ওমেগা-৩ ॥ হৃৎবান্ধব বটে, তবে...

ওমেগা-৩। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের কাছে এটি এখন আর অপরিচিত কোনো শব্দ নয়। ওমেগা-৩ শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় একটি অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এটি n-3 নামেও পরিচিত। এই ওমেগা-৩ নিয়ে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিজ্ঞানীদের ব্যাপক আগ্রহ ও গবেষণার অন্যতম কারণ হলো, হৃদযন্ত্রের করোনারি ধমনীর ওপর এর রয়েছে উপকারী প্রভাব। সেইসাথে আরো নানান উপকারিতা তো রয়েছেই।

ওমেগা-৩ দেয় কার্যকর হৃৎসুরক্ষা

ওমেগা-৩ হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। কারণ, এটি হৃৎপিণ্ডের জন্যে উপকারী এইচডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। কমিয়ে দেয় ক্ষতিকর ট্রাইগ্লিসারাইড এবং এলডিএল কোলেস্টেরলের মাত্রা। শুধু তা-ই নয়, ওমেগা-৩ হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনীকে এলডিএল কোলেস্টেরলের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। কীভাবে?

আপাত নির্দোষ এলডিএল কোলেস্টেরল যখন আমাদের শরীরে থাকা অক্সিজেন অণুর সংস্পর্শে আসে মূলত তখনই এটি জারণ প্রক্রিয়ায় অক্সিডাইজড হয়ে বিধ্বংসী রূপ ধারণ করে। আর ওমেগা-৩ এই অক্সিডেশন প্রতিরোধ করার মাধ্যমে হৃদযন্ত্রের ক্ষতি রোধ করে।

করোনারি হৃদরোগে যে ব্যাপারটি ঘটে তা হলো-শরীরের অপ্রয়োজনীয় ও অতিরিক্ত কোলেস্টেরল হৃৎপিণ্ডের করোনারি ধমনীতে ক্রমশ জমে জমে একটি কোলেস্টেরল-প্লাক্ তৈরি হয়, যা হৃৎপিণ্ডে স্বাভাবিক রক্ত সরবরাহে বাধার সৃষ্টি করে। যার পরিণতি হার্ট অ্যাটাক। আর ধমনীতে একটু একটু করে কোলেস্টেরল জমে প্লাক্ বা পিণ্ড তৈরির এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় এথেরোস্ক্লেরোসিস।

ওমেগা-৩ এই প্রাণধ্বংসী এথেরোস্ক্লেরোসিস প্রক্রিয়াটির জন্যে দায়ী রাসায়নিক উপাদান যেমন লিউকোট্রায়েন্স, ফিব্রিনোজেন, প্লাটিলেট এক্টিভেটিং ফ্যাক্টর, পিডিজিএফ, ইন্টারলিউকিন-১, টিএনএফ ইত্যাদির মাত্রা কমায়। ফলে ধমনীতে এথেরোস্ক্লেরোসিসের ঝুঁকি কমে এবং হৃদযন্ত্র থাকে করোনারি হৃদরোগের সম্ভাবনামুক্ত।

এ-ছাড়াও করোনারি হৃদরোগের আরেকটি কারণ হলো করোনারি ধমনীর মাত্রাতিরিক্ত সংকোচন। ওমেগা-৩ করোনারি ধমনীর এ অযাচিত সংকোচন রোধ করে এবং শরীরের যে-কোনো স্থানে ব্লাড ক্লট বা রক্ত জমাটবদ্ধতা সৃষ্টিতে বাধা দেয়।

