published : ২ মার্চ ২০২৩
খাবার বা ফুড মানুষের ব্রেনকে প্রভাবিত করতে পারে, এমনকি জন্মের আগে মায়ের গর্ভে থাকা অবস্থায়ও!
মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ফিলিস জাকা ২৩ হাজার মা-কে নিয়ে একটা গবেষণা করেছেন। যেখানে তিনি দেখেছেন গর্ভাবস্থায় যেসব মায়েরা জাংক ফুড, প্রসেসড ফুড, ফিজি ড্রিংকস এবং সল্টি স্ন্যাকস যেমন- চিপস, কেক, বিস্কিট ইত্যাদি খেয়েছেন তাদের সন্তানেরা বেশ মেজাজী, অস্থির আর আক্রমণাত্মক হয়েছে তাদের তুলনায়, যাদের মায়েরা গর্ভাবস্থায় বেশি বেশি প্রাকৃতিক ও তাজা খাবার খেয়েছেন হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবার ও প্রসেসড ফুডের বদলে। এমনকি বিষণ্নতা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এবং দুঃস্বপ্নে ভোগার মতো সমস্যাও দেখা গেছে এই শিশুদের মধ্যে।
University of Bordeaux (ইউনিভার্সিটি অব বোডাউয়ের) ল্যাবে ইঁদুরের ওপর একটা গবেষণা হয়। এতে একটি ইঁদুরের জন্যে একপাশে আলোকোজ্জ্বল পরিবেশ এবং অন্য পাশে একটা অন্ধকার কোনার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
সুস্থ স্বাভাবিক একটি ইঁদুর আলোকোজ্জ্বল পরিবেশেও বিচরণ করবে। খুঁটিয়ে দেখবে যে এখানে সে থাকতে পারবে কি না।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেতে পেয়েছে এবং পায় নি এমন দুটি ইঁদুরের অবস্থা
কিন্তু এই ইঁদুরটি স্বাভাবিক নয়। জন্মের পর থেকে একে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড খেতে দেয়া হয় নি।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড হলো এমন একটি উপাদান যা ব্রেনের বিকাশ ও স্বাভাবিক কার্যক্রমের জন্যে অপরিহার্য। কারণ ব্রেনে যে গ্রে-ম্যাটার বা ধূসর পদার্থ থাকে তার ৯০% ই হলো ফ্যাট এবং ব্রেন নিজে নিজে তা তৈরিও করতে পারে না, খাবারের মাধ্যমে বাইরে থেকে তা যোগাতে হয়।
আর নিজের ব্রেনে এই উপাদানটির অভাবের কারণেই ল্যাবের ইঁদুরটি আলোকোজ্জ্বল পরিবেশ খতিয়ে দেখার বদলে অন্ধকার কোনায় লুকিয়ে থাকাকেই বেশি নিরাপদ মনে করেছে।
মানুষের ব্রেনের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যাপার ঘটতে পারে। ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড না পেলে তার মধ্যেও দেখা দিতে পারে এই অনিশ্চয়তাবোধ, অস্থির, ভীতু প্রবণতা।
তৈলাক্ত মাছ, প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা প্রাণীর মাংস, উদ্ভিজ্জ তেল, বীজ এবং কাঠবাদাম। নিজে খান, শিশুদেরকেও খেতে দিন। তাদের ব্রেন হবে সুগঠিত।
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড সমৃদ্ধ খাবার খেলে ব্রেন হবে সুগঠিত (ছবিসূত্র- www.feedstrategy.com)
ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড একটি ভালো ফ্যাট। এটি আপনার ব্রেনের জন্যে সহায়ক। কিন্তু জানেন কি, ভালো ফ্যাট যেমন ব্রেনের উপকার করে, খারাপ ফ্যাট তেমনি বাজাতে পারে ব্রেনের বারোটা?
