নিরাময় : দায়িত্ব নিজেকে গ্রহণ করতে হবে

মহানবী (স.) বলেছেন, স্বাস্থ্য ও সুস্থতা স্রষ্টার সবচেয়ে বড় নেয়ামত। আমরা জানি, সুস্বাস্থ্য হচ্ছে প্রশান্ত জীবনের প্রথম ভিত্তি। আর প্রশান্তি হচ্ছে সুস্বাস্থ্যের অপরিহার্য উপাদান। সুস্থতা ও প্রশান্তির জন্যে প্রয়োজন সুস্থ দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনচেতনা। কারণ চেতনা বস্তুর চেয়ে আর তথ্য শারীরিক শক্তির চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী ও সর্বত্রগামী। জীবন সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আপনাকে সুস্বাস্থ্য ও প্রশান্তির ফল্গুধারায় অবগাহন করাতে পারে। রোগ ও অসুস্থতা থেকে মুক্তির জন্যে তাই সর্বাগ্রে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, শতকরা ৭০ ভাগ রোগের কারণই মানসিক। অর্থাৎ কোনো ঘটনার প্রেক্ষিতে আপনার মানসিক প্রক্রিয়াই ৭০ ভাগ রোগ সৃষ্টির কারণ। শতকরা ২০ ভাগ রোগের কারণ হচ্ছে ইনফেকশন, ভাইরাস আক্রমণ, ভুল খাদ্য গ্রহণ ও ব্যায়াম না করা। শতকরা ১০ ভাগ রোগ হচ্ছে দৈহিক আঘাত, ওষুধ ও অপারেশন প্রতিক্রিয়া। তাই শুধুমাত্র দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে সুস্থ জীবনদৃষ্টি গ্রহণের মাধ্যমে শতকরা ৭০ ভাগ রোগই নিরাময় হতে পারে। অন্যান্য রোগ নিরাময়েও ওষুধ ও সার্জারির পাশাপাশি সুস্থ জীবনদৃষ্টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা

আধুনিক চিকিৎসা হিসেবে প্রচলিত পাশ্চাত্য চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত ওষুধ, রসায়ন ও অপারেশন নির্ভর। আলোড়ন সৃষ্টিকারী কোয়ান্টাম হিলিং-এর প্রবক্তা ডা. দীপক চোপড়া বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে রোগীরা এক আক্রমণাত্মক যান্ত্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থার শিকার। চিকিৎসা ব্যবস্থার এই যান্ত্রিকতাই যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিবছর শতকরা ৬৬ ভাগ মৃত্যুর জন্যে দায়ী। একটি মার্কিন সাময়িকীর বিশেষ নিবন্ধে বলা হয় যান্ত্রিক ও রসায়ন নির্ভর এ চিকিৎসা ব্যবস্থা এখন হয়ে উঠেছে অত্যন্ত ব্যয়বহুল। চিকিৎসা ব্যবস্থা আসলে হয়ে যাচ্ছে 'চিকিৎসা ব্যবসা' বা 'চিকিৎসা বাজার'। আর এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে বীমা কোম্পানি, ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসা প্রযুক্তির কারখানার মালিকেরা। ফলে এ চিকিৎসাব্যবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষোভ শুধু রোগীদেরই নয়, চিকিৎসা দানকারী বহু কর্মীরও।

ডা. জন রবিন্স এ অবস্থার জন্যে চিকিৎসাবিজ্ঞান সম্পর্কে রোগীদের ভ্রান্ত ধারণাকেও দায়ী করেছেন। তিনি বলেন, এসব রোগীরা মনে করে সুস্বাস্থ্য ও নিরাময়ের ব্যবস্থা রয়েছে ডাক্তার, ড্রাগ স্টোর বা হাসপাতালে। ডাক্তার তাদেরকে ধন্বন্তরী ট্যাবলেট, ক্যাপসুল বা ইনজেকশন দিয়ে ভালো করে দেবেন। এ আশায় রোগীরা ডাক্তারের পর ডাক্তার আর ওষুধের পর ওষুধ বদলায়। কিন্তু নিরাময় লাভ করতে ব্যর্থ হয়। ডা. রবিন্স বলেন, আসলে নিরাময়ের ক্ষমতা, রোগ মুক্তির ক্ষমতা রোগীর মধ্যেই রয়েছে। ডাক্তার শুধু সহায়ক শক্তিমাত্র।