উপকার আছে আরো

হৃদযন্ত্রের পাশাপাশি বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ শারীরবৃত্তিয় কর্ম-প্রক্রিয়াতেও রয়েছে ওমেগা-৩’র হিতকরী ভূমিকা। মানবদেহের বিভিন্ন অঙ্গের কোষ আবরণীর গঠন ও এর স্বাভাবিক কার্যকারিতার ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ একটি অপরিহার্য উপাদান। এ-ছাড়া আমাদের শরীরের জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু হরমোন-সদৃশ উপাদান তৈরিতেও এর ভূমিকা রয়েছে বলে প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডে রয়েছে ডিএইচএ বা ডোকোসাহেক্সেনয়িক এসিড, শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে যা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি উপাদান। আর যেসব শিশুরা গর্ভাবস্থায় মায়ের খাদ্যতালিকা থেকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ পায় না, পরবর্তীতে তারা বিভিন্ন মনোদৈহিক জটিলতা যেমন ক্ষীণ দৃষ্টিশক্তি, স্নায়বিক সমস্যা ও দুর্বল স্মৃতিশক্তিতে আক্রান্ত হতে পারে।

ওমেগা-৩ সুষম মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যেও গুরুত্বপূর্ণ। গবেষকরা বলেন, এটি মনোযোগহীনতা ও বিষণ্নতা দূর করে। এ-ছাড়াও ওমেগা-৩ হাড়ের ঘনত্ব বাড়ানোর পাশাপাশি আর্থ্রাইটিসের ঝুঁকি কমায়।

কোথায় পাবো তারে

ওমেগা-৩ শরীরের স্বাভাবিক কর্মপ্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় একটি উপাদান হলেও, শরীর নিজে কিন্তু এটি তৈরি করে না। মূলত আমাদের প্রতিদিনকার খাবারই এর একমাত্র উৎস। তাই এর হদিস পেতে হন্যে হয়ে খুঁজতে হবে না দুর্লভ কোনো খাদ্য বা খাদ্য-উপাদান। আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার দিকে একটু মনোযোগী হলেই আমরা পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় পরিমাণ ওমেগা-৩ খুব সহজেই পেতে পারি।

উদ্ভিজ্জ ও প্রাণীজ-এ দুটি উৎস থেকেই ওমেগা-৩ পাওয়া যায়। উদ্ভিদজাত যেসব খাবারে ওমেগা-৩ পাওয়া যায় সেগুলো হলো বাঁধাকপি ও ব্রকোলিসহ সবুজ শাক-সব্জি, শিম, মটরশুঁটি, মুগডাল, তাজা ফলমূল, রসুন, তিসির তেল, অলিভ অয়েল, চীনাবাদাম, আখরোট এবং স্পিরুলিনা।

আর মাছ, বিশেষত সামুদ্রিক মাছ ও মাছের তেল, ডিম ও টক দই হলো সেসব প্রাণিজ উৎসজাত খাবার, যা থেকে আমরা পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ পেতে পারি অনায়াসে।

উদ্ভিজ্জ উৎস যখন নিরাপদ

দৈনন্দিন বিভিন্ন খাবার থেকে ওমেগা-৩ আমরা পাই বটে, কিন্তু এর সবচেয়ে নিরাপদ উৎসটি হলো উদ্ভিদজাত খাদ্য উপাদান। কারণ, ১০০ গ্রাম মাছের তেলে ৩৫ গ্রাম ওমেগা-৩ আছে সত্যি। কিন্তু এতে সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড আছে প্রায় ৪০ গ্রাম, যা শরীরে প্রবেশের পর নিশ্চিতভাবেই বাড়িয়ে দেবে ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরলের পরিমাণ।

জীবনাচার পরিবর্তনের মাধ্যমে করোনারি হৃদরোগীদের সুস্থ জীবনের পথ দেখানোর ক্ষেত্রে প্রথম সফল প্রবর্তক আমেরিকার ডা. ডিন অরনিশ। তিনি তার ‘রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ’ বইয়ে হৃদরোগীদের পরামর্শ দিয়েছেন ওমেগা-৩’র জন্যে উদ্ভিদজাত খাদ্যের দ্বারস্থ হওয়ার।

ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ গ্রহণের ব্যাপারে প্রয়োজন বিশেষ সতর্কতা। কারণ, প্রাণীজ উৎস অর্থাৎ মাছ ও মাছের তেলে থাকা সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড শরীরে ইনসুলিন রেজিস্টেন্স বা ইনসুলিন প্রতিরোধিতা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এ-ছাড়াও মাছের তেলে থাকা সম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড শরীরের অক্সিডেশন প্রক্রিয়াকে বেগবান করে তোলে, যার ফলে মূলত বার্ধক্য প্রক্রিয়াই ত্বরান্বিত হয়।

তবে, ডা. ডিন অরনিশ এবং আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশনের মতে, সপ্তাহে দুই/ তিন বেলার খাবারে মাছ খেতে কোনো অসুবিধা নেই। কিন্তু করোনারি হৃদরোগ থাকলে কিংবা কোলেস্টেরলের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হলে ওমেগা-৩’র জন্যে প্রাণীজ উৎসের দ্বারস্থ না হলেই ভালো। কারণ, স্বাস্থ্যসম্মত ও সুষম খাদ্যতালিকা বলতে আমরা যা বুঝি তা থেকেই পর্যাপ্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ পাওয়া সম্ভব।

ওমেগা-৩ ক্যাপসুল কখনোই নয়

দেশি-বিদেশি কিছু ওষুধ কোম্পানি ইদানীং ওমেগা-৩ ক্যাপসুল বাজারজাত করে বেশ জাঁকিয়ে ব্যবসা করছে। অথচ সত্য হলো, নিয়মিত ওমেগা-৩ ক্যাপসুল গ্রহণের ধারণাটা অপ্রয়োজনীয় শুধু নয়, বরং ক্ষতিকরও। জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল এসোসিয়েশন-এর একটি গবেষণা-প্রতিবেদনে এটি উল্লেখ করা হয়েছে।

এ-ছাড়াও উত্তর মেরুর অধিবাসী এস্কিমোদের জীবন থেকে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। প্রাকৃতিক ও ভৌগলিক কারণে বছরের ১২ মাস জুড়েই এস্কিমোদের প্রধানতম খাবার সামুদ্রিক মাছ। গবেষণায় দেখা গেছে, এ কারণে এস্কিমোদের মধ্যে হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত হওয়ার হার তুলনামূলক কম। কিন্তু অন্যদিকে তাদের স্ট্রোকে মৃত্যুর হার ঢের বেশি।

দীর্ঘ অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়েছে যে, দৈনন্দিন খাবার অর্থাৎ সামুদ্রিক মাছ থেকে প্রাপ্ত অতিরিক্ত পরিমাণ ওমেগা-৩ নীরবে এদের জীবনে স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়িয়ে চলেছে। তাই ওমেগা-৩’র জন্যে ক্যাপসুল কিংবা অন্য যে-কোনো কৃত্রিম খাবারের দ্বারস্থ হওয়া মানেই স্ট্রোকের ঝুঁকি বাড়ানো। শুধু তা-ই নয়, মাত্রাতিরিক্ত ওমেগা-৩ পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায় ও ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ায় শর্করার মাত্রা।

এ-ছাড়াও যেসব হৃদরোগী চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত এসপিরিন জাতীয় ওষুধ খান, তাদের ক্ষেত্রে ওমেগা-৩ ক্যাপসুলের মারাত্মক ও বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া হতে পারে।

তথ্যসূত্র : ডা. ডিন অরনিশের ‘প্রোগ্রাম ফর রিভার্সিং হার্ট ডিজিজ’

           জার্নাল অব ইউনিভার্সিটি অব মেরিল্যান্ড মেডিকেল সেন্টার

           ওয়েব-এমডি ডটকম

           হার্ভার্ড স্কুল অব পাবলিক হেলথ অনলাইন জার্নাল

           মেয়ো ক্লিনিক অনলাইন জার্নাল