প্রাচ্যের ধ্যান : পাশ্চাত্যের নতুন উপলব্ধি

published : ২৭ জানুয়ারি ২০১৬

মেডিটেশন হচ্ছে জীবন যাপনের বিজ্ঞান। এ বিশ্বাস গত তিন দশক ধরে ধারণ ও লালন করছে কোয়ান্টাম। পাশ্চাত্যের সমাজে ও মিডিয়ায় এখন তারই সুরে বাজছে মেডিটেশনের জয়ধ্বনি।

কোলাহলমুক্ত একটি ঘর। আধো আলো, আধো অন্ধকার। চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। আপনি এখন বাইরের জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ডুব দেবেন নিজের ভেতরে। লম্বা দম নিয়ে দমের ওপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে পৌঁছে যাবেন ধ্যানের স্তরে। আপনার প্রয়োজন অনুসারে ইতিবাচক কথার বারবার পুনরাবৃত্তি করে আপনি এখন দিনের কাজ শুরু করবেন। এভাবে মেডিটেশন বা আত্ম উন্নয়নমূলক ধ্যানের ব্যাপারটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বর্তমানে সেখানে এক কোটি মানুষ নিয়মিত মেডিটেশন করছেন যা নব্বই দশকের দ্বিগুণ। মেডিটেশন এখন তাদের স্মার্টনেসের একটি অংশ। মেডিটেশনে অবিশ্বাসীরা পরিণত হচ্ছেন সংখ্যালঘুতে।

ডাক্তাররা এখন মেডিটেশনকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইদানীং প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে মেডিটেশন কাজ করে। আমেরিকার অধিকাংশ ডাক্তারই এখন রোগ প্রতিরোধ, রোগের প্রকোপ কমিয়ে আনা বা রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্যে মেডিটেশনকে সহায়ক ভাবছেন। বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা উপশম, হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ, উচ্চরক্তচাপ কমিয়ে আনা, চর্মরোগ, ক্যান্সার কিংবা বন্ধ্যাত্ব মোকাবেলায় মেডিটেশনের সাহায্য নিচ্ছেন।

হতাশা, অমনোযোগ, অস্থিরতা, অস্বাভাবিক আচরণ এসব মানসিক সমস্যা নিয়ে অনেক রোগী ডাক্তারের কাছে আসেন। বিশেষজ্ঞরা তাদের সুস্থতার জন্যে এখন মেডিটেশনকেই সফল ওষুধ হিসেবে মনে করছেন।

তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাইলামা এবং একদল স্নায়ু বিজ্ঞানীর কথোপকথন নিয়ে ডিসট্রাকটিভ্ ইমোশনস নামক বইতে ডানিয়েল গোলম্যান বলেন, গত ত্রিশ বছরে মেডিটেশন নিয়ে গবেষণায় এখন এটা স্বীকৃত যে, টেনশন বা স্ট্রেস উপশমে মেডিটেশন একটি প্রতিষেধক। নতুন গবেষণায় আধুনিক ইমেজিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারছেন মেডিটেশন মনকে নিয়ন্ত্রণ এবং মস্তিষ্কের কর্ম কাঠামো পরিবর্তন করতে পারে (Meditation can train the mind and reshape the brain)।

অধিকাংশ আমেরিকান দীর্ঘায়ু লাভ করতে এখন মেডিটেশনের দিকে ঝুঁকছেন। গবেষক ডা. ডীন অরনিশের মতে মেডিটেশন, যোগ ব্যায়াম এবং পরিমিত আহার সম্মিলিতভাবে দীর্ঘায়ুতে সহায়ক। হৃদরোগ নিরাময়ে অরনিশের প্রক্রিয়া সর্বজন বিদিত। সম্প্রতি আমেরিকার ইউরোলজিক্যাল সমিতির সম্মেলনে তিনি তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণার ফলাফল ঘোষণা করেন, মেডিটেশন প্রস্টেট ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মেডিটেশন এখন বিশ্বজুড়ে স্বাস্থ্য সেবার অন্যতম স্বীকৃত পদ্ধতি।

গভীর ধ্যানাবস্থায় শরীরের মতো মস্তিষ্কেও সূক্ষ পরিবর্তন ঘটে। গত শতাব্দীর ৬০ থেকে ৭০ দশকের মধ্যে এ নিয়ে প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশন চর্চাকারীরা খুব সহজেই নির্দিষ্ট একটা কিছুতে মনকে কেন্দ্রীভূত করতে পারেন।

মেডিটেশন চর্চা বাড়ার সাথে সাথে এখন এর প্রক্রিয়াগুলো অনেক সহজ হয়ে গেছে। ধ্যানী হওয়ার জন্যে এখন কাউকে জঙ্গলে বা পাহাড়ের গুহায় শ্মশ্রুধারী গুরুর কাছে যেতে হয় না। বরং মার্কিন সমাজে এটি একটি নিত্য দিনের ব্যাপার। স্কুল, হাসপাতাল, করপোরেট অফিস, সরকারি কার্যালয়গুলোতে মেডিটেশন হচ্ছে। জেলখানা, বিমান বন্দরে রয়েছে মেডিটেশনের জন্যে আলাদা ব্যবস্থা।

আইওয়া অঙ্গরাজ্যের মহাঋষি ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ কলেজ এবং স্কুলগুলোতে ছাত্র-ছাত্রীরা দিনে দুবার মেডিটেশন করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে খেলোয়াড়দের জন্যে মেডিটেশন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

আমেরিকায় এখন জনপ্রিয় মেডিটেশন প্রক্রিয়াগুলো হচ্ছে জেন, বিপাসন, টি এম ও প্রাচ্যের অন্যান্য ধ্যান পদ্ধতি।

মূলধারার জনগণের পাশাপাশি মেডিটেশনকারীদের দলে বিখ্যাতরাও নাম লিখিয়েছেন। এদের মধ্যে আছেন ফোর্ড মটরসের প্রধান ধনকুবের বিল ফোর্ড, সাবেক মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট আল গোর দম্পতি, হিলারী ক্লিনটন, শোবিজ তারকা গোল্ডি হন, শানিয়া টোয়েন, হিদার গ্রাহাম, রিচার্ড গিয়ার প্রমুখ। এদের প্রত্যেকেই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে মেডিটেশনের সফল ব্যবহার করছেন।

পৃথিবীতে কবে থেকে মেডিটেশন বা ধ্যান শুরু হয় তার সঠিক সময়কাল এখনো অজানা। তবে মেডিটেশনের সূতিকাগার হচ্ছে প্রাচ্য। প্রাচ্যের সাধকরা ধ্যানের যে শক্তিকে নিজের ও অন্যের কল্যাণে ব্যবহার করেছেন একবিংশ শতাব্দীতে এসে তাকে পাশ্চাত্য নতুন উদ্যমে বরণ করছে। শারীরিক, মানসিক, আত্মিক প্রশান্তির জন্যে প্রতিদিনের ব্যস্ততার মাঝেও কিছু সময় ব্যয় করেছে মেডিটেশনের পেছনে। কয়েক বছর আগেও যা ছিলো আধ্যাত্মিকতার রহস্যে আবৃত, তা-ই এখন পরিণত হয়েছে ‘দি সাইন্স অব মেডিটেশন’ এ।

[Time Magazine, August 4, ‘The Science of Meditation’]