published : ২২ জুলাই ২০১৩
রোজার ধর্মীয় এবং আত্মিক গুরুত্বের কথা কমবেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু শারীরিক উপকারের কথা কিন্তু অনেকেই সেভাবে জানি না। পাঠক, আসুন দেখি, স্বাস্থ্যের জন্যেও রোজার কি কি উপকারিতা রয়েছে, জানি সেগুলো-
আমরা সাধারণত যে খাবারগুলো খাই, তার অধিকাংশই প্রসেসড খাবার। যেমন, রুটির চেয়ে পাউরুটি-বিস্কুট, কেক বা পিজা-র মতো খাবার আমাদের প্রিয় বেশি। বাইরে বেরুলে সহজে পাওয়াও যায় এগুলো। কিন্তু খাওয়ার পর দেহের ভেতর এগুলো টক্সিনে রূপান্তরিত হয়। এমনকি কোনো কোনো সময় তা এডভান্সড গ্লাইসেশন এন্ড প্রোডাক্ট (Advanced Glycation End product বা AGE) এ রূপান্তরিত হয়। পাঠকদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে, বয়স এবং ডায়াবেটিসের কারণে মানুষের যে দুরারোগ্য ব্যাধিগুলো হয়, যেমন, অ্যাজমা, আথ্রারাইটিস, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি ফেইলিওর, দৃষ্টিশক্তি হারানো, দাঁত পড়ে যাওয়া, মস্তিষ্কের ক্ষমতা কমে যাওয়া–ইত্যাদির পেছনে মূল কারণ হলো এই AGE। তো রোজাতে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকার ফলে এই ফ্যাট কমে এবং ক্ষতিকারক টক্সিনগুলো লিভার, কিডনি ও অন্যান্য অঙ্গের মধ্য দিয়ে রেচনের মাধ্যমে বেরিয়ে যায়।
দেহের যে অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো খাবার হজমের কাজ করে, রোজার সময় তারা একটা বিরতি পায়। হজমের রস নিঃসরণটা তখন ধীর হয়। খাবারগুলোও ভাঙে ধীরে। দেহে তরলের ভারসাম্য বজায় রাখতে এটা খুব সহায়ক। দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তিও তখন নিঃসরণ হয় ধীরে। অবশ্য রোজা রাখলেও পাকস্থলীর এসিড নিঃসরণ বন্ধ হয় না। এজন্যেই পেপটিক আলসারের রোগীদের রোজা রাখার ক্ষেত্রে ডাক্তাররা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে বলেন।
জীবাণু বা আঘাতজনিত কারণে দেহ যে প্রক্রিয়ায় অসুস্থ হয়, গবেষণায় দেখা গেছে রোজা সে প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয়। ফলে রিউমাটয়েড আর্থ্রারাইটিস, এলার্জি, সোরিয়াসিস নামক চর্মরোগ ইত্যাদি থেকে নিরাময়ে রোজার ভূমিকা আছে বলে মনে করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের মতে, পিত্তথলির রোগ আলসারেটিভ কোলাইটিস নিরাময়েও রোজার ভূমিকা আছে।
রোজা রাখাকালীন একজন মানুষের দেহের গ্লুকোজগুলো দ্রুত ভাঙতে থাকে এবং দেহের জন্যে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করে। ফলে তখন ইনসুলিনের উৎপাদন কমে যায় যা প্যানক্রিয়াসকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়। অন্যদিকে গ্লুকোজ ভাঙার সুবিধার্থে গ্লাইকোজেন তৈরি হয় আর এ সবকিছুর সম্মিলিত ফলাফল হলো দেহে ব্লাড সুগারের পরিমাণ কমানো যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সহায়ক।
রোজার প্রথম প্রভাবই হলো গ্লুকোজের আধিক্য কমানো। আর গ্লুকোজ যখন কমে যায়, তখন কেটসিস নামে দেহের এক ধরনের জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়া শুরু হয় যা ফ্যাট কমায় এবং শক্তি যোগায়। এমনকি কিডনি বা পেশিতে যে ফ্যাট জমে তা-ও ক্ষয় হয়ে শক্তি উৎপাদিত হয়। ১৯৯৭ সালে অ্যানালস অব নিউট্রিশন মেটাবলিজমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা যায়, রোজা রাখলে দেহে খারাপ কোলেস্টেরল বা LDL কমে প্রায় ৮%, ট্রাইগ্লিসারাইড কমে ৩০% এবং ভালো কোলেস্টেরল বা HDL বাড়ে ১৪.৩%। ফলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে।