নিজের দায়িত্ব নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে

নব্য চিকিৎসা ধারার প্রবর্তক ডা. ডীন অরনিশ, ডা. দীপক চোপড়া, ডা. ল্যারী ডসি, ডা. জন রবিন্স, ডা. বার্নি সিজেল, ডা. ক্রিশ্চিয়ান নথট্রপে, ডা. হার্বার্ট বেনসন, ডা. জোয়ান রবিসেঙ্কো, ডা. এন্ড্রু ওয়েলস, ডা. এডওয়ার্ড টাওব, ডা. স্যামুয়েলস প্রমুখ- 'বডি, মাইন্ড, স্পিরিট' সাময়িকীর ১৯৯৭ সালের বিশেষ সংখ্যায়, 'একবিংশ শতকের স্বাস্থ্য’ প্রচ্ছদ কাহিনীতে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে মত প্রকাশ করেছেন, সুস্থ থাকতে হলে নিজের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নিজেকেই গ্রহণ করতে হবে। নিজেকে নিরাময় করার ক্ষমতা প্রতিটি মানুষের সহজাত নিরাময় ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। এই সহজাত ক্ষমতার সঙ্গে নিজের বিশ্বাসকে সম্পৃক্ত করতে পারলে প্রচলিত চিকিৎসা ব্যবস্থার শতকরা ৯০ ভাগ খরচই অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে। কারণ বাইপাস সার্জারি, এনজিওপ্লাস্টি বা সারাজীবন কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রক ওষুধ সেবনের চেয়ে জীবন-দৃষ্টি পরিবর্তন করে জীবনধারা পরিবর্তনে খরচ অনেক অনেক কম। ডা. হার্বার্ট বেনসন বলেন, একজন মানুষ নিজে নিজেই শিথিলায়ন, মেডিটেশন, ব্যায়াম ও পুষ্টি সংক্রান্ত জ্ঞান লাভ করতে পারে এবং তার নিজের জীবনে প্রয়োগ করতে পারে। বর্তমানে যেখানে রোগী ওষুধ বা সার্জারির ওপর নির্ভর করছে সেখানে তাদেরকে নিজের ওপর নির্ভর করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

সুস্থ জীবনযাপনের জন্যে নব্য চিকিৎসা ব্যবস্থার অনুসারী হওয়ার কোন বিকল্প নেই। আপনাকেই আপনার স্বাস্থ্য ও নিরাময়ের দায়িত্ব নিতে হবে। ডাক্তার, ওষুধ, সার্জারি সবই হবে আপনার সহযোগী শক্তি।

সুস্বাস্থ্য ও নিরাময়ের জন্যে নিয়মিত প্রার্থনা

মহানবী (স.) বলেছেন, প্রতিটি রোগের নিরাময় রয়েছে। নিজের ও অন্যের নিরাময়ের জন্যে ওষুধ ছাড়াও দোয়ার উপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেছেন। তাই নিজের ও অন্যের সুস্বাস্থ্য ও নিরাময়ের জন্যে জীবন-দৃষ্টি ও জীবন-ধারা পরিবর্তনের জন্যে পরম করুণাময়ের কাছে নিয়মিত প্রার্থনা করুন। দোয়া ও প্রার্থনার গুরুত্ব সম্পর্কে চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. ল্যারী ডসি বলেছেন, প্রার্থনা ও বিজ্ঞান আলাদা কিছু নয়। তার সাম্প্রতিক বই 'প্রেয়ার ইজ গুড মেডিসিন'-এ তিনি নিরাময়ে প্রার্থনা এবং দোয়ার ভূমিকা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে পরিচালিত বহু গবেষণা রিপোর্টের উদ্বৃতি দিয়েছেন। রিপোর্টে দেখা গেছে, যেসব হৃদরোগীর জন্যে প্রার্থনা করা হয়েছে, তাদের গড়পড়তা নিরাময় প্রার্থনা করা হয় নি এমন রোগীর চেয়ে অনেক ভালো। তিনি বলেন, প্রার্থনা হচ্ছে চেতনার শক্তি বহির্গামী করা। আমরা আগে স্বীকার করতাম না, আমাদের চিন্তা ও চেতনা আমাদের মস্তিষ্ক ও শরীরের বাইরে কাজ করতে পারে। কিন্তু অন্যের ব্যাপারে প্রার্থনার কার্যকারিতা এখন এক প্রমাণিত সত্য। এর প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। আধুনিক বিজ্ঞানের সঙ্গে এটি হচ্ছে এক যুগান্তকারী সংযোজন। ইতিমধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ১১টি গুরুত্বপূর্ণ মেডিকেল কলেজ নিরাময়ে আধ্যাত্মিকতা প্রয়োগের কোর্স চালু করেছে। এর ফলে ক্রমান্বয়ে আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের আত্মিকায়ন সম্পন্ন হবে।