ইউনিভার্সিটি অব সিডনির প্রফেসর মার্গারেট মরিসের এই গবেষণাটিও ইঁদুরের ওপর। একদল ইঁদুরকে তিনি বাজারের প্রচলিত জাংক ফুড এবং বেকারি ফুড খেতে দেন- মিট পাই, চিপস, কেক, বিস্কিট।
খেয়াল করলে দেখবেন, ইদানিংকার মানুষের খাদ্যাভ্যাসেও এখন এগুলোই বেশি থাকে।
তো এই খাবারগুলোর প্রথম প্রভাব পড়ল প্রাণিটির খাদ্যাসক্তিতে। অর্থাৎ প্রচুর খেয়েও কোনোভাবেই তার খিদে মিটছে না। ল্যাবের এসিস্ট্যান্টরা যতই তাকে খাবার দিক না কেন, চেটেপুটে খেয়ে সে নিমিষেই তা সাবাড় করে ফেলছে।
গবেষকরা ইঁদুরের খাচায় একটি জিনিসকে প্রথমে একভাবে রাখলেন। ইঁদুররা সাধারণত বেশ কৌতূহলী স্বভাবের হয়ে থাকে। জিনিসটি রাখার সাথে সাথেই তাই ল্যাবের ইঁদুর তা পরখ করে দেখল।
কিছুক্ষণ পর গবেষকরা জিনিসটিকে অন্যভাবে রাখলেন।
স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাসে থাকা ইঁদুরটি যেহেতু আগেরবারের কথা মনে রেখেছে, এবারের জিনিসটাকে সে ভিন্নভাবে পরখ করল।
কিন্তু জাংক ফুডে অভ্যস্ত ইঁদুরটিকে দেখা গেল সে একইভাবে, অর্থাৎ আগেরবার যেভাবে পরখ করেছে, এবারও ঠিক একইভাবে করছে। অর্থাৎ প্রথমবার পরখ করার কথা তার মনেই নেই। সে ধরে নিয়েছে, এইমাত্রই জিনিসটি এখানে রাখা হয়েছে। অর্থাৎ জাঙ্কফুড তার স্মৃতিশক্তিকে নষ্ট করেছে।
চিনি এমন একটি উপাদান যার উপস্থিতি নেই এমন প্রসেসড খাবার পাওয়া দুষ্কর।
চিনি দেয়া হয় নি এমন প্রক্রিয়াজাত খাবার পাওয়া দুষ্কর! (ছবিসূত্র- www.awesomechef.in)
আপনি যখন চিনিজাত কোনো খাবার খান আপনার ব্রেনে ঠিক সেই প্রক্রিয়াটাই উদ্দীপ্ত হয় যা ড্রাগ বা যৌনাবেগ থেকে হয়। মানে আরো পেতে ইচ্ছে করে, আরো খেতে ইচ্ছে করে। এ কারণেই অনেক সময় দেখা যায় মিষ্টি কিছু খাওয়ার জন্যে কেউ কেউ রীতিমতো অস্থির হয়ে ওঠে। ডায়াবেটিসের রোগী যাতে খেতে না পারে এজন্যে ফ্রিজে মিষ্টি তালা দিয়ে রাখতে হচ্ছে এমনও শোনা যায়!
অর্থাৎ প্রভাবটা গাঁজা, হেরোইন বা ইয়াবার মতোই, হয়তো তীব্রতাটা কম।
বিজ্ঞানীরা আলঝেইমার রোগটিকে এখন বলে থাকেন ব্রেনের ডায়াবেটিস। মানে অতিরিক্ত চিনিকে প্রসেস করতে গিয়ে লিভারের যে দশা হয় এবং পরিণামে ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত চিনিকে প্রসেস করতে গিয়েও ব্রেনের সেই একই পরিণতি হয় আলঝেইমারের মধ্য দিয়ে।
কাজেই সরাসরি চিনি থেকে তো সাবধান হবেনই, বাজারের যে-কোনো প্রসেসড খাবার কেনার আগে নিশ্চিত হোন যে এতে চিনি ব্যবহার করা হয় নি, আপাতত তা যতই মিষ্টিহীন স্বাদের হোক না কেন!
১. ইলিশ ও ভেটকি মাছ- প্রচুর ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিডের উৎস
২. বাদাম, বিশেষত কাঠবাদাম ও আখরোট
৩. তাজা ফল ও সবজি যেমন, পেয়ারা, টমেটো, পালং শাক ও বরবটি। এছাড়া স্ট্রবেরি, ব্লু বেরি ও কিউই ফলের কথাও বলা হয়। ষাটোর্ধ্ব বয়সী ৩৭৭৮ জন মানুষকে নিয়ে একটা গবেষণা করে দেখা যায় দিনে দুবাটি তাজা সবজি ও ফল খেয়েছেন যারা তাদের বয়সজনিত মানসিক ক্ষমতা হ্রাসের হার ৩৮% ভাগ কম হয়েছে যারা এর চেয়ে কম খেয়েছেন।
ব্রেনের কার্যক্ষমতা বাড়াতে তাজা সবজি খেতে হবে নিয়মিত
৪. ডিম- ভিটামিন বি-৬, বি-১২, ফোলেট এবং কোলিনের উৎস। কোলিন এমন একটি উপাদান যা এসিটাইকোলিন নামে একটি নিউরোট্রান্সমিটারের উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেয়। যা মুড ও মেমোরি অর্থাৎ মেজাজ ও স্মৃতিশক্তির জন্যে সহায়ক।
১. ভালো ঘুম
২. হাঁটা, যোগব্যায়াম ও শারীরিক শক্তি ব্যবহার করে খেলা
৩. পর্যাপ্ত পানি পান
৪. স্ট্রেস ও টেনশনমুক্ত থাকা। আর এর অব্যর্থ দাওয়াই হলো মেডিটেশন। প্রতিদিন দুবেলা আধঘণ্টা যদি শিথিলায়ন মেডিটেশন করেন ব্রেনের কার্যক্ষমতা দেখে আপনি নিজেই অবাক হবেন।