হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার

কোরিয়া যুদ্ধের সময় রণক্ষেত্রে নিহত সৈনিকদের অটোপসি করতে গিয়ে ডাক্তাররা সবিস্ময়ে লক্ষ্য করেন, নিহত তরুণ সৈনিকদের শতকরা ৭০ জনেরই আর্টারি চর্বি জমে প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে (অ্যাডভান্সড স্টেজ অফ অ্যাথেরোসক্লেরোসিস)। অথচ যেসব ব্যাপারকে হৃদরোগের জন্য দায়ী মনে করা হতো—যেমন, কম শারীরিক পরিশ্রম, বাধর্ক্য–তার কোনোটাই তো এদের ছিলই না; সেই অর্থে হৃদরোগও তাদের ছিল না। এমনকী আর্টারি প্রায় পুরোটা ব্লক হয়ে যাওয়া সৈনিকদের মধ্যে ১৯ বছর বয়স্ক তরুণও ছিল। এ ঘটনার পর ডাক্তারি মহলে প্রশ্ন উঠে, যদি শুধু করোনারি আর্টারিতে চর্বি জমাটাই হৃদরোগের কারণ হতো তাহলে তো এই তরুণ সৈনিকদের মৃত্যু গুলির আঘাতে নয়, হৃদরোগেই হতো। তাহলে?

এরপর দীর্ঘ গবেষণায় যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকোর ডা. মেয়ার ফ্রেডম্যান এবং ডা. রে রোজেনম্যান দেখান যে, হৃদরোগের সাথে অস্থিরচিত্ততা, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গি বা জীবন পদ্ধতির সরাসরি যোগাযোগ রয়েছে। তবে সবচেয়ে যুগান্তকারী আবিষ্কারটা এসেছে আরও পরে; মার্কিন বিশেষজ্ঞ ডা. ক্রিচটন দীর্ঘ গবেষণার পর দেখালেন যে, হৃদরোগের কারণ প্রধানত মানসিক। তিনি প্রমাণ করলেন, কোলেস্টেরল বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমে করোনারি আর্টারিকে প্রায় ব্লক করে ফেললেই যে হার্ট অ্যাটাক হবে এমন কোনো কথা নেই। যে-কারণে করোনারি আর্টারির ৮৫% বন্ধ অবস্থা নিয়েও একজন ম্যারাথন দৌড়ে অংশ নিয়েছেন; আবার দেখা গেছে একেবারে পরিষ্কার আর্টারি নিয়ে অপর একজন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে। এর পেছনের কারণটা হলো জীবনাচারে অনিয়ম বা ভ্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি। আর এখানেই প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা।

প্রচলিত চিকিৎসায় ধমনীতে জমে থাকা চর্বির স্তর পরিষ্কার করার জন্য ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি কিংবা বাইপাস সার্জারির পরামর্শ দেয়া হয়; যদিও এর কোনোটি দিয়েই পুনঃব্লকেজ প্রতিরোধ করা যায় না। আরও দুঃসংবাদ হচ্ছে এনজিওপ্লাস্টি করার ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে ২৫ থেকে ৫০ শতাংশেরও বেশি রোগীর ধমনীর ব্লকেজ আবার পূর্বের অবস্থায় ফিরে যায়। কারণ অত্যধিক মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা, যা হলো এই রোগের অন্যতম প্রধান অনুঘটক, এর কোনো সমাধান হৃদরোগের প্রচলিত চিকিৎসায় অনুপস্থিত। তাই অপারেশনের পর রোগী যখন পুরনো জীবন অভ্যাসে ফিরে যায়, সে আবারও আক্রান্ত হয় ব্লকেজসহ হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতায়।

জরিপে দেখা গেছে, অপারেশনের পর প্রতি ২০ জনে ১ জন রোগীর পুনরায় হার্ট এটাক হয় এবং স্ট্রোকে আক্রান্ত হয় ৪০ জনে ১ জন রোগী। আর দ্বিতীয়বার বাইপাস করানো মানে ঝুঁকির পরিমাণ ১০% থেকে ২০% বেড়ে যাওয়া। অপারেশনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া এবং বিপুল ব্যয়ভারের কথা তো বলাই বাহুল্য। সব মিলিয়ে প্রচলিত চিকিৎসা অর্থাৎ এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি যে হৃদরোগের কোনো স্থায়ী সমাধান নয় তা এখন সর্বজনস্বীকৃত। বরঞ্চ পাশ্চাত্যে এখন আধুনিকতম ‘চিকিৎসা’ হচ্ছে ‘হেলদি লাইফস্টাইল’ বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।

এ জীবনযাপন শুরু করতে পারেন খুব সহজ তিনটি নিয়ম পালনের মাধ্যমে :

খাদ্যাভ্যাস

দিনে তিন বা দুইবার অনেকবেশি না খেয়ে অল্প অল্প করে কয়েকবার খান। তবে সকালের খাবার বাদ দিবেন না। এতে রক্তে সুগারের পরিমাণ কমে যায়। আর ভারি খাবার যদি খেতেই হয় তবে সকালবেলা হলো সবচেয়ে উত্তম। দুপুরে ভারি খাওয়া মাত্র শরীর ছেড়ে দেয়। ফলে রাত হতে হতে কর্মশক্তির খুব সামান্যই অবশিষ্ট থাকে। আর অসময়ে ক্ষুধা পেলে ওমেগা-থ্রি সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- বাদাম খান। এতে দ্রুত চাঙ্গা বোধ করবেন। কিন্তু সবসময় মনে রাখবেন রাতে ভারি খাওয়া একদম না।

ব্যায়াম

দিনের মধ্যে অন্তত ১৫ মিনিট সময় ব্যায়াম করুন। বহুক্ষণ কর্মক্ষম থাকবেন। বাড়তি মেদের হাত থেকেও মুক্তি পাবেন। আর নিতান্তই ব্যায়াম করতে না চাইলে নিদেনপক্ষে শারীরিক পরিশ্রমের পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করুন, অল্প দুরত্বে রিক্সা না নিয়ে হেঁটে যাতায়াত করুন।

ঘুম

কম ঘুম দেহে বাড়তি স্ট্রেস হরমোন তৈরি করে। অবশ্য অতিরিক্ত ঘুমের প্রভাবও ভালো নয়। তাই যতটুকু দরকার ঘুমিয়ে নিন। আর যদি মেডিটেশন করেন তাহলে এমনিতেই চাঙ্গা থাকবেন। গবেষণায় দেখা গেছে, গভীর ঘুমের চেয়েও মেডিটেটিভ লেভেলে ল্যাকটেট-লেভেল ৪ গুণ বেশি কমে যায়। তাই যারা মেডিটেশন করেন তারা দীর্ঘক্ষণ টানা কাজ করতে পারেন। টেনশন বা অতিরিক্ত মানসিক চাপের জন্যও মহৌষধ হলো মেডিটেশন, বা শিথিলায়ন।

অতএব এই সহজ নিয়মগুলো হৃদয়ে ধারণ করুন, আজ থেকেই অনুসরণে লেগে পড়ুন—দেখবেন ‘হৃদয়ঘটিত’ সমস্যাগুলো দৌড়ে পালাবে!