসে ২১৪ ডলার ব্যয় করে ২টি ওষুধ খেতে হতো। কিন্তু সে এত দুর্বল ছিল যে, কাঠও কাটতে পারত না। আজ তার ধমনী প্রায় পরিষ্কার। তার কোলেস্টেরলের মাত্রা একেবারে কম। সে এখন দূরপাল্লার বাইসাইকেল চালায়। হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা যারা সেবরনের বাঁচার আশাই ত্যাগ করেছিলেন, এখন তাকে বলেন, 'আমরা একত্রেই বুড়ো হবো।'
ডা. অরনিশের এই কার্যসূচি এখন সার্বজনীনভাবে গৃহীত হয়েছে। তাই একে আর এখন বিকল্প চিকিৎসা বলা হয় না। এটি এখন চিকিৎসার মূল ধারার সাথে সংযুক্ত হয়েছে। ওষুধ ছাড়াই হৃদরোগ চিকিৎসায় ডা. অরনিশের সাফল্যের কথা বিশ্ববাসী প্রথম জানতে পারে ১৯৮৮ সালে। কিন্তু ডা. অরনিশ এ ব্যাপারে গবেষণা ও তথ্যানুসন্ধান চালিয়ে আসছিলেন বহু বছর ধরে। ১৯৮৬ সালে ৪১ জন হৃদরোগীকে ২ ভাগে ভাগ করে গবেষণা শুরু হয়। এই ৪১ জনের মধ্যে কেউই করোনারি বাইপাস সার্জারি করাতে রাজি হচ্ছিলেন না। হলুদ চর্বির স্তর জমে এদের ধমনী প্রায় বন্ধ হয়ে আসছিল। কেউ কেউ ইতিমধ্যেই হার্ট এটাকের শিকার হয়েছেন। এদের ২ দলে ভাগ করা হলো। প্রথম দলে ২২ জন, আর কন্ট্রোল গ্রুপে ১৯ জন।
ডা. অরনিশের মেডিটেশন ও জীবন অভ্যাস কর্মসূচি গ্রহণ করলেন ২২ জন। প্রথমে এরা মিলিত হলেন সপ্তাহব্যাপী দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন কর্মসূচিতে। এরপর সপ্তাহে ২ বার ৪ ঘণ্টা করে গ্রুপ আলোচনা। ডা. অরনিশ এদের মেডিটেশন ও কিছু যোগাসনের কলাকৌশল শেখালেন। এর সাথে প্রতিদিন আধ ঘণ্টা করে হাঁটা। এক ঘণ্টা করে মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম। আর নিরামিষ খাবার। এরা কোন ওষুধ ব্যবহার করবেন না।
আর দ্বিতীয় দল, অর্থাৎ কন্ট্রোল গ্রুপের ১৯ জনকে আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্দেশিত পথ্যবিধি অনুসরণ করতে বলা হলো। প্রয়োজনে কোলেস্টেরল কমাবার ওষুধ এরা ব্যবহার করতে পারবেন। আর হার্ট এসোসিয়েশনের হৃদরোগ মোকাবিলায় করণীয় কার্যক্রম অনুসরণ করবেন।
দুইগ্রুপের লোকজনকেই বিশেষ তত্ত্বাবধানে রাখা হলো। পথ্যবিধি মানছেন কিনা, ব্যায়াম ঠিকভাবে করছেন কিনা, মেডিটেশন নিয়মিত হচ্ছে কিনা, গ্রুপ আলোচনা চলছে কিনা, তা নিয়মিত মনিটর করা হলো।
রোগের অবস্থা পুনরায় আগাগোড়া নিরীক্ষণ করা হলো এক বছর পর। পাওয়া গেল অদ্ভুত ফল। ডা. অরনিশের কার্যসূচি যারা অনুসরণ করছিলেন তাদের ধমনীতে জমে থাকা হলুদ চর্বি বা কোলেস্টেরল পরিষ্কার হয়ে রক্ত চলাচল বেড়ে যাওয়ায় তারা ভীতিকর বুকব্যথা থেকে মুক্তি পান এবং তাদের হার্ট এটাকের আশঙ্কা কমে আসে। অপরদিকে কন্ট্রোল গ্রুপের ১৯ জন যে অবস্থায় ছিলেন, সে অবস্থায়ই থেকে গেলেন। তাদের অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না।
হৃদরোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ডা. অরনিশের সাফল্য চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক যুগান্তকারী ঘটনা। এর আগে রক্ষণশীল ডাক্তাররা বিশ্বাস করতেন যে, আর্টারি একবার ব্লক হতে শুরু করলে এর গতি আর পাল্টানো যায় না। কিন্তু ডা. অরনিশ প্রমাণ করলেন, ওষুধ ছাড়াই জীবনধারায় নিয়মশৃঙ্খলা অনুশীলন ও অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমেই তা করা যায়।
হৃদরোগ নিরাময়ে ডা. অরনিশের ফর্মুলা খুব সহজ। এর ব্যয়ও কম। বাইপাস সার্জারিতে যেখানে ১৫ লাখ টাকা প্রয়োজন সেখানে অরনিশ থেরাপিতে খরচ হয় মাত্র ২ লাখ টাকা। আর বাংলাদেশে অরনিশ থেরাপির প্রক্রিয়ায় আপনি চলতে চাইলে বড়জোর খরচ হবে ২০ হাজার টাকা মাত্র।
ডা. অরনিশের হৃদরোগ থেরাপি ৪টি ভাগে বিভক্ত।
প্রথম, মেডিটেশন। মেডিটেশন অর্থ, আমাদের প্রাচ্যের যে কোন ধ্যানপদ্ধতি বা মোরাকাবা পদ্ধতি অনুসরণ করে দেহ মনকে শিথিলায়ন করা। মেডিটেশন মনকে যেমন প্রশান্ত করে, তেমনি জীবনের প্রতি ইতিবাচক বা প্রো-অ্যাকটিভ দৃষ্টিভঙ্গি গঠন করে। জীবন থেকে অহেতুক উত্তেজনা ও মানসিক চাপ বা টেনশনকে দূর করে দেয়।
দ্বিতীয়ত, ব্যায়াম। ডা. অরনিশ সবসময় মাঝারি ব্যায়াম, হাঁটা ও যোগব্যায়ামের পক্ষে। প্রথমে দৈনিক ২০-৩০ মিনিট হাঁটা। আস্থে আস্তে সহ্য করিয়ে নিয়ে হাঁটা। এবং এর সাথে কিছু বিশেষ যোগাসন। হালকা প্রাণায়াম বা বিশেষ পদ্ধতিতে দম নেয়া ও দম ছাড়া।
তৃতীয়ত, খাদ্যাভ্যাস। ডা. অরনিশের মতে, হৃদরোগীর জন্যে খাবার ও পথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চর্বি কমানোর জন্যে অরনিশ মোট ক্যালোরির ১০ শতাংশ চর্বি খেতে দিলেন। মাছ-গোশত বা আমিষ চর্বির পরিবর্তে বাদাম ও নিরামিষ চর্বি খেতে দেয়া হলো। রোগীর খাবার হলো ভাত, রুটি, সবুজ শাক, শিম, মটরশুঁটি, বিন, সব্জি, তাজা বা শুকনো ফল। এগুলোর পরিমাণ একটু বেশি হলেও ক্ষতি নেই। এছাড়া প্রতিদিন দই। কাঁচা লবণ এবং চা-কফি ও অ্যালকোহল পুরোপুরি বাদ দিয়েছেন তিনি খাবার তালিকা থেকে। ধূমপানও বর্জন করতে হবে।
চতুর্থত, গ্রুপ আলোচনা। হৃদরোগের পেছনে অন্যতম একটি প্রধান কারণ হচ্ছে মনোগত দুঃখ বা মানসিক আঘাত। হৃদরোগীরা অন্তরে একধরনের নিঃসঙ্গতায় ভোগেন। নিজেদের পরিত্যক্ত বা আপনজনহীন মনে করেন। আর কিছু করার নেই, এমন ধরনের হতাশায়ও ভোগেন তারা। এই নিঃসঙ্গতা বা হতাশা কাটিয়ে ওঠার জন্যে তিনি নিয়মিত গ্রুপ আলোচনার ব্যবস্থা করেন। এতে সবাই নিজ নিজ দুঃখ-কষ্টের কথা অকপটে বলে নিজেকে হালকা করেন। কারণ দুঃখ, মনের কষ্ট বা মানসিক চাপ হৃদয়কে ব্যথিত করে হৃদরোগ সৃষ্টি করে। আর যখনই হৃদয় থেকে এই চাপা বিষবাষ্প বেরুতে শুরু করে, হৃদয় হালকা হয়ে ওঠে আর হৃৎপিণ্ড সুস্থতার পথে এগুতে থাকে।
আমাদের দেশের হাজার হাজার হৃদরোগী যারা এই রোগ থেকে নিরাময়ের জন্যে লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করছেন, বিদেশে যাচ্ছেন, তারা দেশে বসেই ডা. অরনিশের থেরাপি প্রয়োগ করে আবার সুস্থ পরিপূর্ণ জীবন পেতে পারেন।