বলা হয়, ওষুধ ছাড়া রক্তচাপ কমাবার এক আদর্শ পদ্ধতি রোজা। কারণ রোজা রাখলে প্রথমে গ্লুকোজ, পরে চর্বিকণাগুলো ক্ষয় হয়ে শক্তি উৎপাদন করে। রোজা রাখলে মেটাবলিক রেটও কমে। এড্রিনালিন এবং নরএড্রিনালিনের মতো স্ট্রেস হরমোন উৎপাদন কমে। আর এতে করে মেটাবলিক হার একটা স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। ফলে ব্লাড প্রেশার কমে। আর এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ে এথেরেসক্লেরোসিস বা ধমনীতে চর্বি জমার প্রক্রিয়ার ওপর যা হার্ট এটাকের ঝুঁকি কমায়।
অনেকেরই অনেক ধরনের খারাপ অভ্যাসের প্রতি আসক্তি থাকে, যেমন-ধুমপান করা, অতিরিক্ত চিনি জাতীয় খাবার খাওয়া ইত্যাদি। রমজানে সারাদিন খাওয়া-দাওয়া থেকে বিরত থাকায় অনেক ধরণের বাজে অভ্যাস থেকে দূরে সরে আসা সহজ হয়। একটানা কয়েকদিন বিরত থাকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই সেই অভ্যাসটা ত্যাগ করা যাবে। সবচেয়ে ভালো হয় যদি এ কাজটা সংঘবদ্ধভাবে করা যায়। যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস রমজান মাসটাকে ধুমপান ছেড়ে দেবার জন্য আদর্শ সময় বলে আখ্যায়িত করেছে। কাজেই এ রমজানে যেকোনো একটা বদভ্যাসকে বেছে নিন, যা আপনি অনেক চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছেন না। এটা হতে পারে ধূমপান, হতে পারে চকলেট খাওয়া বা মিথ্যা বলা বা গীবত করা। প্রতিজ্ঞা করুন যে, এবারের রমজানে এই বদভ্যাস থেকে আপনি মুক্ত হবেন। আপনি দেখবেন আপনার জন্যে সহজ হয়ে গেছে।
অনেকেই আছেন যারা খুব দ্রুত দেহের ওজন কমিয়ে ফেলতে চান। তবে কিছুদিন খাবারের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ না করলেই শরীরের ওজন অনেক বেশি বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু রমজানে ব্যাপারটা একটু আলাদা। এসময়ে খাবার কম কম খাওয়াতে পাকস্থলী সংকুচিত হয়ে যায়। তাই অল্প খাবার খেলেই পেট ভরে যায়। তাই রমজান মাস হচ্ছে সঠিক খাদ্যাভ্যাস শুরু করার একটা ভীষণ ভালো সময়। কাজেই এ ধরনের অভ্যাসের কারণে রমজানের পরেও দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করাটা সহজ হয়।
রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে যে শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমানো সম্ভব, সেটা প্রায় সবারই জানা। তবে এটা ছাড়াও আরো বেশ কিছু শারীরিক পরিবর্তন ঘটাও অসম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচের একদল কার্ডিওলজিস্ট বলেছেন যে যারা রমজানে রোজা রাখেন তাদের রক্তে কোলেস্টেরল এর পরিমাণ কমে যায়। ফলে নানা ধরণের হৃদরোগ যেমন হার্ট এটাক, স্ট্রোক ইত্যাদির ঝুঁকিও কমে যায়। আর যদি রমজানের পরেও সুষম এই খাদ্যাভ্যাস চালু রাখা যায়, তবে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ার কোনো সম্ভাবনাই থাকবে না।
রমযানে রোজা রাখার মাধ্যমে দেহ ও মনে নিঃসন্দেহে একধরণের ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হয়। আমেরিকার একদল বিজ্ঞানী গবেষণা করে দেখেছেন যে রমজানে রোজা রাখার মাধ্যমে মস্তিষ্কে নতুন নতুন কোষের জন্ম হয়। ফলে মস্তিষ্কের কর্মদক্ষতা বেড়ে যায়। অন্যদিকে কোটিসল নামক একধরণের হরমোন যা আড্রিনালিন গ্রন্থি থেকে নিঃসরিত হয়, তার পরিমাণ কমে যায়। ফলশ্রুতিতে পুরো রমজান মাসে এবং রমজানের পরেও মানসিক চাপ বেশ কম থাকে।